অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেবুননেসা হেলেন

১। স্মৃতির তর্পণ …জেবুননেসা হেলেন

ছাদে ছাদে সেকালে অনেক কোলাহল। বল বউচি আর ক্রিকেট খেলার মিনারেল ধুম। বিকেল মেলানো সন্ধ্যা অস্তরাগে। চিমনির আলো কাচঘষা প্রদীপ জ্বলতো তখন এক দুই তিন… ক’ঘর বসতি! কত আর হবে? গোটা তিন-চার। এখন সেখানে সহস্রজনের বাসা বাড়িঘর। ঘুমভাঙা ভোর, পাখির কাকলি! শিউলি বকুল ফুলের মালা, যার যেমন ইচ্ছে গড়ত দু’বেলা। আলাভোলা মন মাঠে আর বনে ছুটতো যেমন যখন খুশি। বাসি ফুল শুকে নাকের ডগায় মাখতো রেণু রূপসী। ঘুড়ি আর নাটাই সব ঘরে ছিলো। বড় ছোট নেই, সবাই একসুতোয় বোনা তাঁতের মতোই। রঙতুলিহীন ক্যানভাস যেন আমাদের সে পাড়া-গড়া হতো গুরুভক্তির মাথানত করা। আমি আর সে সই যদি হই। তার ভাই আর আমার ভাই, ভাই-ভাই নয়! বন্ধুও হতো। কত কত কথার রূপকথা। আর ছিলো কদমফুলের কেশর দিয়ে ভাত-পোলাও আর প্যাপরোমিয়ার রেণুর ছালুন! আর নয় আজ। এটুকুই থাক। আর কোনোদিন টিলো এক্সপ্রেস অথবা ঘুড়ি উৎসব অথবা মাছের পোণায় জোলাভাতি হবে। তবু জেনো, কত কথা রবে বাকি; সাকি আজ আমি থাকি, তুমি থাকো আসরের কলম। মুখবন্ধে একক সানাই। আমার রাধের একজন কানাই…
সেই সব দিনে, ভোরের শীতল হাওয়া এসে আমাদের মুখে চোখে অন্য এক স্নেহের পরশ বুলিয়ে চলে যেতো অন্য ঠিকানায়।

এসব স্মৃতি খুঁজতে গত বছর বান্ধবী Shogufta Reza (রেহানা)কে সঙ্গী করে মাস্টারবাড়ি গিয়েছিলাম। সাঈদ ভাই বাবার আন্ডারে চাকরি করতেন। উনার বাড়িতে ঘুরে এলাম। বাস থেকে নামার পর দূর থেকে দেখতে পেলাম সেই সব কোয়ার্টারের প্রেত অবয়ব।

শুনতে পেলাম, এখন আর ওখানে কেউ থাকে না। কিছু বনের পশুপাখি আর সাপ-বেজি, কুকুর-বেড়াল এসব বাড়িঘরে বসবাস করে। নানাজাতের গাছ তাদের সবুজ পল্লবে ঢেকে রেখেছে স্নেহশীল পিতামাতার মতোই আমাদের স্মৃতির সে তল্লাট। ছায়া দিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব বৈভবে।

আজ (৮/৯/১৯) বাবার মৃত্যু দিনে সেসব কালশিটে পড়া স্মৃতিগুলো ভোরের হাওয়ার মতো মিষ্টি ভাব নিয়ে এসে চোখ মুখ ঝাপসা করে দিচ্ছে…

২। স্মৃতির মিঠাই …জেবুননেসা হেলেন

গলির মোড়ে বেশকিছু বেঢপ কাঁঠাল গাছের সারি। মুচি পেড়ে, তেঁতুল, কাঁচালঙ্কা আর চিনি সহযোগে কখনও শিলনোড়ায় বেটে কখনও বটিতে কুচি কুচি করে মেখে খেতে খেতে ফুল টোকা বা বউচি খেলার প্রস্তুতি হতো। তখনও ইয়াম্মি বলা শিখিনি। টক-ঝাল-মিষ্টির স্বাদ নিতে নিতে টাকুরটুকুর আওয়াজ তুলতাম জিভ আর তলুর তবলায়। সে সময় এতো বাড়ন ছিলো না বিকেলে সদ্য কিশোরী হওয়া আমাদের মাঠের মধ্যে খেলার আসর জমানো। শুধু সন্ধ্যা হাওয়া ছুটে আসার আগেই ধুলোবালি মাখা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে ঘরের হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসার তাড়া থাকতো। চটজলদি চিমনি মুছতে গিয়ে কেটে যেতো দু’একদিন হাতের আঙুল। এখনকার মতো এতো ওষুধ দ্রুত জোগাড় করা যেতো না। গাঁদাফুলের বিটপ থেকে পাতা তুলে ঢলে দিলেই ব্যথা রক্তঝরা কমে যেতো। আর গাঁদাফুল গাছ না পেলে দূর্বাঘাসেই চলতো। দূর্বা তুলতে গিয়ে কখনও কখনও কেঁচোর মাটিকর্ষণে সাপ ভেবে ভয় পেলেও দাদি-নানির মুখে গল্পে শোনা সাপের মণি খুঁজতে কতইনা হাতড়েছি মাটির বুক! সুখ ছিলো পরাণের গহীনে। আর ছিলো সুখ পাবার আশার বিলাসী স্বপ্ন। সেই গলি এখন শানবাঁধানো পথ। পথে পথে কত নিষেধের বেড়াজাল। এটা করবি না, ওটা করবি না’র মোহজাল। বৃদ্ধদের প্রতি যে ভক্তির আরতি তা সময়ের গর্ভে দিয়েছে সবে আত্মাহুতি। কিশোর-কিশোরী কারোই আর নিরাপদ জনপদ নেই। নেই শিশুর খেলার মাঠ। শুদ্ধ মিঠাজলের কুয়োতলা কুঁজ ঘড়া কলসি সবই বাসি। এখন বুড়িগঙ্গা দূষিত জলাধার। বাসি ভাতে পান্তা মুড়ি ঝোল মরিচের বিহানের খাদ্য অভ্যাস গল্পের সুড়সুড়ি। একবার প্রথম হাওয়াই মিঠাই মুখে পুড়তেই মিলিয়ে যাবার ফলে চোখ ভিজে উঠেছিলো জলে। চিলিস আর পিজ্জা পাস্তার ঝালে কারো কারো হয়তো এখন চোখ ওঠে কপালে। কিন্তু বাংলার পিঠে আর রসালো ফলে ফুলে মাঠের সবুজের সেই ইচ্ছে পূরণ কি মেলে? আলু তোলার মওসুমে চুলার মধ্যে ফেলে ঝলসে খাওয়ার স্বাদ কি ফ্রান্সফ্রাইয়ে মেলে? আমি হয়তো আদিবাসী প্রাণ… আমার মায়ের ঘ্রাণই আমার জান মেনে তো নিয়েছি সবই, তবু কিছু কিছু বোধ মানতে পারিনি আজও। যেমন পারি না মানতে অবহেলা আর আঁতে ঘা লাগা সভ্যতা। অতীত মিঠাই চাবাই যখন থাকি একা। হয়তো আমি আধুনিক এক বোকা। গ্রীষ্ম আসার আগেই কাঁচা আম আর মুচির ভর্তার কথা খুব মনে পড়ে… (এরপর আবার একদিন অন্য গল্প হবে। তোমার আমার গল্প কি ফুরোবে!)

৩। স্মৃতি বিতরণ…জেবুননেসা হেলেন

বাবা! এই শব্দটিতে এখন আর সেই ভাবে কাউকে ডাকা হয় না। মাঝেমধ্যে ছেলেকে বাবাই ডাকি। মনে পড়ে বাবার সামনে একদিন ছেলেকে বাবা ডাকায় বাবা খুব শিশুসুলভ অভিমান নিয়ে বলেছিলেন, -কি রে আমি থাকতে তুই তোর ছেলেকে বাবা ডাকছিস! তখন বাবা আমার বাসায় এলে খুব সাবধানে থাকতাম। ছেলেকে সত্যি সত্যি বাবার সামনে আর বাবা ডাকতাম না। কাকডাকা ভোর। অবশ্য সে তল্লাটে তখন কাক ছিলো না। অনেক জানা না জানা পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ছিলো। বাবা-মায়ের পাশের রুমে আমি আর আমারই বয়সী কর্মসহযোগী খায়রুনসহ থাকতাম। সেই ভোরবেলায় আমার পাঁচ বছরের বোন Kaniz Fatema (সুমি) ও তিন বছরের বোন Afruza Begum (সুইটি)কে ডেকে তুলে বাবা প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন। ঘুম ঘুম চোখে মুখ ধুয়ে, একই রকম কাপড়ের ড্রেসে তিন বোনকে খালি পায়ে হাঁটতে বের করতেন তিনি। সুরকীর পথ। কিছুটা এ পথে যেতে হতো। পায়ে খুব ব্যথা হতো। সমনেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড। এখন যেমন খুব গাড়ি চলে তখন এতো গাড়ি ছিলো না। সেসব ১৯৮০-১৯৮১ সালের কথা। M.j. Kabir Tipu (টিপু) তখন কুমিল্লাতে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলে পড়ে। হোস্টেলে থাকে। ছোটভাই Hasan Mahmud (টিটু) তখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি। সেই সব ভোরে, বাবার দুই হাত ধরা ছোট দুই বোন। আমি পেছনে। কিছু দূর হাঁটার পর বাবা অফিসঘরের সামনের ঘাসের মাঠে ওদের ছেড়ে দিতেন। বলতেন, -সকালে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ওই সময় বাবার মুড থাকতো অন্যরকম ভালো। ঘাসের ডগায় লেগে থাকা শিশিরে পা ভিজে যেতো। সূর্য উঠতে থাকতো তার নরম লাল রঙ নিয়ে। ছড়িয়ে পড়ত দিগন্তের এ-মাথা ও-মাথায়। বাবার ধারণা ছিলো, সকালের শিশিরে ঘাসের ওপর হাঁটলে অনেক অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এসময় তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের গল্প বলতেন, গোপালভাঁড়ের গল্প বলতেন, কখনও কখনও নদীভাঙনের গল্প বলতেন আর গ্রামগুলো কীভাবে সরে সরে নতুন চরে নতুন বসত গড়ে তুলতো, কত হাসিকান্না জড়ানো সেসব তীরবর্তী জীবন, সেসব গল্প বলতেন। তখন হয়তো আজকের আমারই মত বাবার মনটা বিষণ্ন হয়ে যেতো। তখনও বিষণ্নতা কি বুঝিনি। তাই বাবার সেসব গল্পে কখনও মনোযোগ থাকতো। কখনও পাখি, ফুল, প্রজাপতি বা ফড়িং দেখতে দেখতে অমনোযোগী হয়ে যেতাম। বাবা তখন ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের ইনচার্জে ছিলেন। পার্কের অদূরবর্তী মাস্টারবাড়ির কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। তিন মাইল দূরের সালনা নাসিরুদ্দিন মেমোরিয়াল হাইস্কুলে পড়তাম। সেই সব দিনে, ভোরের শীতল হাওয়া এসে আমাদের মুখে চোখে অন্য এক স্নেহের পরশ বুলিয়ে চলে যেতো অন্য ঠিকানায়। এসব স্মৃতি খুঁজতে গত বছর বান্ধবী Shogufta Reza ( রেহানা)কে সঙ্গী করে মাস্টারবাড়ি গিয়েছিলাম। সাঈদভাই বাবার আন্ডারে চাকরি করতেন। উনার বাড়িতে ঘুরে এলা।

৪। নিজস্ব গদ্য …জেবুননেসা হেলেন

তখনও আমাদের বোধ বৃক্ষ হয়ে ওঠেনি। কঁচি ডগায় আলো পড়ে সবে বেড়ে উঠছে লাউডগা আরোহী। টিনের চালে বৃষ্টির জলপড়া শব্দে জলের ওপর জলের ধারার ধারাপাত বুঝিনি। যা এখন বৈভবের আয়না। এই এখন যেখানে ইমারতে শুয়ে বসে লিখছি ঠিক পাশেই মাটির ঘরে টিনের ছাউনি। তাতেই বৃষ্টি এলে রিম ঝিম ঝিম নূপুর নিক্কণ। উফ! উঠোন জুড়ে সুরের ছোঁয়া গা ধুয়ে দিতো নতুন হাওয়া। কতইবা বয়স! তের কিংবা চৌদ্দ পেরোলো। বেড়ালের নাম, বইয়ের ভাষার পুষিই ছিলো। সারাদিন ভর মিঁউ মিঁউ ডাক। বাড়ির দু’ভাগ- অন্দরমহল, বাহির জগৎ। গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা। রাতের ফুল হাসনাহেনা। দিনভর সব পাখির কোলাহল, দোয়েল, টিয়া, শালিক, চড়ুই, কাক আর ছোট্ট টুনটুনিটার কিচিরমিচির। ঝুঁটিওয়ালা মুরগিটা ডিম পেরে জানান দিতো। মৌমাছিরা ঘরের আড়ে বুনতো বাসা। আমের ডালেও মধুর চাক। আর ছিলো, ভোর না হতেই মুরব্বিদের হাঁকডাক। প্রতিদিন পাতে নিতে হতো লালশাক। শীতের রাতে হারিকেন জ্বেলে উঠোনে, আয়োজনে কাহিলছিয়ায় চালের গুঁড়ি কুটে পিঠে পুলি স্বাদ। ছিলো অনেক ফলের সুবাস। আম, কাঁঠাল, জামরুল, কদবেল, পেয়ারা, আতা, গোলাপজাম আর কামরাঙা! কলমকাটা গাছগুলোতে ফলন ছিলো বেশ ভালো। কাঠের চেরাই কলের শব্দ ছিলো। একটা দুটো বিরাট মাঠও ছিলো। খেলার সময় জুটতো সবে, ছিবুড়ি, কানামাছি, গোল্লাছুটের নানান বায়নায়। সাতচারা আর ফুলটোকাতে লাগতো লড়াই। ডানগুটিতে আর দাড়িয়াবান্ধায় আরেকপ্রস্থ ঝগড়াঝাটি। আড়ির চল খুব যে ছিলো, ভাবের বেলায় গালফুলা ভাব। আর যে ছিলো অনেক বেলার অনেক কথা। রাত পোহালে স্বপ্ন ভাঙা। চালচলনে ছিলো বিনয়। আর কি ছিলো? সন্ধ্যাবেলা পড়ার টেবিল। বুকভরা সবার আদর, ডাকার মধ্যেই মায়ার কদর। আর কি ছিলো? একটা রঙিন স্বপ্ন ছিলো। বড় হবার সাধ ছিলো। আরো ছিলো আরোর মাঝে পরিচ্ছন্ন এক ভাব ছিলো। আরো আরো আরো ছিলো… (অন্য কোনোদিন)

+ posts

Read Previous

কবিতা অন্ত প্রাণ অমিতাভ মীর

Read Next

৮ জনের হাতে তুলে দেওয়া হলো চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *