অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রাজিক হাসান -
অমর গানের অমর কবি- গাফফার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

লন্ডন প্রবাসী বুদ্ধিজীবী গাফফার চৌধুরীর লেখার খুব ভক্ত ছিলাম আমি। তখন তিনি ‘যায় যায় দিন’, ‘ভোরের কাগজ’-সহ নানা পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর প্রতি ছিল বিশেষ এক শ্রদ্ধা; এর মূল কারণ ছিল তিনি ‘একুশে’ গানের রচয়িতা। দীর্ঘদিন লন্ডনবাসের কারণে ব্রিটিশ কায়দাটি তিনি বেশ ভালোই রপ্ত করেছিলেন। তাঁর কলামেরও বিশেষ ভক্ত ছিলাম আমি।

২০০১ সালে ওভারসিস স্টুডেন্ট হিসেবে লন্ডন যাই আমি। ২০০২ সালে সৌভাগ্যক্রমে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মাইক্রো ক্রেডিট ট্রাস্ট প্রজেক্টে জব পাই আমি। আমার কাজ ছিল বিজনেস প্ল্যান ও ক্যাশ ফ্লো নিয়ে কাজ করা। আমি খুব ডেডিকেটেড কর্মী ছিলাম; সারা সপ্তাহের কাজ এক দিনেই শেষ করার চেষ্টা করতাম। বাকি সময় অফিসে আড্ডা দিয়ে কাটাতাম। আমার সাথে কাজ করতেন কুষ্টিয়ার আমিনুল হক বাদশাহ, এক সময় বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। বাদশাহ ভাই গাফফার চৌধুরীর খুব আপনজন ছিলেন। তাঁরা দুইজন তার কিছুদিন আগে একসাথে মক্কা-মদিনায় হজ্জ্ব পালন করেছিলেন। হজ্জ্ব পালনের পর গাফফার চৌধুরী পত্রিকায় একটি কলামও লিখেছিলেন। বয়সে অগ্রজ হলেও বাদশাহ ভাইয়ের সাথে আমার ছিল বন্ধুর সম্পর্ক। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। একদিন দুপুরের লাঞ্চের পর বাদশাহ ভাই আমাকে জানালেন, আজ অফিসে গাফফার ভাই আসবেন। গাফফার চৌধুরীর সাথে দেখা হবে ভেবে আপ্লুত হলাম আমি। যথা সময়ে গাফফার চৌধুরী অফিসে আসলেন এবং অফিসে আসার কারণটি জানালেন। তিনি একটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসের নাম- ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’। উপন্যাসটির তিনি নাট্যরূপ দিয়েছেন; নাটকের রিহার্সেলের জন্য সেন্ট্রাল লন্ডনে একটি জায়গা দরকার। সপ্তাহে একদিন রবিবার, আমাদের ১৩১ কমার্শিয়াল স্ট্রিটের এমসিটি ইউকে অফিসটি তিনি ব্যবহার করতে চান। রবিবার অফিস বন্ধ। সুতরাং একজনকে দায়িত্ব নিতে হবে অফিসটি খোলা রাখার জন্য। এই অধমের উপর আসে সেই দায়িত্ব।

প্রতি রবিবার, প্রায় বছরখানেক চলে নাটকের মহড়া। গাফফার চৌধুরী আসতেন, অফিসের বেজমেন্টে চলতো নাটকের মহড়া, তিনি উপরে আমার চেয়ারের ঠিক পাশে এসে বসতেন। আমি কম্পিউটারে নানা খবর পড়ে শোনাতাম তাঁকে। তখন আশেপাশে কেউ নেই, শুধু আমি আর গাফফার চৌধুরী।

‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি- আপনি কেন এই হঠকারিতা করলেন? সিরাজের সাথে বঙ্গবন্ধুকে মিলালেন।‘- আমার কথা শুনে উনি কোনো উত্তর দিলেন না, মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমি মুখ গম্ভীর করে বলি- ‘আপনি কি পলাশীর যুদ্ধকে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দিতে চান?’ এর উত্তরও দিলেন না তিনি।

আমি বলে গেলাম- ‘১৭৫৬ সালে মায়ের বাবা অর্থাৎ নানা আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজ সিংহাসনে বসে মাত্র ২৩ বছর বয়সে। তখন দিল্লির শাসন ভেঙে পড়েছে। সেই সময় দিল্লির অধীশ্বর এমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে সিরাজ তার অনুমতি প্রার্থনা করারও প্রয়োজনবোধ করেনি। এতে তিনি বেঁচে যান দিল্লিকে বিরাট অঙ্কের খাজনা দেওয়া থেকে। কিন্তু সিরাজের ধমনিতে ছিল তুর্কির রক্ত, তার ভাষাও ছিল না বাংলা। সিরাজ যে বাঙালি ছিল না তা তর্কাতীত। বিদ্যাসাগর লিখেছেন সিরাজ ছিলেন অত্যন্ত প্রজাপীড়ক ও অত্যাচারী।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের হার অবশ্যম্ভাবী ছিল। মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করুক বা না করুক। সিরাজ যে জনগণের কোনো সমর্থন বা সহযোগিতা পায়নি তা আজ স্পষ্ট। কারণ সিরাজের অত্যাচার প্রজাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর ইংরেজরাও ছিল তক্কে তক্কে। একশত বছর ধরে তারা পরিকল্পনা করছিল ভারতবর্ষকে কবজা করতে। ইংরেজদের তুলনায় সিরাজ তো নিতান্ত শিশুই ছিল। বাংলার কোনো ঘরেই সিরাজের ঠাঁই ছিল না, তার পলায়নের পরও কিন্তু তাকে ধরিয়ে দেয় এই বাংলারই জনগণ।

অর্থাৎ বাংলার জনগণ, তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী, আত্মীয়-স্বজন ও তার পারিষদ কেউ চায়নি সিরাজকে। সিরাজের পতন শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। আপনার নাটকে মীরজাফরের এত নিন্দা করার কারণ কি? পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইস্কন্দর আলি মির্জা। মীরজাফর ছিলেন তাঁর গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার। পূর্ব পাকিস্তানের, মানে বর্তমান বাংলাদেশেরও তিনি শাসক ছিলেন বহু বছর ধরে। পূর্ব পাকিস্তানের লোকেরা খুশিমনে তাঁকে মেনে নিয়েছিল। আপনি বলতে পারেন মীরজাফরের কাজের দায় ইস্কন্দর নেবে কেন? কিন্তু নিতে হবে, যেহেতু তারই ডিসেন্ডেন্ট হবার সুবাদে সে ক্ষমতা পেয়েছে।

মুখে তাঁর হাসি লেগেই আছে। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তিনি স্বর নিচু করে বললেন- ‘শোন রাজিক, আমি একজন কলমবাজ; ব্যাস, এতোটুকুই বলতে পারি।‘ উত্তর শুনে আমার সকল উৎসাহ নিমিষেই মিলিয়ে গেল। ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নিয়ে আমাদের আলাপ সেখানেই শেষ হলো। আমি ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ঠ করিনি কখনও।

একদিন বিকেলে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় গাফফার চৌধরীর সাথে এসে আমার চেয়ারের সামনে বসলেন। গাফফার চৌধুরী বললেন- ‘রাজিক বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করবেন আমার প্রিয় অভিনেতা পীযুষ।‘ আমি বলি- ‘পীযুষ দা আমারও খুব প্রিয় অভিনেতা।‘ নানা কথার ফাঁকে শুনলাম ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নিয়ে সিনেমা বানানো হবে। পীযুষ দা আমাকে আগ্রহ নিয়ে বললেন, আমি যেন সিনেমার সাথে জড়িত থাকি। আমি হ্যাঁ বা না কিছুই না বলে চুপ থাকি। সত্যি বলতে নাটকের সংলাপগুলোকেও আমার রদ্দি লেগেছে। মনে মনে ভাবছি, এমন স্ক্রিপ্টের আবার ছবিও হতে পারে। আগেই টের পেয়েছি, পুরো প্রজেক্টই ফরমায়েশি।

মনে নেই ঠিক, বছর তিনেক পর টয়নবি হলে একটা সেমিনারে দেখা হলো গাফফার চৌধুরীর সাথে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, তিনি হেঁটে এসে ঠিক আমার পাশে দাঁড়ালেন, আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন- ‘রাজিক, আমার ছবির শ্যুটিং শেষ। আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি’।

তাঁর রচিত ‘একুশে’ গান, তাঁর সবচেয়ে অমর সৃষ্টি। একুশের গান তিনি লেখার পর সুর দিয়েছিলেন একজন সুরকার- আব্দুল লতিফ। গানটি তখন জনপ্রিয়তার ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারেনি। সুরশ্রষ্ঠা আলতাফ মাহমুদ সুর করার পর গানটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে। আলতাফ মাহমুদের সুরেই এটা প্রভাত ফেরির গানরূপে গৃহীত হয়৷

স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলার’ প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের এমএনএ আবদুল মান্নান। গাফফার চৌধুরী ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘বাঙালি না বাংলাদেশী’সহ তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায়- ৩০। এছাড়া তিনি কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ নাটকও লিখেছেন। এর মধ্যে আছে ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’।

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জীবনাবসান হলো; একটি বর্ণাঢ্য জীবনের সমাপ্তি। তিনি হারিয়ে গেলেন মহাকালে। গাফফার ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। বিদায়। চির বিদায়।

-আব্দুল গাফফার চৌধুরীর জীবনী (সুত্র- উইকিপিডিয়া)
আবদুল গাফফার চৌধুরী (১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪ — ১৯ মে, ২০২২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি গ্রন্থকার, কলাম লেখক। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ -এর রচয়িতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। গাফফার বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নের এক জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ার (উলানিয়া জমিদার বাড়ি) চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সেসময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গামোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল- আরএসপি’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বরিশালের সন্তান শামসুদ্দীন আবুল কালামের লেখা তখন কলকাতার প্রধান পত্রিকাগুলোতে ছাপা হতো।

১৯৫০ সালেই গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন পরিপূর্ণভাবে শুরু হয়। এ সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন বেতন পেতেন ৭০ টাকা। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন ‘দৈনিক ইনসাফ’ পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে মাসিক বেতন পেতেন একশ’ টাকা। এরপর তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এসময় তিনি ‘মাসিক নকীব’ও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’এর সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা ‘মেঘনা’র সম্পাদক হন।

১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘দৈনিক ইত্তেফাক’এর সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুক’এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছুদিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁ’র ‘দৈনিক আজাদ’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ‘দৈনিক জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং ‘অণুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দুবছর পরই আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আওয়াজ’ বের করেন। সেটা বছর দুয়েক চলেছিল। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ। ১৯৬৯ সালের পয়লা জানুয়ারি ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে তিনি আগস্ট মাসে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন।

১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপর তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়। বিলেত যাওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন গ্রোসারি দোকানে কাজ করেন। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ পত্রিকায়ও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’ বের করেন। প্রবাসে বসে এখনও গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিয়মিত লিখে গিয়েছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনীতি, সামসময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশে তিনি আওয়ামী লীগপন্থী কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত এবং সমালোচিত ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ প্রচারক হিসেবে তিনি রাজনৈতিক বিষয়াবলী ব্যাখ্যা করেছেন।

গ্রন্থতালিকা- ডানপিটে শওকত (১৯৫৩), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯), সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭।

সম্পাদনা- বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭২), আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী (১৯৯৩), পলাশী থেকে ধানমন্ডি (২০০৭)- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী।

পুরস্কার ও সম্মাননা- ইউনেস্কো পুরস্কার ( ১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক (১৯৮৩), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক (২০০৮) লন্ডন, স্বাধীনতা পদক ২০০৯, মানিক মিয়া পদক ২০০৯, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি, সংহতি আয়োজিত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে সংবধর্না, ঢাকা (২০০৯)।

Read Previous

মৃত্তিকার কবি কাজী রোজী

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন- ২য় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *