১৫ নভেম্বর ২০২১ তারিখে ৮৩ বছর বয়সে অনন্তের পথে পাড়ি জমালেন বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র দীপ, বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর বিচারে তিরাশি বছরে একজন মানুষের প্রয়াণ হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু যে সমস্ত মানুষ নিজেরাই একটি জাতির আয়ুর নিয়ামক, শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির ধমনীতে যাঁরা রক্তধারার মতো প্রবাহিত হয়ে জাতির মানসজগৎকে বিস্তৃত ও শক্তিমান করে তোলেন, তাঁদের জন্য এ কথা খাটে না। তাই হাসান আজিজুল হকের মতো একজন শক্তিমান সাহিত্যিকের মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি এ কথা বলাই বাহুল্য।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে ১৯৩৯ সনের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে সেখানেই। প্রবেশিকা পরীক্ষার পরে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে বাকি শিক্ষাজীবন সবই সম্পন্ন করেছেন এখানে, খুলনা ও রাজশাহীতে। তাঁর কর্মজীবনেরও অধিকাংশ সময় কেটেছে রাজশাহীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে দীর্ঘ ৩১ বছর চাকরি করে সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটি ‘বিহাস’-এর বাড়িতে বসবাস করছিলেন। এ বাড়িতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কিন্তু জীবনের শুরুতে চৌদ্দ-পনের বছর তিনি যে রাঢ় বাংলায় কাটিয়েছিলেন, সেই জীবন আর প্রকৃতিই তাঁর মানস ভুবনের মূলভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। রুক্ষ, নিরস, টনটনে রাঢ় মাটি আর শ্রমনিষ্ঠ প্রান্তিক মানুষের জীবন তাঁর বোধের জগতে রুদ্র, তপ্ত, প্রস্তরময় এক কঠিন জীবনের উদ্ভাস ফুটিয়ে তুলেছিল। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল দেশ বিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, ব্রিটিশভারত রাজনৈতিক পরিবেশের অস্থিরতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ অবিভক্ত ভারত বাংলাদেশের সবক’টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কাল যাপনের অভিজ্ঞতা। এ সমস্ত অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করেছে গভীর জীবনবীক্ষা। ব্রিটিশ-ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এই তিনকাল পরিভ্রমণকারী হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে তাই ছিল একজন ত্রিকালদর্শী মহাজ্ঞানীর সচেতনতা এবং নির্মোহ নির্বিকার বয়ানে জীবনের সুতীক্ষ্ন চিৎকারের শব্দায়ন। তাঁর লেখায় জীবন এসেছে কঠোর কঠিন রুদ্র রূপ নিয়ে। মূলত নিম্নবিত্ত, দরিদ্র, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবন সংগ্রামই ছিলো তাঁর লেখার মূলভিত্তি। খনিশ্রমিকের মতোই তিনি ক্রমাগত জীবন খুঁড়ে খুঁড়ে জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্লেদ-গ্লানি আর অন্ধকার বেদনার রন্ধ্রগুলো আবিষ্কার করে চলছিলেন। তাঁর লেখার কলম যেন এক ধারালো খনিত্র। সে কলমে তাই বেরিয়ে আসে ‘শকুন’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’ বা ‘শত্রু’র মতো গল্প কিংবা ‘আগুন পাখি’র মতো উপন্যাস। পাথুরে জীবনে হাতিয়ার চালনা করে করে যে আগুন ছিটকে পড়েছে তা দিয়ে হাসান সাজিয়েছেন তাঁর লেখার জগৎ।
শৈশব থেকেই লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। তিনি যখন বর্ধমানের কাশীশ্বরী স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সে সময়ে ওই স্কুলে রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষে একটি মানপত্র লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর সৃজনশীল লেখার যাত্রা শুরু হয়। পরে কলেজ বার্ষিকীতে তাঁর কয়েকটি গল্প-কবিতাও ছাপা হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষার পরে তিনি ‘মাটি ও মানুষ নামে’ একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন, কিন্তু সেটি অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এটি ছাড়াও তিনি ‘শামুক’ (১৯৫৭)) ও ‘বৃত্তায়ন’ (১০৬০) নামে দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন, কিন্তু এ দুটি রচনা নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল না। ‘শামুক’ উপন্যাস পূর্বমেঘ পত্রিকায় আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল এবং ‘বৃত্তায়ন’কে তিনি উপন্যাস হিসেবে সার্থক বলে মনে করেননি। সাহিত্য জীবনের শেষ পাদে এসে তিনি তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন। এর একটি ‘আগুন পাখি’ (২০০৬) অপরটি ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩)। ‘আগুন পাখি’ উপন্যাস তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিলো। দেশত্যাগের নির্মমতা ও বেদনা এ উপন্যাসের আখ্যান। এ বইয়ের জন্য ২০০৮ সালে তিনি পেয়েছেন আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার। ‘শিউলি’ (২০০৬) নামে একটি উপন্যাসিকাও তাঁর লেখার তালিকায় ছিলো।
উপন্যাস নয় গল্পই ছিল তাঁর আরাধ্য। উপন্যাসে একটি জীবন বলয় নির্মাণ করা হয়, যার একটি সূচনা বিস্তার এবং উপসংহার আছে। কিন্তু গল্পের শেষ নেই। ছোটগল্প জীবনের কোনো এক খণ্ডিত অংশের ওপর আলো ফেলে বাকি অংশ থাকে অনাবিষ্কৃত। হাসান আজিজুল হক চাইতেন ছোটগল্পের মধ্য দিয়েই তিনি পোড় খাওয়া সংগ্রামী মানুষ এবং দেশ-কাল-সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা মানুষের মনোজগতের বহুতলবিশিষ্ট স্তরগুলো তাঁর এক-এক গল্পে এক-একভাবে উন্মোচন করবেন। প্রতিটি স্তর থেকে তুলে আনবেন গল্প। উপন্যাসের মধ্যকার এক জীবনের সমাপ্তিতে হয়তো তৃপ্ত ছিলেন না তিনি। তাই গল্পের জগৎই ছিল তাঁর বিচরণের ক্ষেত্র।
সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ সাহিত্য পত্রিকায় ১৯৬০ সালে তাঁর লেখা ‘শকুন’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়েই লেখক হিসেবে তিনি সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একজন তরুণ লেখকের হাত দিয়ে ‘শকুন’-এর মতো এমন একটি আধুনিক শিল্পরীতির গল্প- যেখানে একাধারে রয়েছে শ্রেণিচেতনার মেটাফর, উত্তরবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের জীবন্ত ডায়ালেক্ট, গ্রামীণ প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বর্ণনায় অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় ভাষা, অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে পরিপূর্ণ রহস্যময় আবহের মধ্যে শকুনের পতন এবং বালকদের কথোপকথনের তীক্ষ্ন শাব্দিক দ্যোতনা, যা পাঠককে ক্রমশ সহজতার ভেতর দিয়ে এক গূঢ় গভীর দৃশ্যান্তরে নিয়ে যায়- সৃষ্টি হতে পারে তা যেন ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। একই বছর পূর্বমেঘ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের সপক্ষে’ শিরোনামের গল্প প্রকাশিত হলে ভিন্নধর্মী কথাসাহিত্যিক হিসেবে সাহিত্যমহলে পরিচিতি হয়ে ওঠেন। ক্রমশ তাঁর গল্পের ভুবন বিস্তৃত হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত তাঁর গল্প ছাপা হতে থাকে। গল্পেই তিনি নির্মাণ করতে থাকে এক ব্যতিক্রমধর্মী কথাসাহিত্যের জগৎ। অভাব, খরা, দুর্ভিক্ষ, রোগব্যাধি পীড়িত নিরন্ন, ক্ষুধাতর্, বাস্তুচ্যুত, ভূমিহীন, আশাহীন, ভরসাহীন মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা বর্ণিত হতে থাকে তাঁর গল্পগুলোতে। দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, সামন্তবাদী শোষণ বঞ্চনার চিত্র তাঁর গল্পে বারবার উঠে এসেছে। এই জীবনকে চিত্রায়িত করতে তিনি এক ব্যতিক্রমী ভাষাশৈলী আশ্রয় করেছেন। এ ভাষা একাধারে নিরাবেগ, নির্মোহ, রূঢ় বাস্তবতার আগুনে পোড়ানো টনটনে, কঠিন, নির্মেদ; অন্যদিকে তা রূপক ব্যঞ্জনায় মন্দ্রিত। রাঢ় বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি এমন অনায়াস দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর গদ্যকে দিয়েছে এক অফুরন্ত জীবনীশক্তি। এসবই হাসান আজিজুলকে ভিন্নমাত্রার এবং স্বতন্ত্র ঘরানার একজন আধুনিক লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ধ্রুপদী বিশ্বসাহিত্যের বিপুল পাঠ অভিজ্ঞতা ও তুলনামূলক সাহিত্যচিন্তা, আন্তর্জাতিক বিশ্ববীক্ষা, সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি জ্ঞান, তাঁর লেখক মানসকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি থেকেছেন রাজশাহীতে, লিখেছেন মাটি ও মানুষের কথা, সাহিত্যের মূল শেকড়টি ছিলো স্বদেশের মাটিতে প্রোথিত, কিন্তু চিন্তায় তিনি ছিলেন আধুনিক। মানুষ ও প্রকৃতির নিবিড় পাঠের ভেতর দিয়ে তিনি সাহিত্যে যে আপাতসরল জীবনঘনিষ্ঠ ভাষাভঙ্গি নির্মাণ করেছেনে তা উত্তরাধুনিক সাহিত্যশৈলীরই ভিন্নমাত্রিক রূপকল্প।
গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি বেশকিছু প্রবন্ধ গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা (২০০৫), রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা (২০১৪) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি স্মৃতিকথাও তিনি লিখে গিয়েছেন। এগুলো হলো- ফিরে যাই ফিরে আসি (২২০৯) উঁকি দিয়ে দিগন্ত (২০১১), টান (২০১২), লন্ডনের ডায়েরি ২০১৩) ও এই পুরাতন আখরগুলি (২০১৪)। স্মৃতিকথাগুলোতে শুধু তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতাময় জীবনের ঘটনাই বর্ণিত হয়নি এগুলোকে বলা চলে তাঁর সাহিত্যভাবনা ও জীবনদর্শনের নানা উদ্ভাসে উজ্জ্বল এক-একটি মানসভুবন। বরেণ্য এই সাহিত্যিক জীবদ্দশাতেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯) ছাড়াও একুশে পদক (১৯৯৯) বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১০৭৭), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭)সহ দেশের ও বিদেশের সাহিত্যাঙ্গনের বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
তাঁর কলম থেমে গেলেও তাঁর রচিত সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের কথা বলে যাবেন আরও বহুকাল। তিনি আমাদের সাহিত্যকে শুধু তাঁর লেখা নিয়েই সমৃদ্ধ করে যাননি, তিনি জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যের একটি ধারা তৈরি করে দিয়েছেন, যা পরবর্তী সাহিত্য প্রজন্মের জন্য দিকদর্শন হিসেবে কাজ করবে। তিনি জীবনে জীবন ঘষে আগুন জ্বালানো মানুষের কথা বলেছেন, আবার আগুনের পাখি ফিনিক্সের নিজেরই ছাই থেকে জেগে উঠবার মন্ত্র শুনিয়েছেন। জাগতিক নিয়মে তাঁর দৈহিক প্রয়াণ হলেও তিনি চিরায়ুষ্মান হয়ে থাকবেন সাহিত্যে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি