অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাজল মাহমুদ -
কবিতা অন্ত প্রাণ অমিতাভ মীর

প্রকৃত নাম মীর মোমিন-উল হক গোলাপ হলেও সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ‘অমিতাভ মীর’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন। ঢাকার মতিঝিলে বাবা মীর আবুল হোসেন ও মা সালেহা খাতুনের ঘরে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

জন্মসূত্রে বাংলাদেশী হলেও নিজেকে বিশ্বনাগরিক হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন। তাঁর বিশ্বাসে মনুষ্যত্বই মানুষের একমাত্র পরিচয়। এমত বোধে তিনি ধর্ম-বর্ণ ও ভাষাগত সকল বিভেদের ঊর্ধ্বে নিজেকে একজন প্রাকৃতিক মানুষ হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসতেন।

রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন শেষে তিনি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানি পেশার মতো আবেগহীন চক্রবুহ্যের মধ্যে থেকেও সাহিত্যের প্রতি আশৈশব অনুরাগে ঘাটতি পড়েনি কখনও। গার্মেন্টস ব্যবসায় সফলতা না আসায় তিনি ক’বছর আগে ফিরে আসেন পৈতৃক নিবাস চুয়াডাঙ্গা শহরে। কবিতার প্রতি অনুরাগ থেকেই বাড়ির নাম রাখেন ‘কবিকুঞ্জ’। বাড়ি সংস্কারসহ দ্বিতলভবন নির্মাণকাজ করতে যেয়েই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে কর্কট রোগের স্বল্পকালীন চিকিৎসায় তিনি গত ২২ নভেম্বর ২০২১ খ্রি. তারিখে পারলৌকিক মুক্তির পথে যাত্রা করেন। ‘কবিকুঞ্জ’কে তিনি সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন প্রকৃতিলগ্ন করে। শিক্ষা ও জ্ঞানের শাখায় যা কিছু অর্জন তার পেছনে প্রতিষ্ঠানের চাইতে প্রকৃতির অবদান অনেক বেশি বলে তিনি মনে করতেন। আর তাই, ‘প্রকৃতির একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে প্রকৃতির কাছ থেকে জ্ঞানার্জনের নিরন্তর প্রচেষ্টা’য় আমৃত্যু কাব্যচর্চার পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ধরনের বৃক্ষ-পরিচর্যায় যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে প্রকৃতিলব্ধ জ্ঞানে তিনি অন্যদেরও ঋদ্ধ করেছেন আলাপচারিতায়, আড্ডায়, তর্কে-বিতর্কে ও লেখায়।

লেখালেখি শুরু তাঁর ১৯৭৮ সালে কলেজ জীবনের শুরু থেকেই। লিখেছেন প্রচুর। তাৎক্ষণিকভাবেও লিখতে পারতেন। কাব্যশৈলীতে ছন্দ এবং মাত্রা নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। ফলে বেশ কিছু ছড়া এবং সনেটও লিখেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য বিষয়ক অনলাইন গ্রুপ, সাইট, পেইজ, ব্লগ, ফেইসবুক ও অনলাইন পত্রিকায় তাঁর অনেক লেখা চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়াও দুই বাংলার স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকা, সাময়িকী, সাহিত্য বিষয়ক সংকলনে যতটা প্রকাশ হয়েছে তাঁর লেখা, ততোধিক লেখা অগোচরে অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন থেকে প্রাপ্ত বেশকিছু সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগের তারামা হলে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি. তারিখে ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ’ কর্তৃক আয়োজিত ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবর্ষ উদযাপন’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কবি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্মৃতি সম্মাননা পদক’, ‘তির্যক যশোর’ সাহিত্য পদক ও ‘বাঁকড়ার আলো’ সাহিত্য পদকপ্রাপ্তি।

বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘ইচ্ছের কাছাকাছি’, ‘দিগন্ত রেখা’, ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘সপ্তর্ষি’, ‘৯ দশে ৯০’, ‘চতুরঙ্গ’ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘কবিতা কৌমুদী’, ‘কাব্যতরী’সহ নানা কাব্য সংকলনের ভিড়ে কবির একক কাব্যগ্রন্থ ‘রুদ্রবীণা’ (ফেব্রুয়ারি, ২০২০) ও ‘বসন্ত বাতাস’ (জানুয়ারি, ২০২১)। স্বরচিত ‘আগুনের বৃষ্টি’ (সনেটগুচ্ছ)সহ ‘বৃষ্টি যখন নামলো’ কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ ‘দিনলিপি’ ও উপন্যাস ‘নীলাঞ্জনা’ অচিরেই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। অন্যের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর আগ্রহ ছিলো। ডা. আবুবকর সিদ্দিকের ‘আত্মরক্ষার নখর’ এবং বন্ধু আব্দুস সালাম দৌলতীর ‘বলবে কথা বলবে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে তাঁর উদ্যোগ স্মরণীয়। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় দুই বাংলার ১৪ জন কবির ১৩৩টি কবিতা নিয়ে কাব্য-সংকলন ‘লকডাউন’ (মার্চ, ২০২১) সকলের দৃষ্টি কেড়েছে।  ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন এর কয়েকটি সংখ্যায় অমিতাভ মীরের গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে তিনি প্রগতিবাদী না হলেও নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করতেন। নানারকম স্ববিরোধিতা থাকলেও নিজেকে দ্রোহপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচয় দিতেন। সমাজ ও রাজনীতির নানা অসঙ্গতি ছিলো তাঁর কবিতার উপজীব্য বিষয়। লেখনীতে এসব অসঙ্গতি উপস্থাপনা তাঁর ভিন্ন স্টাইল ও বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে।

চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। নবনির্বাচিত কমিটিতে এই প্রথমবারের মতো সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেবা পাবার আগেই তাঁর চিরপ্রস্থান অকালপ্রয়াণ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

Read Previous

চোখের আলোয় দেখেছিলেম

Read Next

জেবুননেসা হেলেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *