অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

কুমার দীপ -
বিনম্র শ্রদ্ধা-সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। উপমহাদেশের সোনালি যুগের দুই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীত জগতের যুগল-বিস্ময়। একই সময়ের দুই নক্ষত্র, একই সময়ে (ফেব্রুয়ারি ২০২২) ঝরে গেলেন পৃথিবীর আকাশ থেকে। সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে এ-খবর অত্যন্ত বেদনার। তবে তাঁরা দুজনই দীর্ঘ ও সফলতায় পূর্ণ একটি জীবন পার করে তবে চলে গেলেন, এটা আমাদের জন্যে সান্ত্বনার বটে। সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি বিনম্র

শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার সামান্য নিবেদন—

কতো বছর ধরে লতার কণ্ঠে গান শুনে আসছি ! কী বাংলা, কী হিন্দি… লতার গানের আমি এমনই অনুরক্ত যে, অনেক বছর ধরে অবাক বিস্ময়ে ভেবে এসেছি— মানুষের কণ্ঠ এমন হয় ! যেন গ্রিক পুরাণের সেই বাঁশি, যে বাঁশি বেজে উঠলে সমস্ত মানুষ ও দেবতা, এমনকি অরণ্যের পশু এবং প্রকৃতিও তন্ময় হয়ে থাকতো; আর লতা যেন অর্ফিয়াস, যিনি কণ্ঠরূপী বাঁশিটা বাজিয়ে চলেন অমেয় দক্ষতায়। আশ্চর্য হলেও সত্য যে লতা মঙ্গেশকরের এই কণ্ঠ শুনে চলচ্চিত্র প্রযোজক শশধর মুখার্জী ‘বড্ড চিকন’ বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন!

সেটা ১৯৪৮ সালের কথা। এর আগে ১৯৪২ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পণ্ডিত বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরকে হারিয়ে ছোটো-ছোটো ভাই-বোনদের নিয়ে অনেকটা দিশেহারা দশা লতার। দীননাথ কেবল পিতা ছিলেন না, লতার সঙ্গীত জীবনের মেন্টরও। তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার প্রথম সঙ্গীত পাঠ পেয়েছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে, তিনি তার বাবার সঙ্গীত নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাবার নাটকে অভিনয়ের সময় নাটকের নারী চরিত্র লতিকার নামানুসারে জন্মসময়ের ‘হেমা’ নাম পরিবর্তন করে তাঁর নাম রাখা হয় লতা। বাবার অকালপ্রয়াণের পর বাবার বন্ধু মাস্টার বিনায়ক দামোদর  লতা এবং মঙ্গেশকর পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর হাত ধরেই ১৯৪৫ সালে মুম্বাইতে চলে যান লতা। বিনায়ক লতাকে দিয়ে সঙ্গীত ও অভিনয়ে ক্যারিয়ার শুরু করাতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তিনিও মারা যান ১৯৪৮ সালে। বিনায়কের মৃত্যুর পরে সঙ্গীত পরিচালক ড. গোলাম হায়দার হয়ে ওঠেন নতুন অভিভাবক। তিনি তখন ‘শহিদ’ নামক একটি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করছিলেন। এই ছবিতে গান গাওয়ার জন্য লতাকে নির্বাচিত করলেও ছবির প্রযোজক শশধর মুখার্জী ওই ‘বড্ড চিকন’ কণ্ঠ বলে লতাকে নাকচ করে দেন। ক্ষুব্ধ গোলাম হায়দার তখন বলেছিলেন যে আগামী বছরগুলিতে প্রযোজক এবং পরিচালকরা লতার পায়ে পড়বেন এবং তাদের সিনেমাতে গান করার জন্য তার কাছে ধর্না দেবেন। ওস্তাদ গোলাম হায়দারের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল, সে-তথ্য আজ আর না দিলেও চলে। হায়দারের হাত ধরেই ১৯৪৮ সালে ‘মজবুর’ সিনেমায় গান গেয়ে হিট হয়েছিলেন লতা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের ৮৪তম জন্মদিনে লতা নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘গোলাম হায়দার সত্যই আমার গডফাদার। তিনিই প্রথম সঙ্গীত পরিচালক যিনি আমার প্রতিভার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন।’ শুধু গোলাম হায়দার নন, মুম্বাইয়ের সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র জগতের সকলেরই সবচেয়ে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। কেবল মুম্বাই কেন, সমগ্র ভারতবর্ষ তথা ভারতীয় উপমহাদেশেরই সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী তিনি। প্রায় ৮ দশকের সঙ্গীত জীবনে ৩৬টিরও বেশি ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজি, ইন্দোনেশিয়ান, রাশিয়ান, ডাচ, নেপালি, এবং সোয়াহিলি ভাষায় হাজার হাজার গান গেয়েছেন তিনি। কোনো কোনো তথ্য মতে এই সংখ্যা ২৫, ৩০, ৫০ হাজার। সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ডিং-এর জন্য গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন। ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী গায়িকা হিসেবে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘কুইন অফ মেলোডি’, ‘নাইটিংগেল অফ ইন্ডিয়া’, এবং ‘ভয়েস অফ দ্য মিলেনিয়াম’ এর মতো সম্মানজনক উপাধিতে। বাঙালিরা তাঁকে ‘সুর সম্রাজ্ঞী’ নামেই অধিক জানে। ভারত সরকারের নিকট থেকে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে (১৯৮৯) পুরস্কার, ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ভারতরত্ন (২০০১)। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাকে তার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, অফিসার অফ দ্য ন্যাশনাল অর্ডার অফ দ্য লিজিয়ন অফ অনারে ভূষিত করে। এছাড়া তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার, চারটি ফিল্মফেয়ার সেরা মহিলা প্লেব্যাক পুরস্কার, দুটি ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এবং আরও কতো পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন সারাজীবনে, তার হিসেব মেলানো যাবে না ।

১৯৭৪ সালে প্রথম ভারতীয় গায়ক হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পারফর্ম করেছিলেন। তার শেষ রেকর্ড করা গান ‘সৌগন্ধ মুঝে ইস মাটি কি’ ৩০ মার্চ ২০১৯-এ প্রকাশিত হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং জাতির প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে।

লতা মঙ্গেশকর জন্মেছিলেন ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে, মধ্য প্রদেশের ইন্দোর জেলায়। বাবা, দীনানাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন মারাঠি কোঙ্কনি শাস্ত্রীয় গায়ক এবং থিয়েটার অভিনেতা। তাঁর মা, শেবন্তী (পরে নাম পরিবর্তন করে শুধামতি) ছিলেন একজন গুজরাটি।  জন্মের সময় লতার নাম রাখা হয়েছিল ‘হেমা’। পরবর্তীতে বাবার একটি নাটকে নারী চরিত্র লতিকার নামানুসারে তার নাম পরিবর্তন করে লতা রাখেন।

লতা ২০২২ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে  8ই জানুয়ারি -এ, মুম্বাইয়ের বীচ ক্যান্ডি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে ভর্তি হন। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ৬ই ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ৯২ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

ধ্রুপদি থেকে রোমান্টিক, গজল কিংবা ভজন গানের প্রতিটি ধারায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ থাকলেও লতা মঙ্গেশকর সবচেয়ে বেশি গেয়েছেন ছায়াছবির গান, বিশেষত হিন্দি ছায়াছবির গান। হিন্দি ছবিতে গাওয়া হাজার হাজার গানের ভেতরে এমন অনেক গান আছে, যা শুধু হিন্দিভাষীদের কাছেই নয়, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল-ভুটান-শ্রীলংকা… সব দেশের মানুষের কাছেই প্রিয়। উপমহাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বছরের পর বছর ধরে বেজেছে লতার হিন্দি গান। বিখ্যাত ‘মুঘল-ই-আজম’ সিনেমায় মধুবালার ঠোঁটে সেই ‘জব পেয়ার কিয়া তো ডর না কিয়া’ গানটি একসময় বাংলার তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফিরতো। বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী ও সুরকার ভূপেন হাজারিকার সুরে ‘দিল হুম হুম করে’- ‘রুদালি’ সিনেমার অনন্য এই গানটি তো আমাদের প্রিয় বাংলা গান ‘মেঘ থম থম করে’র হিন্দি রূপ। বাঙালির মহানায়িকা সূচিত্রা সেন যখন ‘আন্ধি’ নামক হিন্দি ছবিতে লতার গাওয়া ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকওয়া’ গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন, সারা ভারতবাসীর কাছেই তা প্রিয় হয়ে উঠেছে। লতার অজস্র হিন্দি গানের মধ্যে আরও অনেক গানই অসংখ্য মানুষের প্রিয় নিশ্চয়ই, তবু কয়েকটি গানের অধিক পক্ষপাত আছে আমার। যেমন—‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়িঙ্গে’ ছবিতে কাজলের লিপে ‘তুজে দেখা তুনে জানা সনম’, ‘মহব্বতে’ ছবিতে ঐশ্বরিয়ার লিপে ‘হামকো হামিসে চুরালো…’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ সিনেমায় মাধুরী দিক্ষিতের ঠোঁটে ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘আরাধনা’ সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুরের লিপে ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’, ‘পাকিজা’ সিনেমায় মীনা কুমারীর ঠোঁটে ‘চলতে চলতে উন হি কোই…’ ইত্যাদি গানে মুগ্ধতা জমে আছে। হাজার হাজার হিন্দি গানের এই শিল্পীর হিন্দি গান নিয়ে আলোচনা প্রশস্ত করবার আমি উপযুক্ত কেউ নই।

লতা মঙ্গেশকর ও বাংলা গান

লতা মঙ্গেশকরের বাংলা গানের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, ১৮৫; কারো কারো মতে ২০০ টি। বাঙালির পরম সৌভাগ্য যে, লতার সোনালি সময়ে বাংলা গানেরও সোনালি যুগ চলছিল; বাঙালিদেরও ছিলেন কয়েকজন মহান শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার। এবং সেই মহান শিল্পীদের সাথে লতা মঙ্গেশকরেরও ছিলো নিবিড় সম্পর্ক। হিন্দিতে যেমন উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী ও সুরকার শচীন দেব বর্মণের সুরে গান গেয়েছেন, গেয়েছেন তাঁর ছেলে রাহুল দেব বর্মণের সুরে, মহাগায়ক কিশোর কুমারের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন; হিন্দি এবং বাংলা দুটোতেই তেমনি আরেক কিংবদন্তি বাঙালি শিল্পী ও সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের (হিন্দিতে তিনি হেমন্ত কুমার নামে পরিচিত) সুরে ও একসাথে যুগলে গেয়েছেন বেশকিছু অনুপম গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে লতা মঙ্গেশকরের বন্ধুত্বের কথা তো বিখ্যাত হয়ে আছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে’ গানটিই লতার আধুনিক বাংলা গানের প্রথম বেসিক রেকর্ড। বিখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটি বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তো অমরত্ব লাভ করেছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতাকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইয়েছিলেন। ‘মধু গন্ধে ভরা’, ‘তোমার হল শুরু আমার হলো সারা’, ‘তুমি রবে নীরবে’… এসব গান তো দুজনে একসঙ্গে গেয়েছিলেন। এছাড়া বৌ ঠাকুরানী হাট ছবিতে ‘হৃদয় আমার নাচেরে’ এবং ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’ রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটো রেকর্ড করেন লতা।  যারা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কেবল আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে জানেন, তাদের উদ্দেশ্যেই বলি- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন বিখ্যাত স্কলার, পিএইচডি করেছিলেন এই বিষয়ের উপরে। এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতাকে মাঝে মাঝে বাঙালি মেয়েই বলতেন, তাঁর অনন্য বাংলা উচ্চারণ ও বাংলার প্রতি অকৃত্রিম দরদের জন্য। এক সাক্ষাৎকারে লতা নিজেই বলেছেন, রীতিমতো মাষ্টারমশাই রেখে তিনি বাংলা শিখেছিলেন এবং বাংলা সাহিত্যের বইও পড়তেন। ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিতে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁটে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ও যুগলে ‘চঞ্চল মন আনমনা হয় যেই তার ছোঁয়া লাগে’ শুনলে আজও মনে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। ‘মনিহার’ ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠোঁটে লতার ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ গানটিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরই সুর করা। লতার আরও অনেক বিখ্যাত গানে সুর করেছেন হেমন্ত। কলকাতায় এলে লতা অনেক সময়েই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠতেন। হেমন্ত’র সঙ্গে লতার বন্ধুত্বের কাহিনি সঙ্গীতের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

কলকাতার আরেক বিখ্যাত গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরীর সাথেও ছিলো লতার নিখাদ বন্ধুত্ব। সলিল চৌধুরী তাঁর শ্রেষ্ঠ গানগুলো রেখে দিতেন লতা মঙ্গেশকরের জন্যে। লতার জন্যে তাঁর এমনই পক্ষপাতিত্ব ছিলো যে স্ত্রী বেলা চৌধুরী, যিনি নিজেও খ্যাতনামা শিল্পী ছিলেন, তিনি একবার অভিযোগ করে বলেছিলেন, তুমি ভালো ভালো গানগুলো আমাকে না-দিয়ে লতার জন্যে রেখে দাও। সলিল বলেছিলেন, আসলে এই গান শুধু লতাকে ভেবেই লেখা, এবং লতা ভিন্ন আর কারো কণ্ঠে ওটা ঠিকমতো মানাবে না। সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকর জুটির প্রথম গান ‘না যেও না রজনী এখনও বাকি…’ রেকর্ডিং-এর মাত্র ১৫ মিনিট আগে লিখেছিলেন সলিল। আর লতার কণ্ঠে দুর্দান্ত ‘তাঁর চোখের জটিল ভাষা… পা পামাগারেসা…’ গানটি সলিল লিখেছিলেন একটি রেস্টুরেন্টে বসে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটি শুধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নয়, লতা মঙ্গেশকরও গেয়েছেন এবং তা সলিল চৌধুরীর সুরেই। সলিল চৌধুরী ও লতা মঙ্গেশকর জুটির আরও গানের মধ্যে ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো’, ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখো’, ‘যদিও রজনী পোহালো’, ‘ও আমার ময়নাগো’, ‘আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমে’, ‘ও বাঁশি কেন গায়’… ইত্যাদি বাঙালি শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।

‘অনুরাগের ছোঁয়া’ ছবিতে মহুয়া চৌধুরীর ঠোঁটে বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমারের সঙ্গে ডুয়েটে লতার বিখ্যাত গান ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’ শুনলে আজও কণ্ঠ মেলায় বাঙালি। কিশোর কুমারের সঙ্গে আরেক রোমান্টিক ডুয়েট ‘অনুসন্ধান’ সিনেমায় ‘আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ’ গানটিও কম ভালো লাগার নয়। আর ‘শতরূপা’ ছবিতে নায়িকা মোসুমী চ্যাটার্জীর লিপে ‘ফেলে আসা স্মৃতি আমার বেদনা জাগায়’, লতার সুধাকণ্ঠের এই গানটি তো দর্শকের চোখে জল আনে। এই গানটি আরেক কিংবদন্তি সুরকার রাহুল দেব বর্মণের সুরে সৃষ্টি। রাহুল তথা আর. ডি. বর্মণের সুরে অনেক হিন্দি গানের তুলনায় বাংলা কম ছিলো।

লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে আরও কিছু অবিস্মরণীয় বাংলা গান হলো— ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’, ‘যদিও রজনী পোহালো তবুও’, ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না মন’ ‘কোনো কিছু কথা বলো না’, ‘চন্দ্র যে তুই মোর সূর্য যে তুই’, ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’, ‘ওই গাছের পাতায়’, রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’ ইত্যাদি।

লতা মঙ্গেশকর ও বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের ফান্ড গঠনের জন্য এক লক্ষ টাকার চেক লিখে দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর । সেই ১৯৭১ সালে ১ লক্ষ টাকা সাহায্য, ভাবা যায় ! শুধু কি তাই? তাঁর নিজের গাওয়া বেশ কিছু বিখ্যাত গানের রয়্যালটি সেদিন লেখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডের নামে। যতদিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে ততদিন এই সব গান থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ জমা হবে ফান্ডে। এখানেও কিন্তু শেষ নয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনেও অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্লেনে চেপে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করে বাঙালি রিফিউজিদের জন্য লতা তহবিলও সংগ্রহ করেছিলেন এই । সে সময় লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখ শিল্পী বাংলাদেশের জন্য সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা গড়ে তুলতে কাজ করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে লতা মঙ্গেশকর ভারতের একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন।

২০১৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর একটি টুইট বার্তায় লতা মঙ্গেশকর নিজেই ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত অভিনেতা সুনীল দত্তের গ্রুপের সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘Namaskar. 1971 Bangladesh mukti yudh samapt hote hi hum Bangladesh gaye the aur Sunil Dutt ji ke group ke saath humne kaafi karyakram kiye, us waqt hum Army ke plane se hi sab jagah jaate the’.

১৯৭২ সালে মমতাজ আলীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ নামে চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর সুরে ‘ও দাদা ভাই; দাদা ভাই মূর্তি বানাও / নাক মুখ চোখ সবই বানাও / হাতও বানাও,পা-ও বানাও / বুদ্ধ যিশু সবই বানাও, / মন বানাতে পারো কি ?/ একটা ছোট বোন বানাতে পারো কি ?’ শিরোনামের গান গেয়েছিলেন এই কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী। এটিই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গাওয়া লতা মঙ্গেশকরের একমাত্র গান। এভাবেই লতা মঙ্গেশকর বাঙালি না হয়েও বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে রইলেন। অকৃত্রিম বন্ধু।

যে লতা মঙ্গেশকর বাংলা গানকে, ভারতীয় সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন অসাধারণভাবে সেই লতাকে কিন্তু মাত্র ৩৩ বছর বয়সে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল ঈর্ষান্বিত কোনো শত্রুপক্ষ। তখন তিনি খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করছেন। হঠাৎই এক ভোরে তাঁর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে থাকে। এর পরেই সবুজ বমি করতে থাকেন তিনি। আস্তে আস্তে সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতাটুকুও থাকে না । অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। চিকিৎসককে বাড়িতে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এক্স রে থেকে জানা যায়, পাকস্থলীতে বিষ রয়েছে। টানা তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেন লতা। ১০ দিন পরে অবস্থার উন্নতি হয়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে কয়েকমাস লেগে যায়। চিকিৎসক জানান তাঁকে কেউ বিষপ্রয়োগ করে খুন করতে চেয়েছিল। বিষক্রিয়ার প্রভাবে অনেক দিন পর্যন্ত লতা গরম খাবার খেতে পারতেন না। বরফের টুকরো মেশানো তরল খাবার খেতেন তিনি। তাঁর কণ্ঠ চিরতরে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও জন্মেছিল। কে এভাবে তাঁকে বিষপ্রয়োগ করে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে লতার জীবনীকার পদ্মা সচদেব তাঁর ‘লতা মঙ্গেশকার: অ্যায়সা কাঁহা সে লাউঁ’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, লতার রাঁধুনি এর পরেই নাকি পারিশ্রমিক না নিয়ে আচমকা কাজ ছেড়ে চলে যান। এই রাঁধুনি তখন বলিউডের আরও কোনো কোনো শিল্পীর বাসায় রান্না করতেন।

মৃত্যু থেকে ফিরে আসা লতার সেই কণ্ঠ প্রায় ৯০ বছর পর্যন্ত অক্ষতসুন্দর থেকে কোটি কোটি মানুষকে ভাসিয়েছে অতুলনীয় সুরের মূর্ছনায়। তিনি হয়ে উঠেছেন অন্যতম একজন নন, ভারতবর্ষের প্রধানতম কণ্ঠশিল্পী। তাঁর প্রয়াণে  শুধু ভারতের প্রায় দেড়শ’ কোটি মানুষ নন, বিদেশের অসংখ্য সঙ্গীতপ্রেমিরা নত হয়েছেন বিনম্র শ্রদ্ধায়।

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বাংলা গান শোনেন কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মায়াবী কণ্ঠের অনুরণনে মুগ্ধ হননি, এমন বাঙালি কি আছেন ? থাকলে তিনি ঠিক কতটুকু বাঙালি সেটা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। আধুনিক বাংলা গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অনন্য, নারী শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠতম। বিশ শতকে বাঙালিদের শিল্প-সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে যে স্বর্ণযুগ এসেছিল, সেই স্বর্ণযুগের অনবদ্য অলঙ্কার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রে যাকে মহানায়িকা বলা হয়, সেই সুচিত্রার যায়গাটা গানের ক্ষেত্রে বোধকরি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরই প্রাপ্য। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

১৯৩১ সালের ৪ঠা অক্টোবর, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের ঢাকুরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখার্জী (মুখোপাধ্যায়কে সংক্ষেপে মুখার্জী বলে) ভারতীয় রেলের একজন অফিসার ছিলেন।  মায়ের নাম হেমপ্রভা দেবী। তিন ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে সন্ধ্যা ছিলেন কনিষ্ঠতম। ১৯৬৬ সালে কবি শ্যামল গুপ্ত’র সাথে বিয়ে হয় সন্ধ্যার, যিনি নিজেই সন্ধ্যার অনেক গানের রচয়িতা। তাঁদের মেয়ের নাম সৌমি সেনগুপ্ত।

পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন-সহ অনেকের নিকট থেকেই সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তাদের মধ্যে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান ছিলেন প্রধান। তিনি প্রাণভরে আশীর্বাদ করেছিলেন এই প্রিয় ছাত্রীকে। ১৯৪৬ সালে ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন সন্ধ্যা। যদিও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তবুও তাঁর বেশিরভাগ কাজ বাংলা আধুনিক গানে। ১৯৪৮ সালে ‘অঞ্জনগড়’ সিনেমায় প্রথমবার প্লেব্যাক করেন সন্ধ্যা। ১৯৫০ সালে কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব শচীন দেব বর্মণের হাত ধরেই বোম্বে যাত্রা শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। সুরকার অনিল বিশ্বাসের ‘তারানা’ চলচ্চিত্রে একটি গান দিয়ে তিনি মুম্বাইতে হিন্দি গান গাওয়া শুরু করেন। ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে গান করবার পরে নিজের শহরে ফিরে আসেন।

১৯৭১ সালে ‘জয় জয়ন্তী’ এবং ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে যথাক্রমে ‘আমাদের ছুটি ছুটি’ এবং ‘ওরে সকল সোনা মলিন হলো’ গান দুটি গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৫ ও ১৯৭২ সালে দুবারই তাঁর ঝুলিতে এসেছে বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৯ সালে পান ভারত নির্মাণ লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারপ্রাপ্ত হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে ভারত সরকার কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমার দেশ আমাকে যেভাবে ভালবাসে, সেখানে আমার পদ্মশ্রী কিংবা কোনও শ্রীর-ই প্রয়োজন নেই।”

আরও অনেক বড়ো বড়ো মানুষের মতো সন্ধ্যাও করোনার করাল থাবা থেকে রেহাই পাননি। ফুসফুসের সংক্রমণ, হাইপোটেনশন, ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ, মাল্টি অর্গান ডিসফাংশন-এ আক্রান্ত হয়ে এপোলো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় মান্না দে’র কণ্ঠে রেকর্ডকৃত  ‘এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই’ গানটি শুনতে শুনতে ২০২২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মারা যান।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাংলা সিনেমার গান

১২ বছর বয়স থেকে গান গাওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ৭৫ বছর সঙ্গীত জীবনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি ইত্যাদি গাইলেও আধুনিক বাংলা গান ও সিনেমার গানে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।  গানে সন্ধ্যার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিল হেমন্ত মুখার্জীর সাথে, আর সিনেমায় তাঁর গানের শ্রেষ্ঠ লিপ সিঙ্গার ছিলেন বাঙালির প্রিয়তমা নায়িকা সুচিত্রা সেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের  সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, এ-যেন বাঙালির চিরকালীন রোমান্টিকতার শেষ কথা ! কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘সপ্তপদী’ সিনেমায় মোটরবাইকে চেপে উত্তম-সুচিত্রার অতুলনীয় রোমান্টিক দৃশ্যায়নে বিখ্যাত সেই গান, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’, হেমন্ত-সন্ধ্যা সম্মিলনেরও এক অপরূপ নান্দনিকতা; দেখে-শুনে আজকের শিশুটিরও চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এখনও যে-কোনো প্রেমিক তার ভালোবাসার মুহূর্তটিতে আপ্লুত মনে গেয়ে ওঠে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো…’। ‘সবার উপরে’ সিনেমায় সুচিত্রার লিপে অসামান্য দুটি গান আছে সন্ধ্যার। এই সিনেমার কাহিনিটি যেমন অনন্য, তেমনি অসামান্য দৃশ্যায়ন কুশলতাও। ক্লান্ত-অবসন্ন উত্তম কুমার ঘুমিয়ে, সুচিত্রা ধীর পায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে যখন অরূপ বাঁশির মতো গেয়ে ওঠেন ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা / এই মাধবী রাত, আসেনি ত’ বুঝি আর, / জীবনে আমার। / এই চাঁদের তিথিরে বরণ করি, / এই মধুর তিথিরে স্মরণ করি। / ওগো মায়াভরা রাত– / (আর) ওগো মায়াবিনী চাঁদ…’, কয়েক মুহূর্ত পরে নিঃশব্দ পায়ে উত্তম এসে পিছনে দাঁড়ান, তখন সমস্ত অন্তরজুড়ে ভালো লাগার ফল্গুধারা প্রবাহিত হতে থাকে। এই সিনেমাতে সুচিত্রার অশ্রুহৃদয়ে কণ্ঠ মেলানো ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া’ গানটিও চিরকালের ভালো লাগার সন্ধ্যার কীর্তি। ‘পথে হলো দেরী’ ছবিতে উত্তম কুমার সিঁড়ি দিয়ে নামতে না নামতেই যখন সন্ধ্যার কণ্ঠে আর সুচিত্রার ঠোঁটে ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে, আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে’ ধ্বনিত হয়, উত্তমের পা থেমে যায়, সেই সাথে থামে দর্শকেরও সকল হতাশাও। একই ছবিতে ‘এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার…’ এই অবিস্মরণীয় গানটিও-তো সন্ধ্যারই স্বর্ণালি সুরের মূর্ছনায় অমর হয়ে আছে। আর ‘সাগরিকা’ ছবিতে শয্যাশায়ী উত্তমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সন্ধ্যার কণ্ঠে সুর মিলিয়ে সুচিত্রা যখন গেয়ে ওঠেন ‘এই মধুরাত শুধু ফুল পাপিয়ার, এই মায়ারাত শুধু তোমার আমার…’ তখন কী যে ভালো লাগা জাগে? একই ছবিতে ‘পাখি জানে ফুল কেন ফোটে গো, ফুল জানে পাখি কেন গান গায়’ কিংবা ‘এই তো আমার প্রথম ফাগুন বেলা’…এসবও কিন্তু কম নয়।  শুধু কি এগুলো? ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে ‘কে তুমি আমারে ডাকো’, ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর আনে স্বপ্নভরা সম্ভাষণ’; ‘বিপাশা’ ছবিতে ‘আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি মোর নিশিথ বাসর শয্যায়’, ‘শিল্পী’ ছবিতে ‘তুমি যে আমার এ ভূবনে তাই এতো আলো এতো গান’, ‘নূপুরের গুঞ্জনে বনবিথি উতলা ফুলসাজে শ্রীমতি অভিসারে যায়’; ‘ত্রিযামা’ ছবিতে ‘ধূপ চিরদিন গন্ধ ছড়ায়ে যায়’, ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিতে ‘এই যে কাছে ডাকা, এই যে বসে থাকা, বন্ধু জেনো এ খেলা নয়’; ‘একটি রাত’ ছবিতে ‘প্রদীপের শিখা কেন কাঁপে’… ইত্যাদি কতো ছবিতে কতো মধুমাখা গান যে শুনিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তার রেশ রবে চিরকাল। কেবল সুচিত্রার ছবিতে নয়, আরও একাধিক নায়িকার লিপেও সন্ধ্যার গান বাঙালি দর্শককে মুগ্ধ করেছে।

সিনেমার বাইরে সন্ধ্যা

সিনেমার গানের বাইরেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রয়েছে অমর কিছু বাংলা গান। ‘মধুমালতি ডাকে আয়’, ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কী হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না’, ‘হয়ত কিছুই নাহি পাবো তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো’, ‘আর ডেকো না সেই মধু নামে’, ‘কী মিষ্টি দেখ মিষ্টি কী মিষ্টি এ-সকাল’, ‘আমি তার ছলায় ভুলব না কাজ নেই আর আমার ভালোবেসে’, ‘আমি প্রিয়া তুমি প্রিয়’, ‘মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলীতে’, ‘স্বপ্নভরা অন্ধকারে মোর গানের এই বিনা তারে’, ‘খোলা আকাশ কি এতো ভালো লাগতো যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি থাকতো’, ‘পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমারে’… এরকম অজস্র গানের তালিকা তৈরি করা যাবে, যেগুলো শুনতে শুনতে বাঙালি শ্রোতারা গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে প্রাণের আবেগে ধারণ করেছে চিরদিনের মতো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নেন তিনি। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বাংলাদেশের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি উপলক্ষ্যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের  গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় / তুমি আজ ঘরে ঘরে এতো খুশী তাই / কি ভালো তোমাকে বাসি আমরা বলো কি করে বোঝাই’ গানটি শুনলে অশ্রু সংবরণ করা যায় না। আবিদুর রহমানের লেখায় ও সুধীন দাশগুপ্তের সুরের এই হৃদয়স্পর্শী গানটি ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিনে আকাশাবাণী কলকাতা রেডিও থেকে প্রচারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে এর চেয়ে উত্তম অভিবাদন বোধহয় হতেই পারতো না।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির  উদ্‌যাপন উপলক্ষ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে গেয়েছিলেন গান।

স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানাতে ২০২১ সালে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কলকাতায় সন্ধ্যার বাসায় গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে কেঁদেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শুধু পশ্চিম বাংলা ও ভারতের মানুষ নয়, কেঁদেছে বাংলাদেশও। আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে বাংলাদেশের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘উপমহাদেশে গানের মুগ্ধতা ছড়ানোর পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

যাদের সহযোগিতায় লতা-সন্ধ্যা

লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় দুজনই কণ্ঠের যাদুতে কোটি কোটি মানুষকে মোহিত রেখেছেন অনেক অনেক বছর ধরে। কিন্তু তাদের সেই কণ্ঠের যাদুর পিছনে আরও কিছু অসাধারণ মানুষের অসামান্য অবদান ছিলো। অসাধরণ সব গীতিকার, অনন্য সব সুরকারের মেলা বসেছিল সেই সোনালি যুগে। হিন্দিতে গুলজারের মতো অসাধারণ গীতিকবি যেমন তেমনি বাংলাতে মুকুল দত্ত, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রমুখ অসামান্য সব গীতিকার গান লিখেছেন তখন। আর এস ডি বর্মন, আর ডি বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, কিশোর কুমার প্রমুখ অতুলনীয় সব শিল্পী-সুরকারেরা তখন বাংলা, হিন্দি সবখানেই রাজার মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। লতা-সন্ধ্যাদের প্রতিভা বিকাশে এইসব মানুষগুলোর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই লেখার পরিসরে তাদের প্রতিও জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন ও বিনম্র শ্রদ্ধা।

শেষ কথা

যে-যুগ এখন চলছে, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি-রাজনীতি… কোনোখানেই সাধনার বিশেষ বালাই নেই। সবখানে চলছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থে-বিত্তে-প্রতিপত্তিতে উপরে ওঠার লড়াই। কোনোখানেই কোনো সাধক কিংবা সিদ্ধ মানুষের প্রকাশ নেই। পুরানো দিনের সিনেমা, পুরানো দিনের সাহিত্য, পুরানো দিনের রাজনীতি, পুরানো দিনের গান… এখনও আমাদের গর্বের পাথেয়। আরও অনেককিছুর মতো সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই লতা মঙ্গেশকর কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো মহীরুহপ্রতীম শিল্পীর আগমন ঘটবে বলে মনে হয় না। চিরশ্রদ্ধা জানাই ২০২২-এ প্রয়াত এই সুই মহান শিল্পীর প্রতি।

Read Previous

ভ্রমণ অভিজ্ঞতা – টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকাবিলাস

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৩য় সংখ্যা (নভেম্বর-২০২২)

২ Comments

  • তথ্যবহুল পরিনত সমৃদ্ধ লেখা। সুখপাঠ্য। অনেক অজানা তথ্য সামনে এনেছেন। প্রয়াত দুই শিল্পীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক আমার পিয় সহকর্মী কুমার দীপের প্রতি রইলো আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা।

    • পাঠ ও পাঠোত্তর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *