অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ১০, ২০২৫
২৬শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ১০, ২০২৫
২৬শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রহিমা আক্তার মৌ -
ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুন আমাদের অহংকার

নাম: রিজিয়া খাতুন
জন্ম: ১৯৩১ সালের ১৫ জানুয়ারি (নড়াইল জেলার ডুমুরতলা গ্রামে)
মা: জিন্নাতু নেসা
বাবা: নূর জালাল

’৫২ সালে নড়াইলের আন্দোলন সংগ্রাম যা হয়েছে, সেখানে মাতৃভাষার জন্যই অংশগ্রহণ করেছি। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে শরিক হয়েছি। আমাদের সেই আন্দোলন বৃথা যায়নি। আমরা মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছি। এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করলে শেষ বয়সে হয়তো একটু সান্ত্বনা নিয়েই মৃত্যুবরণ করতে পারতাম।’ কথাগুলো নড়াইলের ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুনের।

১৯৩১ সালের ১৫ জানুয়ারি নড়াইল পৌরসভার ডুমুরতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রিজিয়া খাতুন। নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম কৃষকনেতা নূর জালালের মেয়ে রিজিয়া খাতুন, মাতার নাম জিন্নাতু নেসা। তার বাবা নূর জালাল কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় পরিবারে একটা উদার রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান ছিল সবসময়। ভাষা আন্দোলনের সময় রিজিয়া খাতুনের বাবা তেভাগা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই অপরাধে তখন তাকে গ্রেফতর করা হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় রিজিয়া খাতুন তৎকালীন দিলরুবা গার্লস স্কুল বর্তমান নাম নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। ওই সময় চাচা নুরুল আফসারের অনুপ্রেরণায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রিজিয়া।

‘১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন। এ আন্দোলনে গ্রেফতার হন রিজিয়া খাতুনের বাবা নুর জালাল। চাচার অনুপ্রেরণায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন রিজিয়া খাতুন। আন্দোলন শেষে পিতা নুর জালালের মুক্তির জন্যে ১৯৫৪ সালে নড়াইলের ২০ হাজার লোকের একটি জনসভায় পিতা নুর জালালের কারা মুক্তির দাবিতে রিজিয়া বক্তব্য রাখেন’।– (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)

তেভাগা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মালেক উকিল সাহেবের পছন্দে তার বাসায় যশোরের কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) তৎকালীন জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট কমরেড আবদুর রাজ্জাকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রিজিয়া খাতুন। ১৯৬৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ডুমুরতলা প্রাইমারি স্কুল, শহর সরকারি প্রাইমারি স্কুল ও মহিষখোলা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। বর্তমানে তিনি নড়াইল শহরের আলাদাতপুর এলাকায় বসবাস করছেন।

ভাষা আন্দোলনের নারীদের নিয়ে ভাবছি, যেখানে যে তথ্য পাচ্ছি পড়ছি, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করছি। ঠিক সেই সময় জানতে পারি ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুন বর্তমানে নড়াইল শহরের আলাদাতপুর এলাকায় বসবাস করেন। সাথে সাথে আমার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট দিই- ‘নড়াইল শহরের আলাদাতপুর বসবাস করেন বা আশপাশে থাকেন এমন কেউ কি আছেন, থাকলে নক করুন ইনবক্সে’। কিছুক্ষণের মাঝে আমার ফেসবুক আইডিতে থাকা বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি কর্মকর্তা এম হায়দার রেজা জানান, ‘অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুর রউফ মোল্লা আমার বন্ধু, বর্তমানে যশোর থাকলেও তার গ্রামের বাড়ি নড়াইল জেলার বাঁশগ্রামে। আশাকরি আব্দুর রউফ কিছু হলেও তথ্য দিতে পারবে।’

হায়দার ভাই আব্দুর রউফ ভাইয়ের সাথে আমাকে ফেসবুকে যোগাযোগ করিয়ে দেন। আব্দুর রউফ ভাই জানান,
–আমি এখন যশোরে আছি, ৩-৪ দিন পর ওই এলাকায় যাবো।
আমি আব্দুর রউফ ভাইকে অনুরোধ করি, যেভাবে হোক রিজিয়া আপার খোঁজ নিতে। প্রয়োজনে আমার সাথে এক মিনিট কথা বলিয়ে দিতে।

চারদিন পর রউফ ভাই আলাদাতপুর যান, রিজিয়া আপার বাসা খুঁজে বের করেন। আমাকে জানান ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুনের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। উনি কথাও বলতে পারেন না। রিজিয়া আপার ছোট মেয়ে স্বতন্ত্রা বুলবুলের সাথে কথা বলেন। আমি রউফ ভাইকে বলি রিজিয়া আপার মেয়ের মোবাইল নম্বর নিয়ে আসতে, উনি তাই করেন। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার আমি ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুনের ছোট মেয়ে স্বতন্ত্রা বুলবুলের সাথে প্রথম কথা বলি।

বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও শুরুটা ১৯৪৭ সালে জাতিগতভাবে দেশভাগের পরেই শুরু হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) এই আন্দোলন চলমান ছিলো। যার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৫২ সালে, এজন্যেই ১৯৫২ সালকে ভাষা আন্দোলনের সাল আর ২১ ফেব্রুয়ারিকে তারিখ ধরা হয়। জাতিগতভাবে দেশ ভাগ হলেও ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ববাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পূর্ববাংলা নিজেদের ভাষাকে বাংলা চাই বলেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু জনগণের আন্দোলন ভাঙতে ১৪৪ ধারা জারি করলেই আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আর আন্দোলন ছড়িয়ে যায় পুরো পূর্ববাংলায়। আর পূর্ববঙ্গের শহর-গঞ্জে ভাষা আন্দোলনের চাবিকাঠি ছিল স্কুলছাত্রদের হাতে। তারাই ধর্মঘট ও মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। পরে অন্যরা তাতে যোগ দেন। বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের প্রাথমিক পর্বে কলেজের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। ১৯৪৮ সালের মার্চের আন্দোলন সফল করে তুলতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাই এগিয়ে আসে। যথারীতি সভা, সমাবেশ, মিছিল ও স্লোগান নিয়ে। গ্রাম থেকে গ্রামে মহকুমার প্রতিটি মাধ্যমিক স্কুলকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন বেড়ে যায়।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যখন ছাত্রজনতা আন্দোলন শুরু করেন তখন দাবানলের মতো সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি বিভাগ ও জেলায় জেলায়। বাদ যায়নি নড়াইলেও। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আন্দোলনের সঙ্গে নড়াইলেও শুরু হয় ভাষার জন্য আন্দোলন। সেদিনের ভাষার আন্দোলনে যোগ দিতে ছাত্ররা যখন রাস্তায় নামার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানান তখন সবাই বিভিন্ন অজুহাতে অনেকে পালিয়ে গেলেও যে তিনজন নারী একাত্ম ঘোষণা করেন ও মিছিলে যোগ দেন। তারা হচ্ছেন- সুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রুবি। রিজিয়া খাতুন ভাষা আন্দোলনের সময় দিলরুবা গার্লস স্কুল বর্তমান নাম নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। এই ছাত্রী একবারও ভাবেনি ওরা মেয়ে ওদের যাওয়া যাবে না। ছাত্রদের সাথে সমানতালে ওরাও নিজের মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলনে মিলিত হয়। রিজিয়া খাতুন, তাদেরই একজন যিনি ২০২০ সালেও রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি।

‘১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করেন ছাত্র-জনতা। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই। ঢাকার এ আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে নড়াইলেও শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। সেদিন ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য ছাত্রীদের আহ্বান জানালে নড়াইলে মাত্র তিনজন নারী যোগ দেন মিছিলে। তারা হচ্ছেন: সুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রুবি। তাদেরই একজন রিজিয়া খাতুন। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য স্থানীয়ভাবে নানা স্বীকৃতি মিললেও এখনো সরকারিভাবে তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সেদিনই আন্দোলনে যোগ দেয়া ছাত্র-জনতা শহরের তৎকালীন কালিদাস ট্যাংকের পাশে ইট দিয়ে অস্থায়ীভাবে প্রথম শহিদ মিনার তৈরি করেন। শহিদদের উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে মহিষখোলায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে গোপন বৈঠক করতেন তারা। আন্দোলনে সংগঠিত করতেন ছাত্র-জনতাকে। আজও সেদিনের স্মৃতি হাতরে ফেরেন ভাষা সৈনিক রিজিয়া খাতুন।’– (তথ্যসূত্র: দেশ টিভি, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)

নড়াইল জেলার সাংবাদিক উজ্জ্বল রায় এক লেখায় লিখেন,
‘১৯৫২ সালের শুরুর দিকের কথা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল ঢাকা। এর প্রভাব প্রথম দিকে গ্রামাঞ্চলে তেমন না পড়লেও ক্রমেই ছড়িয়ে জেলা শহরগুলোতেও। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত হয় ঢাকার রাজপথ। সেই উত্তাপে এবার ‘আঁচ’ লাগে সারাদেশে। ব্যতিক্রম হয়নি নড়াইলেও। চিত্রানদী পাড়ের এ জেলা শহরের তখন স্কুলপড়ুয়া তরুণী রিজিয়া খাতুন। চাচার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ায় ছিল তাদের অপরাধ। এ কথা শুনে ঠিক থাকতে পারেননি তিনিও। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মিছিলে নামেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন স্কুল পেরিয়ে শহরের রাস্তাতেও। গড়ে তোলেন শহিদ মিনার। শহিদদের স্মরণে ২২ ফেব্রুয়ারি পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন রিজিয়া খাতুনসহ অন্যরা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবই বাঙালির জানা। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটু অজানা! কোথায় যেন একটু জানার বাকি আছেই। যেমনটা হয়তো কেউ জানেনা সেই রিজিয়া খাতুনদের কথা। বইয়ের পাতায় তাদের নাম নেই, সরকারিভাবে নেই কোনো স্বীকৃতি। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেন ছাত্র-জনতা। বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সালাম, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে।’

ভাষা আন্দোলনে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বক্তৃতা করেছেন গণজমায়েতে। নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলে। সহ্য করেছেন পুলিশি নির্যাতন, আত্মগোপনকারীদের আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছেন। এমনও জানা যায়, প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণে গায়ের অলংকার খুলে দিয়েছেন অনেক নারী। অথচ ইতিহাসে নারীদের উপস্থিতির কথা বলা এবং ভাষাসৈনিক নারীদের পূর্ণ তালিকা পাওয়া যায়নি আজও (১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০)। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখায় অগণিত ভাষাসৈনিক একুশে পদক পেলেও ভাষাকন্যারা আজও অবহেলিত রয়ে গেছেন। রিজিয়া খাতুন নিজের জেলায় বিভিন্ন সময় ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পেলেও একুশে পদক পাননি।

নড়াইলের অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার দিলারা বেগম বলেছেন, ‘নড়াইলের ভাষা আন্দোলনে রিজিয়া খাতুনের ভূমিকা অনেক। তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানাই।’

রিজিয়া খাতুনের ছেলে কামাল উদ্দিন রাসেল বলেছেন, ‘মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সময়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং করেছেন। অথচ আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।’

সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন বলেছেন, ‘যে নারীরা সেই সময়ে সাহসের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলো তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি জানাই। নড়াইলে যে মিছিল হয়েছিলো সেখানে রিজিয়া খাতুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর নিকট রিজিয়া খাতুনকে ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি দেয়ার দাবি আমাদের সকলের।’

ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারে নড়াইলের ডিসি আনজুমান আরা বলেছেন, ‘রিজিয়া খাতুনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারে নিয়মনীতি অনুসরণ করে সুযোগ থাকলে অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন। কেননা ’৫২ সালে যারা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেছেন, ‘ভাষা সৈনিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাষা সৈনিকদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে দেখব।’

ভাষা আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সম্পর্কে ভাষা সৈনিক রিজিয়া খাতুন বলেন, ’৫২ সালে নড়াইলের আন্দোলন সংগ্রাম যা হয়েছে, সেখানে মাতৃভাষার জন্যই অংশগ্রহণ করেছি। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে শরিক হয়েছি। আমাদের সেই আন্দোলন বৃথা যায়নি। আমরা মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছি। এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হয় না। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে কোনো কাগজপত্র দেখানো সম্ভব নয়। তখন নড়াইলের মতো একটি মহাকুমায় ক্যামেরা চোখে পড়েনি। তাই কোনো ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।’

এক সাক্ষাৎকারে ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুন জানান, ‘নড়াইল শহরের মহিষখোলা তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন মোক্তারের বাড়িতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। আফসার উদ্দিনের মেয়ে সুফিয়া খাতুন, তার ছেলে সে সময় ছাত্রনেতা শহিদ মিজানুর রহমান দুলু ও সুফিয়া খাতুনসহ অন্যরা বাড়িতে বিভিন্ন সময়ে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন। সেই সব সভা-সমাবেশে আমিও অংশ নিই। ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার কাজ করি, ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে মিছিল-মিটিংয়ে ছিলাম সক্রিয়। আমিসহ ১০-১৫ জন শহরের তৎকালীন কালিদাস ট্যাংক (বর্তমান টাউনক্লাব) এরপাশে প্রথম শহিদ মিনার তৈরি করে পুষ্পমাল্য অর্পণ করি। সরকারিভাবে সম্মান না মিললেও স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।’– (সংগ্রহকৃত)

ভাষা আন্দোলনের নারীদের সম্পর্কে জানার জন্যে বই সংগ্রহ শুরু করি। প্রথমে হাতে পাই সুপা সাদিয়ার লেখা ‘বায়ান্নর ৫২ নারী’ ও বাদল চৌধুরীর লেখা ‘২১মহিয়সী ভাষাসংগ্রামী’ এই দুই বইতে রিজিয়া খাতুনকে নিয়ে কোনো লেখা পাইনি। অনলাইন ও বিভিন্ন পত্রিকায় উনাকে নিয়ে লেখাগুলো পড়তে থাকি। প্রায় সব লেখায় পাই ‘রিজিয়া খাতুনের চার ছেলে ও এক মেয়ে, এক ছেলে মারা গেছে’। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার প্রথম আমার কথা হয় ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুনের ছোট মেয়ে স্বতন্ত্রা বুলবুলের সাথে। সেদিনও তিনি উনাদের চার ভাই ও দুই বোন মোট ছয় ভাই-বোনের কথা বলেন। অনলাইন ও বিভিন্ন পত্রিকায় অন্য তথ্য পেয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ রোজ বুধবার আমাা উনার সাথে কথা বলি। উনাকে বিষয়টা জানালে উনি জানান, ‘আমরা চার ভাই, দুই বোন। ভাইয়েরা হলেন- রোজেন রাজ্জাক, টিটব জামাল, রাসেল কামাল, মোস্তফা মহসিন। বড় বোনের নাম ফিরোজা খাতুন আর আমার নাম স্বতন্ত্রা বুলবুল। বড়ভাই রোজেন রাজ্জাক ২০০৭ সালে মারা যান। টিটব জামাল যশোর মহেশপুর সরকারি কলেজে কর্মরত। রাসেল কামাল নড়াইলে ব্যবসা করেন। মোস্তফা মহসিন দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ জার্মানির পাশে চেক রিপাবলিকে থাকেন। বড় বোন ফিরোজা খাতুন থাকেন ঢাকায় আর আমি মায়ের সাথে নড়াইল আলাদাতপুরের বাসায় থাকি।’

রিজিয়া খাতুনের ছেলে টিটব জামালের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করি। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ উনার সাথে কথা বলি। রিজিয়া খাতুন সম্পর্কে আর গণমাধ্যমে উনার এক বোনের কথা থাকার বিষয়ে জিজ্ঞেস করি, উনি জানান, ‘মা আগে সুস্থ থাকা অবস্থায় অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের সময়ের কথা বলতেন, এখন উনি কথাই বলতে পারেন না। ঠিকভাবে নাড়াচাড়া ও করতে পারেন না। আমরা চার ভাই দুই বোন, এক ভাই মারা গেছেন।’

‘রিজিয়া খাতুনের ছোট মেয়ে স্বতন্ত্রা বুলবুলের প্রথম সাক্ষাৎকার (মোবাইলে) ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ সোমবার। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার (মোবাইলে) ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ বুধবার।’

লেখক: সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

Print Friendly, PDF & Email
রহিমা আক্তার মৌ

Read Previous

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম : নজরুল গবেষক ও শিক্ষাসাধক

Read Next

থ্রিলার জনরা ও একজন ঘোস্ট রাইটার শেখ আবদুল হাকিম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *