অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৩, ২০২৪
২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৩, ২০২৪
২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বপন বিশ্বাস -
একটি পুরোনো জানালার গল্প

একটা গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল চঞ্চলের। তার চোখের নিচে তখনও দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি। শরীরে কিঞ্চিৎ মাদকতা। ঠিক নেশার জন্য নয় ক্লান্তি ভুলতেই ঘুমের আগে একটু খেয়েছিল। তরলের দ্রব্যগুণ অনেক। ঘুম ভেঙে সবকিছুই কেমন ভুলভাল মনে হচ্ছে। মনের গভীরে ডুব দিয়ে নিজেকে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে আবার ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায়। সে রাজ্যের রাজকন্যা সোফিয়া। মাইক্রোসফটের রেমন্ড অফিসে বসে সে তখন চ্যাট করার চেষ্টা করছে। চঞ্চল ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ভয়েজ মেসেজ দেয়।

-ওহ্ বেবি, আই অ্যাম স্লিপিং। টক টু য়্যু লেটার।

চঞ্চল সোফিয়া দুজনেই হার্ভার্ড থেকে পাস। একসাথে মাইক্রোসফট উইন্ডোজে চাকরি। একসাথে থাকা। রাশান সোনালি চুলের মেয়ে সোফিয়া। বাঙালি ছেলেদের যেমন সাদা মেয়ে পছন্দ, তেমন সাদা মেয়েদেরও বিশেষ আকর্ষণ আছে তামাটে রঙের ছেলেদের প্রতি। তাই তাদের থাকা-থাকির সম্পর্কটা হার্ভার্ডের মাঝামাঝি পর্যায় থেকেই শুরু। শুধু বিয়ে করার সময়টাই হয়ে ওঠেনি। খুব যে একটা ইচ্ছে আছে তাও নয়। চঞ্চল বলে, বিয়ে করা মানেই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। নানারকম আইনি জটিলতা। উত্তরাধিকারের দেনদরবার। সোফিয়া যদিও এতো কিছু ভেবে দেখেনি। জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওরা ভাবে না। ওরা বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। হেসে খেলে জীবনের দিনগুলোকে আনন্দে পার করে দেয়াই আধুনিক সভ্যসমাজের ধর্ম। তাদের না আছে ইহকালের সঞ্চয়ের চিন্তা, না আছে পরকালের সঞ্চয়ের চিন্তা। তবে চঞ্চল চিন্তা না করলেও তার বাবা-মা চিন্তা করে। পীর আউলিয়া বাড়ির ছেলে চঞ্চল। বাবা-মা চেয়েছিল একমাত্র ছেলে আমেরিকা থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসবে। দেখেশুনে তাদের মনের মতো একটা মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দেবে। ছেলের বউ ঘরসংসার, ধর্মকর্ম করবে। শ্বশুর-শাশুড়ি শেষ বয়সে সেবাযত্ন পাবে। এখন তাদের চাওয়া-পাওয়ার স্বপ্ন তলানিতে এসে ঠেকেছে। তারা বুঝে গেছে ছেলে আর দেশে ফিরবে না। তাদের পছন্দের কোনো মেয়েকেও বিয়ে করবে না। এখন তাদের শেষ চাওয়া, একটা বিয়ে অন্তত হোক। তা সে সোফিয়ার সাথে হলেও এখন আর কোনো আপত্তি নেই। যে সোফিয়ার সাথে বিয়ের কথা শুনে একদিন চঞ্চলের মা বলেছিল, ‘ওই মেমসাহেব বিয়ে করলে আমার মরা মুখ দেখবি’। এখন তার বাবা-মা ভাবে, হয়তো সেই কথার জন্যই ছেলে বিয়ে করছে না। তাই তো ছেলেকে জরুরিভিত্তিতে ডেকে পাঠিয়েছে, এইটা বোঝানোর জন্য যে, তাদের আর কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। একটা বিয়ে অন্তত হোক।

ঘুমের ভেতরে শোনা সেই গোঙানির শব্দটা আবার কানে এলো। কেউ যেন খুব ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে শব্দ করছে। প্রায় সাত বছর পর গতকালই সে বাড়ি ফিরেছে। এই সময়ের ভেতরে এলাকার চেহারা, বাড়ির চেহারা সবকিছুই বদলে গেছে। মানুষের চেহারাও অনেক পাল্টে গেছে। ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশে সে বড় হয়েছে তার অনেক কিছুই এখন শুধু স্মৃতি। পথে আসার সময় লক্ষ করেছে অনেকেই, বিশেষ করে তরুণ যুবকরা তাকে চিনতেই পারছে না। তাই গোঙানির শব্দটা যে কোথা থেকে আসছে তা আর বুঝে উঠতে পারে না। বিছানা ছেড়ে জানালার দিকে এগিয়ে যায়। থাই অ্যালুমিনিয়ামের বেশ প্রশস্ত জানালা। সাথে স্বচ্ছ মোটা কাচ। তিনতলার এই ঘরটি আগে ছিল না। নতুন করা হয়েছে। বাবা-মা সোফিয়াকেও সাথে নিয়ে আসতে বলেছিল। তাই জানালা বাথরুম আসবাবপত্র সব কিছুই বিদেশি স্টাইলে করা হয়েছে। তবু জানালা দিয়ে তেমন কিছু দেখা গেল না। বাইরে তখনও ভোররাতের ছোপ ছোপ অন্ধকার। তবে জানালার কাছে দাঁড়াতেই শব্দটা আবার কানে এলো। ঠিকমতো বোঝা না গেলেও এটুকু বোঝা গেল যে, শব্দটা আসছে তাদের পুরোনো বাড়ির জানালা-দালানের দিক থেকে। মনে পড়ল, ছোট দাদাজান তো এখনও জানালা-দালানেই থাকে। তবে কি তিনিই এমন শব্দ করছেন? সাত বছরের ব্যবধান। চঞ্চল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না শব্দের কারণটা কি হতে পারে। ছোট দাদাজানের বয়স হয়েছে। তিনি কি এমনিতেই এমন শব্দ করেন নাকি সত্যি কোনো বিপদ!

চঞ্চল সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নেমে আসে। বাবা-মা’র দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ডাকবে কিনা চিন্তা করে। এমন সময় ফজরের আজান হয়। চঞ্চল মাকে ডেকে তোলে। মা চঞ্চলের কথা শুনে বলে, আজ হয়তো আবার সাপ বেরিয়েছে। পুরোনো বাড়ির জানালা-দালান থেকে তো এখন প্রায়ই সাপ বের হয়। কতবার করে উনাকে বললাম নতুন বাড়িতে এসে থাকার জন্য। তা তিনি শুনলেন না।

মা এমন নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলল, যেন সাপ বের হওয়াটা বাগানে ফুল ফোটার মতো কোনো বিষয়। চঞ্চল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-সাপে কামড়ায় না?
-কামড়ায় না আবার! গত বছরও দুজন মরেছে। একজন খাদেম, আরেকজন মুরিদ।

চঞ্চল এবারও লক্ষ করল মা’র কণ্ঠে কোনো উদ্বেগ বা আতঙ্ক নেই। এক ধরনের হতাশা আর অনুযোগের সুর। চঞ্চল নিজেও সাপ দেখে খুব ভয় পায়। তারপরও দোতলা থেকে নিচে নেমে রশিদকে ডেকে নিয়ে জানালা-দালানের দিকে ছুটে যায়। রশিদ এ বাড়ির কাজের ছেলে। অনেক ছোট বেলা থেকে আছে। বয়সে চঞ্চলের থেকে কিছুটা বড়। ছোট দাদাজানের কোনো এক মুরিদ উত্তরাঞ্চল থেকে এনে দিয়েছিল। তারপর থেকেই আছে। বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে নিচতলায় থাকে।

নতুন বাড়ির পেছনে পুরোনো বাড়ি পুরোটাই ভেঙে ফেলা হয়েছে। বহুদিনের পরিত্যক্ত দালান বাড়িটা ভাঙাচোরা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল। লতাপাতায় ঢেকে অন্যরকম এক চেহারা হয়েছিল। লোকে বলত পুরোনো জমিদার বাড়ি। সেই পুরোনো জমিদার বাড়িটা ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে গেলে জানালা-দালান। জমিদার রায়চৌধুরীদের ঠাকুর দালানের সাথে মিলিয়ে খানচৌধুরীদের এই দালানের নাম রাখা হয়েছিল জানালা-দালান। একসময় ঠাকুর দালানের ঠাকুর আর জানালা-দালানের জানালা দুটোই খুব জাগ্রত ছিল। মানুষ বিপদ-আপদে আশ্রয় পেত। অনেকের মুশকিল আসান হতো। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় ঠাকুর-দালানের কষ্টি পাথরের মূর্তি লুট হয়ে গেছে। দেশভাগের ডামাডোলে তারাও দেশছাড়া হয়েছে। রায়চৌধুরীদর জমিদার বাড়ি এখন শত্রু সম্পত্তি। কিছুটা সংস্কার করে তাতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ছেলেমেয়ারা সেখানে লেখাপড়া কারে। জানালা-দালানের অবস্থা জরাজীর্ণ। এই দালানের বয়স কত তা চঞ্চল ঠিক জানে না। তবে এটুকু জানে যে, জানালা-দালান পুরোনো জমিদার বাড়ির থেকেও পুরোনো।

কোনো একসময় পাশাপাশি দুই জমিদারির সীমানা নির্ধারণে জন্য দিঘি খনন করা হয়। তখন মাটির নিচে একটি কষ্টি পাথরের বিষ্ণু মূর্তি ও একটি জানালা পাওয়া যায়। রায়চৌধুরীরা বিষ্ণু মূর্তিটি তাদের ঠাকুর দালানে স্থাপন করে। অংশিদার সূত্রে খানচৌধুরীরা পায় জানালা। প্রথমে জানালাটার তেমন গুরুত্ব ছিল না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার পর বোঝা গেল এটা কষ্টিপাথরের মূর্তির মতোই কোনো মূল্যবান জিনিস। কি কাঠ দিয়ে তৈরি তা কেউ বলতে পারে না। কোনো কিছু দিয়েই সে কাঠ কাটা যায় না। জানালাটা নিখুঁতভাবে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান। খুব দ্রুত সেই আশ্চর্য জানালার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েকজন কাঠমিস্ত্রি পরখ করে বলল, কোনো মানুষের পক্ষে এ জানালা বানানো সম্ভব না। তখন প্রাচীন মানুষদের কেউ কেউ বলল, এটাই হয়তো সেই আসমানি জানালা। যে জানালা কোনো মানুষ তৈরি করেনি। অনেকেই তাতে সাঁই দিল, হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই সেই পবিত্র জানালা। কেউ বলল, এটাই সেই কুদরতি জানালা যার অনেক গল্প তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনে আসছে।

গল্পের শুরুতে সবাই বলে, সে অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগের কথা তা কেউ জানে না। কেউ বলে একশ বছর। কেউ বলে হাজার বছর। কারও কারও মতে এর থেকে বেশিও হতে পারে। আরব কিংবা পারস্য দেশ থেকে কোনো এক সুফি সাধক এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনিই সাথে করে এই অলৌকিক জানালা নিয়ে আসেন। এই জানালার আলোয় আলোকিত হয়ে নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ সত্যের সন্ধান লাভ করে। তবে সত্যটা যে কি তা কেউ জানে না। তবে গল্পটা এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। তারপর কোনো এক বড় বন্যায় যখন সবকিছু ভেসে যায়। তখন হয়তো এই জানালাও ভেসে যায় এবং মাটির নিচে চাপা পড়ে।

এমন কথাও শোনা যায় যে, কোনো এক বিখ্যাত যোদ্ধা এই জানালার খবর শুনে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। এই অঞ্চলের রাজাকে পরাস্ত করে জানালা তার রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবেন। তার নাম ছিল ঈশাখাঁ। তিনি জানালার কুদরতি ক্ষমতা দেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। শুধুমাত্র তার তরবারিতে এই জানালার আলো স্পর্শ করান এবং সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান।

চঞ্চল স্কুলে পড়ার সময় হামেদ মাস্টার ইতিহাস পড়াতেন। তিনি একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ঈশাখাঁ মানসিংহের যুদ্ধে একজনের তরবারি ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে। কার তরবারি, কেন ভেঙে গেছে বলতে পারবি? চঞ্চল লাফ দিয়ে উঠে উত্তর দিয়েছিল, আমি জানি স্যার। মানসিংহের তরবারি ভেঙে গিয়েছিল। কারণ ঈশাখাঁর তরবারিতে কুদরতি জানালার আলো পড়েছিল।

চঞ্চলের আজও বেশ মনে আছে। হামেদ মাস্টার তখন দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিলেন। কান থেকে কাঠিটা বের করলেন। তারপর কাঠির মাথা পরীক্ষা করতে করতে বললেন,

-এইসব কুদরতি গল্প কি তোর বইয়ে লেখা আছে?
-না। কিন্তু আমি দাদাজানের কাছে গল্প শুনেছি।
-দাদাজানের গল্প পরীক্ষার খাতায় লিখলে তো নম্বর দেবে না।
-তাহলে? তাহলে, দাদাজানের গল্প কি মিথ্যা?

হামেদ মাস্টার তার কান খোঁচান কাঠিটা জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে কিছু সময় অবাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কী যেন ভাবলেন। তারপর উদাস কণ্ঠে বললেন, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা আমি বলার কে? তুমি বিশ্বাস করলে সত্য, বিশ্বাস না করলে মিথ্যা।

সেদিন হামেদ মাস্টারের উপর চঞ্চলের খুব রাগ হয়েছিল। বুঝেছিল, হামেদ মাস্টার জানালার গল্প বিশ্বাস করে না। জানালার গল্প চঞ্চলের বাবাও বিশ্বাস করে না। বাবা বলেন, ওসব বুজুরকি। কবে কে কি গল্প বানিয়েছে আর ভণ্ডগুলো তাই ভাঙিয়ে খাচ্ছে। তবে বাবার ওপর চঞ্চলের রাগ হয় না। কেন হয় না তা সে জানে না। হয়তো ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে, বাবার অবিশ্বাস আর ছোট দাদাজানের বিশ্বাস, দুটোই তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কোনোটাই তাকে কষ্ট দেয় না। তবে হামেদ মাস্টার যেদিন মারা গেলেন, সেদিন চঞ্চল সত্যি খুব কষ্ট পেয়েছিল।

রাতে লোকটা বাজার থেকে বাড়ি ফেরেনি। সারারাত খোঁজাখুঁজি চলল। সকালে রাস্তার ধারে খাদের ভেতর হামেদ মাস্টার লাশ পাওয়া গেল। ছোট দাদাজান বলেছিল, হামেদ মাস্টারের ওপর জ্বিনের নজর পড়েছিল। জ্বিনের কথা মতো না চলায় জ্বিন তাকে মেরে ফেলেছে। চঞ্চলের বাবা শুধু আক্ষেপ করে বলেছিল, এলাকায় একটা জ্ঞানী মানুষ ছিল। ভণ্ডগুলো তাকেও মেরে ফেলল।

ভণ্ডগুলো যে কে? তা ঠিক চঞ্চল বুঝতে পারে না। কারণ রেগে গেলে বাবা সবাইকেই ভণ্ড বলে। চঞ্চলের ওপরে রেগে গেলেও বলতো, বেশি ভণ্ডামি করবে না। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। লেখাপড়া না করলে জানালা পাহারা দিয়ে খেতে হবে।

চঞ্চলদের বংশ পরম্পরায় এই রকমটাই হয়ে আসছে। পরিবারে লেখাপড়ায় কাজেকর্মে সব থেকে দুর্বল সদস্যটিই জানালা পাহারা দেয়া মানে পীরগিরির দায়িত্ব পায়। চঞ্চলের দাদাজান শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। ছোট দাদাজান ছোটবেলায় খুব বাউণ্ডুলে ছিল। তার ঘাড়ে পড়েছে বংশের ঐতিহ্য রক্ষার ভার। চঞ্চলের বাবা ইঞ্জিনিয়ার। তার ওসবে কোনো বিশ্বাস নেই। চঞ্চল নিজের দাদাজানকে দেখেনি। তবে ছোট দাদাজানের খুব ভক্ত ছিল। মুগ্ধ হয়ে তার কাছে বসে গল্প শুনত। দাদাজানের খাদেম-মুরিদরাও তাকে খুব আদর স্নেহ করত। কেউ কেউ এমনও ধারণা করত যে, বড় হয়ে চঞ্চল হয়তো পীরের আসনে বসবে। আর এই ধারণাটাই চঞ্চলের বাবা-মা’র জন্য ছিল বড় শঙ্কার কারণ। তাই হয়তো কলেজ পাস করার সাথে সাথেই তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছে। চঞ্চল আমেরিকা থেকে ফিরে যেবার প্রথম চাকরির খবর দেয়, সেবার ছোট দাদাজান জিজ্ঞাসা করেছিল,

-কিসের চাকরি?
-মাইক্রোসফট উইন্ডোজ।
-উইন্ডো মানে তো জানি জানালা। তা, তুমি তো জানতাম কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হইছ। এখন বিদেশে বসে যদি জানালার চাকরি করা লাগে, তাহলে বিদেশে থাকার দরকার কি? দেশে ফিরে বাড়ির জানালার দায়িত্ব নেও। আমি একটু রেহাই পাই।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাদাজান বলেছিল,

-তোমার বাবা তো আর কোনোদিন এদিকে ফিরে তাকাবে না।

– ওটা কোনো জানালার চাকরি না। মাইক্রোসফট হলো একটা বিশ্ববিখ্যাত কম্পিউটার কোম্পানি। আর মাইক্রোসফট উইন্ডোজ কোনো ঘরে লাগানো জানালা না। এটা হচ্ছে কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম। এটা জানালার মতো একটা পদ্ধতিতে কাজ করে তাই এর নাম মাইক্রোসফট উইন্ডোজ। আমার কাজ হচ্ছে এটাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা ঠিক করা আর সিস্টেমটাকে আরও উন্নত করা। যাতে কিছুদিন পর পর মানুষ উইন্ডোজের নতুন একটা ভার্সন বা সংস্করণ পেতে পারে। তোমার জানালার তো কোনো সংস্করণ হবে না। তাহলে তোমার ওই ভাঙা জানালা আর ভাঙা বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য আমি দেশে ফিরে কি করব? আমার তো কোনো কাজ নেই।

‘ভাঙা জানালা’ কথাটা বলা যে ঠিক হয়নি তা কথাটা বলামাত্রই দাদাজানের মুখ দেখে সে বুঝতে পেরেছিল। তিনি বললেন,

-ওভাবে বলে না দাদাভাই। এটা তো আর কোনো মানুষের তৈরি জানালা না যে, একইরকম আরও অনেক জানালা বানিয়ে রঙ ঢং পাল্টে বাজারে বেশি বেশি দামে বিক্রি করে টাকা কামাবে। এটা হলো আসমান থেকে পাওয়া আমাদের বংশের একটি আমানত। তার খেদমত করাই আমাদের কাজ।

-দেখো দাদাজান, কোনো জিনিসই রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া তার কার্যকারিতা ঠিক থাকে না। এই যেমন তোমার এই জানালা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন খোলাই যায় না। যে জানালার আলোয় একসময় এতো কুদরত ছিল তা দিয়ে এখন কোনো আলোই ঢোকে না। তাছাড়া পুরোনো জিনিস নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করে। যেমন এই জানালাটা দিয়ে একসময় আলো আসত, কিন্তু চোর-ডাকাত ঢুকতে পারত না। এখন চোর-ডাকাত তো ঢুকতেই পারে, এমনকি জানালার পাশ দিয়ে যে ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছে তাতে তো সাপ-পোকামাকড় বাসা বাঁধবে। তাছাড়া মানুষের প্রয়োজন আর চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে জিনিসের নতুন সংস্করণেরও দরকার হয়।

চঞ্চল সেদিন কথা শেষ করতে পারেনি। দাদাজান থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, থাক দাদাভাই, এই পবিত্র ঘরে বসে ওসব কথা আর না বলি। যেসব কথা শুনলে মানুষের নিয়ত নষ্ট হয় তা না শোনাই ভালো। তুমি বরং এবার লাল টুকটুকে একটা মেয়ে দেখে বিয়ে কর। মরার আগে নাতবৌ’র মুখটা একবার দেখতে চাই।

আজ সাত বছর পর। আবার সেই ভাঙা জানালা-দালান। চঞ্চল রশিদের সাথে দৌড়ে এসে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল,

-দাদাজান কোথায়? দাদাজান ঠিক আছে তো?

একদল বাচ্চাছেলে আর কয়েকজন অচেনা লোক অবাক হয়ে চঞ্চলের মুখের দিকে চোখ ফেরাল। ওরা কেউ চঞ্চলকে চেনে না। ওদের সবার হাতে লাঠি। সামনে হাত চারেক লম্বা একটা সাপ মেরে ফেলে রেখেছে। পাশে শুয়ে বুড়ো খাদেম। একটা অস্পস্ট গুঙানির শব্দ তখনও তার গলা থেকে বেরচ্ছে। তবে এর থেকে জোরে শব্দ করার মতো শক্তি আর তার নেই। ছেলেগুলো জানালা দালানের পাশে নতুন বানানো এতিমখানার বাসিন্দা আর লোকগুলো দাদাজানের মুরিদ। একজন ছেলে চিৎকার করে বলল,

-ওই কুদরতি জানালার ভেতর থেকে সাপ বেরিয়েছে। আমি মারছি। আরও দু’তিনজন চিৎকার দিয়ে উঠল, না না আমি মারছি। গতকালেরটাও আমি মারছি। একজন বয়স্ক খাদেম এগিয়ে এসে বলল, জানালার ভেতরে মনে হয় সাপে বাসা বেঁধেছে।

কারও কাছে থেকে দাদাজানের কোন খবর পাওয়া গেল না। অধৈর্য হয়ে চঞ্চল আবার জিজ্ঞেস করল,

-দাদাজান কোথায়? দাদাজানকে দেখছি না কেন?

কেউ কোনো উত্তর দিল না। সবাই অবাক হয়ে চঞ্চলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন বয়স্ক মুরিদ চঞ্চলের দিকে এগিয়ে এলো। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

আপনি ক্যাডায়? কার কথা জিগান? পীর সাহেব? তিনি তো নাই।

চঞ্চল ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদের দিকে তাকাল। বলল,

-মানে?

রশিদ উত্তর দিল না। মাজার গামছা খুলে মুখে চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল দালানের পাশের জানালা । বলল,

-ওইখানে।

চঞ্চল ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল। একটা সাদা টাইলসে মোড়া কবর। একদিকে একটা নামফলক। তাতে বছর ছয়েক আগের একটা তারিখ লেখা। সে সময়টাই সোফিয়াকে নিয়ে বাবা-মা’র সাথে দ্বন্দ্ব চরমে। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। তারপর যখন আবার যোগাযোগ হয়েছে তখন হয়তো দুঃসংবাদটা কেউ জানাতে চায়নি। পুরোনো দুঃসংবাদ নতুন করে বলার ভেতরে একটা অপরাধ বোধও হয়তো কাজ করে। চঞ্চল কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে এই সব ভাবতে থাকে। কবরের উল্টো পাশের সাদা টাইলসে ওপর চার পাল্লার একটি জানালার ছবি। কিছুটা ধুলা ময়লায় ঢাকা পড়েছে। তখন ভোরের আকাশে আবীরের রঙ। নরম আলোর একটা ছটা এসে পড়েছে টাইলসে আঁকা সেই জানালার ওপর। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন মাইক্রোসফট উইন্ডোজের লোগো। ঠিক সেই সময় চঞ্চলের ফোনটা বেজে উঠল। সোফিয়ার ফোন। কোন কুশলাদি জিজ্ঞাসা ছাড়াই সরাসরি বলল,

-তোমার জন্য দুটো সুসংবাদ আছে। মন দিয়ে শোন। আমাদের গ্রুপের তৈরি করা মাইক্রোসফট উইন্ডোজের নতুন ভার্সনটি অনুমোদন পেয়েছে। আর তোমার করা সিকিউরিটি ফিচারটা অনেক প্রশংসা পাচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছর যখন নতুন ভার্সনটি লঞ্চ করা হবে, তখন তোমার সিকিউরিটি ফিচারটাই হবে মার্কেটিং ফোকাস।
চঞ্চল বলল,

-ইটস অ্যা গ্রেট নিউজ ফর আস।

সোফিয়া বলল,

-নো স্যার! দিস ইজ নট অ্যা গ্রেট নিউজ। অ্যা রিয়েল গ্রেট নিউজ ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।

চঞ্চলের গলা থেকে অবাক বিষ্ময় নিয়ে বেরিয়ে এলো,

-হোয়াটস দ্যাট?

সোফিয়া বলল,

অ্যা নিউ ভার্সন অফ চঞ্চল ইজ কামিং। এইমাত্র মেডিকেল অফিস থেকে টেলিফোন করে জানাল।

চঞ্চল কোন উত্তর দিল না। তার গলা দিয়ে যেন কোনো কথা বেরোচ্ছে না। মাথার ভেতরে তখন বিদ্যুৎ চমক দিচ্ছে, নিউ ভার্সন অব চঞ্চল, তার লালনপালন, ডেভেলপমেন্ট, সিকিউরিটি এইসব। পৃথিবীটা নিউ ভার্সনের জন্য কি সত্যি নিরাপদ হবে? চঞ্চল এর আগে কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি।

Swapan Biswas
Jamaica, New York,
swapan64@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email
স্বপন বিশ্বাস

Read Previous

মানবেতর জীবন আখ্যান

Read Next

আগন্তুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *