
“একজন মানুষের কাছে কতোটুকু ঋণ থাকে মানুষের। থাকে নদীর কাছে সজল পাখির কাছে মাটি আর প্রকৃতির কাছে… …সময় ফেরারি হয়ে যায়, ঋণ থাকে আঁকড়ে সময় একজন মানুষের কাছে সবটুকু ঋণ থাকে মানুষের…”, মানুষ-প্রকৃতি-প্রেম নানাভাবে নানা আর্চনায় উঠে আসে যাঁর কবিতায়- তিনি কবি কাজী রোজী। বাংলাদেশের কবিতার ভুবনে একটি উচ্চারিত নাম।
১৯৪৯ সালে ১৬ই আগস্ট সাতক্ষীরা জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয় কবির। বাবা কাজী শহীদুল ইসলাম এবং মা কাজী বারীর শহীদ- এর সুকন্যা তিনি। “…যেন একটা ছবিঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সেখানে বাতাস ছিল উত্তাল মাতাল খোলা জানালার পথে প্রকৃতির শোভা নান্দনিক ইমেলের দেয়ালগুলোতে ফাগুন রঙের সব প্রজাপতি ফুরফুর আনন্দ নির্ভর চিত্রণ…”। সেই ছোটোবেলা থেকেই প্রকৃতি ও মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন। স্কুলজীবনেই জড়িয়ে পড়েছিলেন এ দেশের মানুষের আন্দোলন ও রাজনীতির সঙ্গে। তার কবিতার প্রতিটি চরণে জড়িয়ে আছে যেন এ দেশের মাটি ও মানুষের কথা। “…শত্রুর ঝংকারে কিভাবে ছিলাম মিশে আমরা দুজন এ বুকে মাইন জ্বেলে কত রাত কাটিয়েছি কত পথ দিয়েছি পাড়ি… … বুলেট বিদ্ধ করে কত হানাদার আমি মেরেছি তখন খেয়েছি ডোবার জল বেতস বনের ফল করেছি আঘাত ওই প্রতিপক্ষের পানে…” -১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সেসময় সেখানে কবিতাও পড়তেন তিনি।
লেখালেখি করছেন অনেক বছর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। গ্রন্থের নাম ছিল- ‘পথ ঘাট মানুষের নাম’ -এই নামেই যেন কবির পরিচয় -এই নামে আমরা চিনতে পারি তার স্বপ্নের জগৎকে। তিনি মানুষের কবি, মানবতার কবি। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে নিজ জাতির গৌরবগাথা, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা, বঞ্চিত নিপীড়িতদের, প্রতিবন্ধীদের কথা। “…সেই দুর্দান্ত ঘরানার লৌহমানব সিদ্ধান্তে অটল যিনি যার পিতৃ-আশীর্বাদ সোনার বাংলার সোনালি আঁশের গৌরব এনে দেবে বাংলার সীমানায় বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। তাঁর দিক দর্শন হোক তোমার আমার আমাদের সকলের …”।
কবি কাজী রোজী নানাভাবে ছন্দের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। স্বরবৃত্ত ছন্দে লিখেছেন, গদ্য কবিতা লিখেছেন, বর্ণনা ও সংলাপ দিয়ে কবিতার ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সাহসী উচ্চারণ- ‘ভাত দিবার পারস না / ভাতার হবার চাস/ কেমন মরদ তুই/ হারামজাদা’ এ ধরনের ব্যতিক্রমী পঙক্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৮২ সালে লা-কোর্টিনা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্যে ১৯৯৭ সালে কবিকে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক প্রদান করা হয়। এছাড়া সুকান্ত সাহিত্য পরিষদ, চয়ন সাহিত্য ক্লাব, আমরা সূর্যমুখী সংগঠন, নাট্যসভা, সাত্তিক নাট্য সম্প্রদায়, নন্দিনী পাঠচক্রসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান কবি কাজী রোজীকে সম্মানিত করেছে। বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য কোলকাতাস্থ মহদিগন্ত ২০০৮ পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। ঐ একই বছর ফরিদপুর থেকে নির্ণয় স্বর্ণপদক পান। কবি অসংখ্য গানও রচনা করেছেন। এছাড়াও আছে ছড়া, গল্প ইত্যাদি। বেতার, টেলিভিশন, মঞ্চের জন্য লিখেছেন নাটক। তাঁর লেখা ‘কুসুম বেত্তান্ত’ ভারতের উড়িষ্যায় সাত্তিক নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চস্থ করেছে। তার লেখা নাটক ‘কুসুম উপাখ্যান’ শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতিতে নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি ২০১৩ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার এবং সাদত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
২০০০ সাল নাগাদ কবির তিনটি গ্রন্থ – ‘পথ ঘাট মানুষের নাম, নষ্ট জোয়ার, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা এবং কিছু অগ্রন্থিত কবিতাসমূহ একসাথে একটি গ্রন্থের মাধ্যমে বের হয়। ‘কাজী রোজীর কবিতা’ নামক ঐ গ্রন্থটিকে নামকরণে উল্লেখ না থাকলেও কাব্যসমগ্র ভেবে নেওয়া যায়। কাজী রোজী মূলত ষাট দশকের কবি। সে সময়কার ছয় দফা, ১১ দফা, উনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, ‘৭৫-এর হত্যাকাণ্ড, পরবর্তীতে ইতিহাস বিকৃতি, স্বৈরশাসন -এই সব অস্থির সময় অতিক্রম করে কবিতাকে ধারাবাহিকভাবে যারা ধারণ করেছেন -তাদেরই একজন কবি কাজী রোজী। তাঁর কাব্যগুণে সমৃদ্ধ অনেক আকর্ষণীয় পঙক্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায়- “…মার্চ এলেই বলি সলতেটা উসকে দাও, দাউদাউ জ্বলে উঠুক একাত্তরের সারাটা শরীর- সবটা সময় প্রতিবিম্বিত হোক মুক্তিযোদ্ধার অর্জিত সুখ জ্বলজ্বলে সুখের আগুনে হাত পেতে শুদ্ধ করি পাতাকার রঙ সবুজ ও লালের কাছে হৃদয় ধরি…”।
কবি কাজী রোজী ২০০০ সালে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তথ্য অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সালে সেখান থেকে একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তিনি এই ২০১৬ সালেও বুকের ভেতর ক্যান্সার ব্যাধিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান সজীব জীবন-যাপনে। তাঁর কবিতার মতো করে বলা যায় -সবুজ মেহেদি পাতার ভেতরে লুকিয়ে আছে লাল রং-এর আরেক জীবন। সেই জীবন কখনোই ছন্দময় নয়। জীবন হচ্ছে গহীন গদ্য। সেই গদ্যকে, সেই গহীনকে খুঁজে পাওয়া যায় কবি কাজী রোজীর লেখায়। তাঁর তাবৎ সাহিত্যকর্মে। কবি কাজী রোজী জাতীয় সংসদ এর মাননীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা সুমী সিকান্দার- বাংলাদেশ বেতারের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
২০১৫ সালে কবির ‘নির্বাচিত কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ও ২০১৬-তে সেটি পুণর্মুদ্রিত হয়। কবি বেশ একটা বড়ো সময় ধরে তাঁর নিজের কবিতার ভুবন গড়েছেন। রাজনৈতিক কবিতার পাশাপাশি প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও কবি আনন্দ-বেদনা-দুঃখবোধকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন। যেমন- “…দারুণ দ্রাক্ষালতা আমাকে ভীষণ নির্জীব করে দিক একদিন সারাদিন আমি শুধু তোমারি হয়ে রবো…”। আবার সামাজিক প্রেক্ষপটে বিশ্লেষণ করলে তাঁকে পাওয়া যায় অতি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। ‘দেশ মাটি মানুষের কণ্ঠস্বর নিয়ে পাঠকের হাত ধরে আলো মিছিলে আমার গন্তব্য সে জন্মাবধিকাল– সেখানে কেবল দুন্দুভি বাজে-হীন স্বার্থান্বেষীদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়….”। অথবা মাতৃভূমিকে ভালোবেসে লিখেছেন- “এক ঝাঁক উড়াল পাখি উড়তে উড়তে উড়তে থামলো এসে এই ব-দ্বীপে… বাঁধলো সুখের নীড় সবুজ পাতার আড়াল করে কেউ কেউ চলে গেল অন্য উড়াল সীমানায়… রইলো যারা স্বজনের প্রীতি নিয়ে করে বসবাস-গড়ে বসতি-ছড়ায় বিস্তার…”।
মা-মাটি-মানুষের কবি কাজী রোজী। মৃত্তিকার সব্যসাচি এই কবি তাঁর লেখনীর নদীটিকে দু-কূলের পলিমাটি ভাসিয়ে বয়ে নিয়ে চলেন বঙ্গপোসাগরের দিকে। তাই সামগ্রিক সত্যে তিনি সেই গিলয়ের সন্ধানি কবি যেখানে সাহিত্যের ভুবনে বয়ে যায় আলোকেরই ঝর্ণাধারা।।