প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা
কবির নিজের ইংরেজী অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ: গাজী সাইফুল ইসলাম
কবি লায়েক শের আলি (Layeq Sher Ali Or Loiq Sher-Ali) তাজিকিস্তানের (Tajikistan) প্রখ্যাত কবি, তবে শিরালি (Shir Ali ev Shirali) নামে সমধিক পরিচিত। বিশ শতাব্দির পার্সিয়ান বিষয়ের তাত্ত্বিক এবং মধ্য এশিয়া ও তাজিকিস্তানের বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যক্তিত্ব তিনি। জন্ম ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে, তাজিকিস্তানের ছোট্ট গ্রাম মাজার-ই-শরীফে (এটি আফগানিস্তানের চার বৃহত্তর শহরের একটি নয়)। এটি তাজিকিস্তানের পাঞ্জাকেন্ট জেলার সুঘাট এলাকায় অবস্থিত। মূলত স্বদেশী কবি আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ রুদাকি দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এছাড়া তাঁর ওপর বিশেষ প্রভাব রয়েছে ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম ও জালালুদ্দিন রুমির। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্র। সচরাচর মনে করা হয় তিনি একজন আনন্দোৎফুল্লতার কবি। দুঃখ ও অশ্রুর দেখা তার কবিতায় কদাচ দেখা যায়। তিনি বহু তাজিক মাস্টারপিস পার্সিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯৯৪ সালে তাঁর নির্বাচিত কবিতা এবং ১৯৯৯ সালে তাঁর রাখ’স স্পিরিট ইরান থেকে প্রকাশিত হয়।
কবি লায়েক শের আলির নাম আমি প্রথম পাই ইরানে নির্বাসিত প্রখ্যাত তাজিক বুদ্ধিজীবী মির্জা শাকুরজাদার(Mirzo Shakurzoda) তেহরান নিউজকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি তাঁর ‘তাজিকস অন দ্য পাথ অব হিস্ট্রি’ বইয়ে লিখেছেন: যুদ্ধ কোনো জাতিকে ঠেলে দেয় উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায়, কোনটিকে আবার মুছে দেয় পৃথিবীর আলো থেকে। তাজিকিস্তানও এমন একটি প্রায় মুছে যাওয়া দেশ ও সভ্যতা। যদিও মানব সভ্যতার ইতিহাসে তাজিকিস্তানের রয়েছে গৌরবদীপ্ত সুখ্যাতি। জাতি হিসেবে তাজিকিরা অনন্যসৃজনশীল এবং অনুসন্ধিৎসু। প্রাচ্য সভ্যতার ভিত্তি তাদের দ্বারাই স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো প্রথম সোভিয়েতের কেন্দ্রীয় শাসক ‘আলেসামান ডাইনেস্টি’-এর সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে যুদ্ধে তাজিকিস্তানের পতন ঘটে। আর তখনই চীনা যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাজিকিস্তানে আসে, যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ডবিখণ্ড না হওয়া পর্যন্ত সেখানে বিক্ষিপ্ত জীবনযাপন করে। আর তাদেরই কূটচালে তাজিকিস্তান ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সর্বদা তাদের যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। এর পরের বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ যা প্যাভলবের লেখা ‘রিলেটেড ফ্রম দি হিস্ট্রি অব তুর্কিস্তান’ বইয়ে বর্ণিত হয়েছে। প্যাভলবকে বলা হয় ‘দি রাশান কনকোয়ারার’। তিনি টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরির তাজিকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন: ‘‘আমরা এখন সাক্ষ্য দিচ্ছি, কষ্টসহিষ্ণু, ন্যায়পরায়ণ এবং মেধাসম্পন্ন তাজিক জাতিটির পুনঃঅভ্যুদয়ের। তারা এখন বড় কষ্টকর জীবন-যাপন করছে। তাদের দারিদ্র্য আর দুর্বলতার মূল কারণ তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত। এর জন্য দায়ী চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং এবং উজবেক শিবানি সম্প্রদায়ের নেতা মেঙ্গিস (Mangheish)।
যুদ্ধবিধ্বস্ত তাজিকিস্তানের দুর্দশার চিত্র সেখানকার বহু কবির লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। আজ আমরা এখানে শের আলির কবিতার অনুবাদ তুলে ধরব। তাঁর সুপরিচিত একটি কবিতার অংশ নিম্নরূপ:
“আনন্দের সঙ্গে নিজেকে আমি উৎসর্গ করতে পারি
ও আমার শবাচ্ছাদন বস্ত্র ঢাকা স্বদেশ
তুমি ছিলে আমার সম্মানের ঘর
এখন হয়ে গেছ মৃত্যুপুরি…।
এখন চারপাশে ভাসমান ফেনা তোমার
বিদেশে কিংবা স্বদেশে কোথাও কেউ নেই
যে শত্রুকে পরাজিত করতে পারে…
আমরা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছি
ঘোড়াদের লেজ অনুসরণ করে
হারিয়েছিও সব…
এমনকি উপত্যকায় এবং সমতলে।’
কবি ‘লায়েক শের আলি’র কবিতা বুঝতে হলে যুদ্ধবিধ্বস্ত তাজিকিস্তানের জীবন বাস্তবতার চিত্রটি মাথায় রাখতে হবে। যেমন:
“একবার আপনি বলেছেন: ‘তুমি একজন ইরানী, এরপর বলেছেন: ‘তুমি একজন তাজিক’
হয়তো সেও মরবে মূল থেকে বিচ্যুত হয়েই, যে আমাদের করেছে বিচ্যুৎ।’’
২০০১ সালে তার সম্পূর্ণ রচনাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে সিরিলিক ও ফার্স স্ক্রিপ্টে। মূল তাজিকি থেকে ইংরেজি অনুবাদগুলো করেছেন কবি লায়েক শের আলি নিজে।
লায়েক শের আলি’র কবিতা-
যদি তুমি
যদি তুমি আমায় হাসাতে না পারো, কাঁদিও না
সাহায্য করতে না পারো, আঘাত করো না
যদি তুমি আমায় সুখী করতে না পারো, দুঃখের কথা স্মরণ করিয়ে দিও না
যদি আনন্দ দিতে না পারো, চোখে অশ্রু ঝরিও না।
জীবনের চতুর্কোণ থেকে জীবনের পথে
যদি রক্ষাকারী হতে না পারো, আক্রমণকারী হইয়ো না
যদি বেসামাল না হয়ে থাক, হতে চেষ্টা করো না।
ভণ্ডামি আর প্রতারণা দিয়ে, আমায় বোকা বানানোর চেষ্টা করো না।
তোমার শরীরে কোনোই বেদনা থাকে না যখন যখন ভালোবাসো
যদি ভালোবাসতে না পারো অন্যকে উপহাস করো না।
তোমার দু’হাত খালি বলে, আমার হাতও খালি করো না
তুমি পৃথিবী দেখোনি, আমার কাছে পৃথিবীর শপথ করো না
তুমি সাগর দেখোনি, ঝড়ের জন্য আমায় তৃষ্ণার্ত করো না।
ওহ নির্বাক বৃক্ষ
ওহ নির্বাক বৃক্ষ
তুমি নিজেই তো কুঠারটিকে একটি হাতল দিয়েছ
যাতে সে তোমার মূল কাটতে পারে।
সে তোমার ছায়াতে বিশ্রাম নেয়
এবং এরপর আবার তোমায় গোড়া কাটে
এটা পৃথিবীর কেমন নিয়ম?
ফাঁসিরকাষ্ঠ তৈরি হয় তোমার কাঠ থেকে
শবাধার তৈরি হয় তোমার কাঠ থেকে
ওহ নির্বাক বৃক্ষ
পাতারা কি তোমার জিহ্বা নয়?
কী তোমার পরিচয়
যতদিন তুমি পাহাড়ে কিংবা উপত্যকায় নিরাপদে থাকবে
মাথা আর হাতের একটা যাযাবর বোঝা ছাড়া
কী পরিচয় তোমার?
একটি শহর, নৌকো বা গোসলখানা
কিংবা কোনো পুরস্কার কিছুই পেলে না–
দরবেশের জীবনে বাঁচলে শুধু লুকিয়ে গুহা-অরণ্যে।
মায়ের স্তনের পর সমরখন্দ বুখারা থেকেও সরেছ দূরে
হায়, কোথায় তোমার প্রিয় বাস্তুভিটে?
কুৎসিতমুখো বর্বরদের পাথরের লক্ষ্যবস্তু তুমি
পাহাড়ের কাঁটাওয়ালা ঝোঁপের লক্ষ্যবস্তু তুমি
সংকীর্ণ হৃদয় পৃথিবীর চোখ দেখছে না
হৃদয়ের বন্ধনহীন বুদ্বুদ তোমার।
তবু উন্নত মনোভূমিতেই তুমি বিচরণ করছ আজও।
কতবার ওরা কেটে দিয়েছে তোমার কণ্ঠ, তোমার পা
তবু উচ্চারণ কত স্পষ্ট তোমার, পা দু’টিও অগ্রসরমান
এবং যদি অর্ধমৃত থেকে থাক। উঠে দাঁড়াও।
আমি শুনাচ্ছি তোমায় রুদাকির কবিতা এবং মিনার ভার্স
এর পরও যদি তোমার শরীর এবং বিশ্বাস শুদ্ধ থাকে
ধন্যবাদ দেব হাফিজ আর রুমির কবিতাকে।”
গাজী সাইফুল ইসলাম
গ্রামাউচ অফিস, ফুলপুর
ময়মনসিংহ-২২৫০।