অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেখ রানা -
কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, রাতের নির্জনে…

কাওসার আহমেদ চৌধুরী (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৪ – ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি জ্যোতিষী ও গীতিকার। তিনি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘আপনার রাশি’ নামে রাশিফল গণনার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যান্ড ও সঙ্গীতশিল্পীর জন্য বাংলা আধুনিক গান রচনা করেছেন, তাদের মধ্যে লাভ রান্‌স ব্লাইন্ড, সামিনা চৌধুরী, লাকী আখান্দ এবং নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী অন্যতম। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি গোয়েন্দা হিসেবে তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন।– সুত্র- উইকিপিডিয়া।]

উদাস মুখে কালো শাড়িতে সামিনা চৌধুরী গাইছেন। তখন বিটিভি যুগ। যা দেখতাম মনোযোগ ধরে রেখে দেখা হতো বলে মনে থাকতো। মন শান্ত হয়ে দেখতো, শুনতো, অনুধাবন করতো। সেই স্থির, শান্ত আর সহজিয়া নব্বই সময়ে এই গান শুনে-দেখে আমি এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। ঠিক কোথায় চলে গেলাম তা ঠাহর করতে না পারলেও, আমাকে ফিরে আসতে হলো। আমি ফিরে এলাম আর তার রেশ থেকে গেল যুগ যুগ ধরে। সেই আমার কবিতা পড়া প্রহরে দুটো নামের সাথে পরিচয় হলো আমার। একজন লাকী আখন্দ আর একজন হলেন এই গানের গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরী।

২.
কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখার সাথে আমার সখ্য সেই থেকে মুগ্ধতাও। আমি ভীষণরকম নক্ষত্রঘোর মানুষ ছিলাম। টিভিতে তারকা দেখে তাদেরকে অন্যজগতের না-স্পর্শী মানুষ মনে হতো। নাহ্ মানুষ না, আলোকবর্ষ দূরের তারকা মনে হতো। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর অবয়ব তখনও আমার দৃষ্টিসীমানায় ধরা পড়েনি। কিন্তু তার লেখা গান আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করলো সেই বয়সেই।

কবিতা পড়ার প্রহর গানটাতে কী এমন মধুমাখা ইন্দ্রজাল ছিল, আমার জানা নেই। খুব জানতে চেয়ে আমি পৃথিবীকে আলিঙ্গনও করিনি। করতে পারিনি আসলে। আমার তবু মনে হয়, কাওসার আহমেদ চৌধুরী লেখায়, শব্দের বুনোনে দৃশ্যকল্প তৈরি করতে পারতেন সুনিবিড়। ‘জোনাকির আলো নেভে আর জ্বলে/ শাল মহুয়ার বনে…’ লাকী আখান্দের সুর, সাইকেডেলিক ব্লুজ আর সামিনা চৌধুরীর আলগোছে গেয়ে যাওয়া সেই মুগ্ধতার পরতে পরতে ছিল দৃশ্যকে সামনে নিয়ে আসার সৌন্দর্য্। সেই সুন্দরকে আমি বহুকাল আগে চোখে ধরেছিলাম, নিজের অজান্তেই।

গান শোনা আর ভালোবাসার প্রারম্ভিক সময়ে তাই কাওসার আহমেদ চৌধুরী আমার প্রিয় গীতিকবি হয়ে গেলেন ।

৩.
আমি তখন রেনেসাঁ, ফিড ব্যাক, সোলস শুনি খুব। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান চালিয়ে অঙ্ক কষি বা আম্মার চোখ এড়িয়ে ঘুমাতে যাবার সময়েও ধীর গতিতে গান চালাবার পায়তারা করি। ব্যান্ডের গানে প্রবলভাবে ঝুঁকে পরার আগে আমি খুব শুনতাম তপন চৌধুরীর প্রথম ক্যাসেট যেখানে অনাবিল আশ্বাসে, কান্দো ক্যানে মন সহ অসাধারণ সব গান ছিল। আর শুনতাম কুমার বিশ্বজিৎ। এক সুদর্শন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। টিভিতে যার উপস্থিতিই নতুন মাত্রা এনে দিত। যার কন্ঠে আধুনিক গান তখন সময়ের চেয়েও এগিয়ে থাকা সময়।

এমনই এক সময়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মঞ্চে আলো ফুড়ে মাইক্রোফোনে গান শুরু হলো-
‘যেখানে সীমান্ত তোমার/ সেখানে বসন্ত আমার/ ভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে, আমি বারেবার আসি ফিরে/ ডাকি তোমায় কাছে…’

আরও একবার কথা-সুর-কন্ঠের বৃত্তবন্দি হয়ে গেলাম। সেই কৈশোরের হাহাকার যেন হৃদয়ের অন্তগহীনে গিয়ে হুইরলিং দরবেশের মতো করে ঘুরতে লাগলো, বিষাদের নৃত্য শুরু হলো গানের হামিং ধরে।

বিটিভির একটা ভালো দিক ছিল, গান সম্প্রচারিত হলে গীতিকবি-সুরকারের নাম থাকতো। কবিতা পড়া প্রহরের পর আবারও প্রিয় গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর নাম ফিরে ফিরে এলো তাই। আমি জানলাম আমার গান শোনা দিনে তারকা গীতিকবি মানেই কাওসার আহমেদ চৌধুরী। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা গান মানেই সেই গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

৪.
কাওসার আহমেদ চৌধুরী আর লাকী আখান্দের যৌথসৃষ্টি বাংলা গানে সোনা ফলিয়েছে। অনেক পরে সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি- ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানের গীতিকার এসএম হেদায়েত এর মাধ্যমে লাকী আখন্দের সাথে তার পরিচয়। লাকী আখন্দ তার আগ দিয়ে রেডিওতে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা গান শুনে আগ্রহী হয়েছিলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই তাই লিরিক চেয়ে বসেন। কাওসার আহমেদ চৌধুরীও সানন্দে লিরিক দেন। তারপর, একের পর এক লিরিক লেখা আর লাকী আখান্দের সুর। তৈরি হতে থাকে- ‘আমায় ডেকোনা, ফেরানো যাবে না/ ফেরারী পাখিরা, কুলায় ফেরেনা’। কিংবা নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গাওয়া সেই অবিস্মরণীয় গান- ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে, মনে পড়লো তোমায়/ অশ্রুভরা দুটি চোখ/ তুমি ব্যাথার কাজল মেখে লুকিয়েছিলে ঐ মুখ…’

ততোদিনে আমি ব্যান্ডের গানে বুঁদ হয়ে গেছি। আমার সবচাইতে প্রিয় ব্যান্ড এলআরবি তখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। রেনেসাঁ, সোলস, ফিড ব্যাক… মন উচাটন করা মেলোডি ব্যান্ডের গানে। জ্যাজ, পপ, মেলোরক এর পথ ধরে নব্বই দশক বাংলা গানের ফল্গুধারায় নতুন করে বিকশিত করছে। সেই উত্তাল সময়ের শুরুতে কানে এসে লাগলো মাকসুদের আনন্দকণ্ঠ- ‘ফিরে এসো এই অন্তরে/ তুলনাহীনা বান্ধবী/ যেয়ো নাকো তুমি ঐ দূরে / ব্যথা জাগে এই মন জুড়ে/ হতে চাই ফিরে তোমার গীতিকবি/ মৌসুমী, কারে ভালোবাসো তুমি…’

আহ! কৈশোরের বিহবল বয়সে কী যে হয়ে গেল! চিৎকার করে মৌসুমী গাই আর পাশের বাড়ির কিশোরীর চোখে মৌসুমীকে খুঁজে বেড়াই সলাজ। কাওসার আহমেদ চৌধুরী আবারও হৃদয়ের বন্দরে আনন্দের নোঙর তোলেন আমার। তারপর আসে এলআরবি। আমার গান শোনার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন, পালাবদল। একাধিক গীতিকবির লেখা গা্নে কান পাতা, আইয়ুব বাচ্চুর সুর কণ্ঠ আর ডিস্টর্শন গিটারের শব্দে দিনযাপন। আমরা আনন্দমুখে একটা মন খারাপের গান গাইতে শুরু করি। একা কিংবা কনসার্টে।

‘এই রুপালী গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/ সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো/ গোপন করে’। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা এলআরবি-এর অনেক কালজয়ী গানের একটি। যে গান আমরা শুনেছি আর শুনছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। যে গানের বিস্মৃতি নেই, ভুলে যাওয়া নেই।

‘মনে রেখো তুমি/ কতরাত কতদিন/ শুনিয়েছি গান আমি ক্লান্তিবিহীন…’

৫.
কিন্তু সময়ের নিয়মে একদিন ক্লান্তি এসে দরজায় কড়া নাড়ে। ফেরানো যাবে না বলেই কি না ডাকতে বলে যান কেউ? বিবাগি পাখিদের মতো নীড়ে ফেরার আকাশে নক্ষত্র হয়ে থাকেন একজন। তাকে আমি দূর থেকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধায় অবনত হই। তার শব্দচয়নে ফেলা আসা সময় খুঁজি, খুঁজে পাইও। জীবনের চেয়েও বৃহৎ তার গীতিকবি জীবনের আনন্দ খুঁজি। ‘গান লেখা হলো বিশ্বাঘাতক শিল্প’- এই কথায় আক্ষেপও গায়ে মাখি। তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বিস্মিত হই। প্রেমের আড়ালে দ্রোহের নিজস্ব বাতায়নে অন্য মানুষটিকে খুঁজে বের করতে চাই।

এই না পাওয়া, একটু দেখা- অনেক আড়ালে থাকা রহস্যময় মানুষটার প্রতি মুগ্ধতা বাড়ে আমার, তার কমতি নেই কোনো। সময়ে মনে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খ জানায় কবে কী এসে গেছে কার! বরং কত তারকাকে আমি দ্যুতি হারানো দিকবদল করা সাধারণ আয়নায় পেয়েছি। বরং এই ভালো। কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে আমি দেখিনি, মুগ্ধতার কথা জানাইনি শুধু কবিতা পরা প্রহর আমায় আলগোছে শাল মহুয়ার বনে নিয়ে গেছে এসে। এখনও যেমন করে নিয়ে যায় আর আমি পুরোনো দিনের গন্ধ নেই প্রাণ ভরে।

সেই প্রাণ ভরে নেয়া পুরোনো দিনের মতো সুন্দর থাকুক আমার প্রিয় গীতিকবি। রহস্যময় ওপারে। নিজের মতো করে।

Read Previous

রহস্যের রাজকুমার: কাজী আনোয়ার হোসেন

Read Next

মৃত্তিকার কবি কাজী রোজী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *