অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ৫, ২০২৫
২১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ৫, ২০২৫
২১শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাদিক আল আমিন -
সাদিক আল আমিনের গুচ্ছ কবিতা

সংবিগ্ন মেঘ ও কাশফুল সংশ্লিষ্ট

এই রুদ্ধশ্বাস সংবিগ্ন মেঘেদের গর্জন থেমে গেলেই কি শুভ্র মলিন হয়ে আসে দিন?
যেমন আর না ছোঁয়া শরতের শাদা পেখমের মতো অচিরেই গ্রাস করে বসে কাশফুল!
তেমনি আমার কুহুদল ডানাভাঙা পাখি ইচ্ছের বিপরীতে ডানা ঝাঁপটায়
নীলচে রঙ যে নদীর, তার সবুজ দুঃখের বিন্যাসগুলো মেপে মেপে গড়ে তুলতে অজস্রতা
হয় কি কখনো হৃদয়ের থেকেও গভীর এবং নির্মোহ কোনো আবেগ?
এইসব দিনযাপন অন্ততপক্ষে হাজার বছরের ফেলে আসা নির্জন আমিত্বের বহিঃপ্রকাশ
নেই কোনো কলতানতা, নেই কোনো সন্ধ্যের সাথে লালচে হয়ে আসা জলরাশির ব্যস্ততা
এবং নেই কোনো শুভ্র মসৃণ কাশবনের হাত ধরে ভেসে যাওয়া শাদা মেঘেদের চলমান অভিনয়
শুধু আপেক্ষিক ঔদার্যের জন্যে মুখিয়ে আছি জীর্ণদশা এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে

হারিয়ে ফেলা মাস্তুলে

অথচ স্নেহ বলে কথা, আলিশে কি ছিন্ন হয় বিদীর্ণ বন্ধন?
নীলাদ্রি বলে, এ কোন সেতুর ভেতর তুমি দৌড়াও রোজ!
যেখানে আমাকেই হারিয়ে ফেলো জর্ডানের বুকেও?
মৃত সাগরেই যদি হারাও, প্রশান্তে তবে সামলাবার নাম নেই
এতোবার যে হারিয়ে ফেলি, ভাঙা মাস্তুলে চিৎকার দিয়ে ডাকি,
প্রতিধ্বনির বোবাকান্না ছাড়া কিছুই শুনি না
তবুও সালিস হয় না আমার
ভেবে পাই না,
চোখের ঘোলাটে নীলে সমুদ্র দেখছি নাকি তোমাকে…!

বেড নাম্বার ০৯

মাত্র দেখতে শেখা উৎফুল্ল আইরিশের ভেতরের কথাগুলো আরো গোপন হচ্ছে
অচেতন রোগীর বাম অ্যাওর্টা থেকে গড়িয়ে পড়ছে মঙ্গলকামী পরিজনদের আয়ু
প্রশ্বাসের ব্যারোমিটার ভুলভাল জানিয়ে দিচ্ছে আসন্ন করুণ সময়ের মাত্রা
ব্যবহারবহুল খালি থালায় শুকনো পড়ে আছে বাসি হৃদপিণ্ড
স্পর্শজাতক দ্রব্য হয়ে স্মৃতিপট থেকে খসে পড়ছে সমূহ দিনের কথা, ছেড়ে যাচ্ছে বিমুখ সকাল
অন্তর্মুখী ব্যতিচারগুলো সাদা রক্তের সাথে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ছে… লাল বেডশিটে

অবলোকন

তোমার রুগ্ন হাতের দশটি আঙুলের মতো
নেচে ওঠে উৎকণ্ঠার মিহি ঝালর!
জ্যোৎস্না ফোটানো তিমির প্রহরের
প্রত্যেকটি নিস্তব্ধতার ডাকনাম ধরে
ডাকতে গিয়ে দেখি- সাদা সবুজের মাঝামাঝি
আলোর কয়েকটা জোনাকি আমার- খেয়ে ফেলা
বাদাম খোসার শরীরে ঢুকে পড়ছে
আর ধীরকম্পন চোখের মতো একটা আর্দ্র মরুভূমি
ভেসে উঠছে তামাটে অনুভূতির তীব্র মরীচিকায়
বকুল ফোটানো কোনো ভ্রান্ত সকালে-
একেকটি সাদা পাপড়ির শিরোনাম ধরে
ডাকতে গিয়ে দেখি- নীল হলুদের মাঝামাঝি আলোর
কয়েকটা জলকূপ গোগ্রাসে গিলছে বিষণ্ন ছেঁড়া দুপুর

আক্ষেপ

আমাদেরও এতোটুকু ঘর ছিলো, ছিলো আশ্বাসের বাগান
অথবা ভোররাতে কোনো স্বপ্ন ছোঁবো বলে সারাটা রাত
নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়ার প্রবণতা- ছিলো এতোটুকুই যাতনা;
প্রিয় চোখ অন্য চোখে তাকালে তারও বেদনা ছিলো!
ঘুড়ি ঘুড়ি উড়িয়ে দেবার পরে আর নাটাই কখনো যন্ত্রণা দিতো না
এসব স্বীকারোক্তির কাছে আমার কিছুই নেই চাওয়ার
ইচ্ছেও নেই ফিরে পাবার গুটিগুটি পায়ে দৌড়ে বেড়ানো সোনালি দিন, প্রিয় সব অভিলাষ
ছিলো অল্পকিছু সাধ! স্বপ্ন অগাধ!
সেটুকুও ফিরে পাবার নয়!
এতোটুকু ঘরে বসেই আজো আশা বুনি, দেখি
ঈর্ষার ফানুসেরা উড়ছে যেন সমস্ত আকাশজুড়ে
তারই শয্যায় বসে পার করছি তারা ঝলমল এক ব্যথাতুর স্বপ্নজীবন

যতটুকু ছিলাম অপ্রিয়

গদ্য ছড়ানো শুকনো পাতারা পৃষ্ঠা মেলছে ধূসরে
ওই দূরে শত নীলাদ্রির রোদ ভাসানো খেলা
কী জানি মুগ্ধতায় চৌচির সব জখম আবারো
ভরপেট সেজে আত্মহননের প্রতীক্ষায়;
নোঙর তুলে ভেজা চোখে অনন্ত ছোটাছুটি
দয়িতার সাথে ছিলো যত অনুচিত কথা
বরাবরই আগের চেয়ে রঙিন লাগছে…
যতটুকু ছিলাম অপ্রিয়,
তার চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ লাগছে আজ
কিসের ভয় জানি না, হয়তো অশ্লীলতার সংজ্ঞা
আচমকাই চড়ে বসলো অকপট কাঁধে
তারপর পলাশের মিথ্যে শ্লোকে হারিয়ে ফেললাম
আত্মকথা আর সঙ্গোপনী আলাপ- যতো ছিলো আমার!
এই ফাল্গুনে- আমরা আবার জন্ম নিলাম দু’জনে

একটি প্রেমের পদ্য

চারুলতার গোপন ডায়েরিতে আমি
বিশিষ্ট শিরোনাম-
এই ওই গাঁ থেকে ভেসে আসা
হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান
যতোসব ঐচ্ছিকতা বিদ্যমান,
আমার কানে ঢোকা করুণ সুর
ছেলেমি করার যতো বাহানা;
ফল চুরি, কানামাছি, ভোঁ দৌড়
সব চারুলতার-
আমার ব্যক্তিগত চিন্তার রেখা
সরলতরো রেলের মতো কখনো
প্যাঁচ খেতে চাইলেই শুনি
ওই দূরের ঘণ্টাধ্বনি,
স্কুল ছুটি, চারুলতার…
জানি আমিই তার
কবিতার মুগ্ধপাঠ
অথবা গোপন ডায়েরির
শুকনো পাপড়ির মতো
লুকিয়ে থাকা
নিবিড় চর্চার অমিয় বাগান
ফুল ফোটা, পাখি ডাকা সেই
করুণ সুর, আমার বুকে
গেথে থাকে সত্য যেমন
তেমনি, চারুলতার-
চারুলতার কতো কিছু আমি!
সে আমার নিছক রহস্য,
অনাগত মেঘ, অধরা আকাশ
কল্পনার-

মনে পড়ে সখা

কিছু ব্যতিচার স্মৃতিচারণেই ভালো দেখায়
শুভ হয় কেটে যাওয়া দিনান্ত-মোহ-আবেগ
মনে পড়ে সখা, আজো ঠিক ফলপাকুড়ে
গাল ভরানো শান্ত-উচ্ছল মুখটা মনে পড়ে
উদাসীন বিরহতাপ কেবল উগলে দেওয়া
সম্পর্কেই মানায় তবে! সখা তবু মনে পড়ে
চৈতীর স্নিগ্ধ ওড়না উড়ে এসে সলাজ বুক
তোমায় ঢেকে দেয় চিরতরে। কিছু ব্যতিচার
স্মৃতিচারণেই ভালো লাগে; শুভ হয় দিন
শুভ হয় ক্ষণ, শুভ হয় সর্বপ্রিয় সকল জন
মনে পড়ে সখা, চাঁদমুখো তোমায় মনে পড়ে

স্মৃতিবচন

বিমল হারপুনে বাঁধা ধোঁয়াশা স্মৃতি- খোলাসা হৃদয়
ক্ষুদে নোঙর লজ্জাবতীর মতো অস্তমন
গুটিয়ে নেয় ক্ষীণ পরিধিতে;
আজই আবার উত্থানের বচন গেয়ে যায়,
সেধে এসে শুনিয়ে যায় আকাশদস্যু মেঘগায়ক
ভেলায় চড়ে জাগিয়ে তোলে জল, অবিচল চরাচর
দর্পণতল শীর্ষে জাগে আর্তনাদের সান্নিধ্য
ফেয়ারওয়েল নৌযাত্রা, বছর পঞ্চাশেক আগেও এভাবে
উথলে ওঠে গুম হওয়া লাশের চোখে ঘুম
বিকট মৌন চিৎকার কোনো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
সমাধানহীন বাষ্পপাপের সাথে নিরানন্দ দেহসহিত
অনাগত চৈত্রে মিলিয়ে যায়

আকস্মিক কিছুক্ষণে

আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যাচ্ছে কালো পিঁপড়ের দল
অস্থিমজ্জায় প্রাচীন উইপোকাদের সংসার
চোখের কোটরে মাছিদের ভিড়, ক্রমশই অব্যাখ্যেয় হচ্ছে শরীর
গতাসু বাতাসের মতোই ধসে যাচ্ছে অভ্যেসের স্থাপনা
ফুসফুস ভরে আছে কালো ধোঁয়ায়, মগজে হচ্ছে রক্তক্ষরণ
হাঁটতে গেলে পা মচকে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে
হাত দিয়ে পত্রিকা ধরতেই হাত ছাই হয়ে শিরোনাম হয়ে যাচ্ছে
ফুটপাতে বসে ভিক্ষে করছে মানুষ, মানুষই ভিক্ষে দিচ্ছে
ওভারব্রিজে বিলাসবোধের কলহাস্য- তাকালে দেখা যায়
বোরকা পরিহিত রমণী, পিছু পিছু কিছু কৌতূহলী যুবক
বিআরটিসির বাস ফার্মগেট পেরিয়ে এদিক-সেদিক চলে যাচ্ছে
জঠর শুকোচ্ছে ক্ষিদেয়- ক্ষুধার্তের আর্জি শুনছে কেউ দাঁড়িয়ে
এশিয়া প্যাসিফিকের সিঁড়িতে কাপলদের আমোদের গল্প
বিস্তীর্ণ আকাশ ছাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে-
বৃক্কবিকল হয়ে তলপেটে যন্ত্রণা জমছে, বুকে জমছে ঘাম
বুকের পাঁজরের খাঁচায় একটা মানুষ বন্দী আছে
ভীষণ অপরিচিত এইসব গত্যন্তরে তাকে পরিচয় করাতে এই আগমন
অথচ সে পাঁজর ভেদ করে মুক্ত হতে চাচ্ছে না, তাই-
ফিরে যেতে হচ্ছে রোদ, শহর, ফুটপাত, ভিখিরি, সিগারেট, কামিনী, যন্ত্রণা, পত্রিকা, দৃশ্যাবলী ফেলে রেখেই
শরীর গুঁড়িয়ে পড়ছে সহসাই-
মেরুদণ্ডে পিঁপড়ে বয়ে যাচ্ছে, হাড়ে উইপোকা, চোখে মাছি, ফুসফুসে অবরুদ্ধ দম, মগজে বাসি রক্ত
আর পাঁজরে মানুষ নামের এক তুমি…

……….
সাদিক আল আমিন; হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত
ঠিকানা : নয়নপুর, সদর উপজেলা, দিনাজপুর-৫২০০

Print Friendly, PDF & Email
সাদিক আল আমিন

Read Previous

রুদ্র সাহাদাৎ-এর গুচ্ছ কবিতা

Read Next

শামান সাত্ত্বিক একগুচ্ছ কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *