অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১১, ২০২৫
২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মে ১১, ২০২৫
২৮শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আকিব শিকদার -
খসড়া শৈশব

মাইক বাজিয়ে এসেছেন আইসক্রিমওয়ালা, তার বেসুরা গলা। সুপারির বিনিময়ে, কাঁচা ধানের বিনিময়ে রাখছি নারকেলি আইসক্রিম। ফেরিওয়ালা ডাক দিল— ‘চুড়ি-আলতা’! তাকে ঘিরে পাড়ার মেয়েদের ভিড়।

একটা কলার ভেলায় আমরা তিনজন পানিতে ভাসছি, ঢেউ তুলে হাসছি। সাঁতরে সাঁতরে পুকুরে ঝুঁকে থাকা কদমের ডাল ধরে বানর ঝোলা ঝুলে গাছে ওঠার চেষ্টা করছি আমি কাইয়ুম আর আজহার। নষ্ট টায়ার ছোট লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সারাদিন ওটার পিছু ছুটছি, যেন আমার মোটরসাইকেল। স্কুলে যায়নি বলে মা ঝাড়ু হাতে পেটাতে এলে পালিয়ে বাঁচা। বয়স তখন কাঁচা।

আমার ফেলে আসা শৈশব, বন্ধুরা কই সব? স্কুলে যাওয়ার পথে মেহগনির বিচি আকাশের দিকে ছুড়ে মারি। ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে, যেন চরকি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব সারি। অলি আর আলমাস ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বলে— ‘নুনু দেখে ফেলেছি’। ওরা আমার সহপাঠী, শয়তানের ঘাঁটি। তাড়াহুড়ো করে প্যান্ট সামলাতে নুনুতে চেইন এটে গেল। যন্ত্রণায় দিলাম তীব্র চিৎকার। আকাশ বাতাস পার।

কাকিমা কুলা হাতে ধান ঝাড়ছে, পাশে কবুতর। নতুন ধানের উৎসব। আমিন কাকা আর সালিম কাকা ধান মাড়াই কলে। বাতাসে উড়ছে খড়, নতুন খড়ের কাঁচা গন্ধ। কে বলবে মন্দ!

চড়ুইভাতি খেলব। খেত সেচে ছোট মাছ ধরেছি। খিচুড়ি রান্না শেষ, ডিম ভাজা হচ্ছে। চোখ বেঁধে ঝুমি আপা আমাদের ধরতে চাইছেন। আমরা তার শরীর ছুঁয়ে পালিয়ে যাই কাছাকাছি, কানামাছি।

নানার বাড়িতে গেলে সারা শরীরে কাদা মেখে ফুটবল খেলি। শরীর ও মুখের কাদায় চিনতে না পারা দশা; যেন আমরা কাদামাটির মূর্তি। কী যে ফূর্তি। শ্যালোকলে পানি উঠেছে আর আমরা ড্রেনে গোসলে নেমেছি। পানির ঝাপটা আমাদের ভাসিয়ে নিচ্ছে। তাসলিমা, আকলিমা, হিমেল আর আমি। দিনগুলো সত্যিই ছিল খুব দামি।

স্কুলে যাই ছোট সাইকেলে। আমার সাইকেলে একত্রে চারজন চড়ল। স্যারেরা উঁচু থেকে সুতো বেঁধে বিস্কুট ঝুলিয়েছেন। আমাদের হাত পেছনে বাঁধা। লাফিয়ে লাফিয়ে খেতে হবে, বিস্কুটলাফ খেলা। আনন্দ মেলা।

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চারপাশে দেয়াল তোলা স্কুলের পেছনের ছোট গেট টপকে পালিয়ে যাচ্ছি আমি, নুরু, সুমন, আব্দুল। স্কুলব্যাগ এটে গেছে গ্রিলে। মুসিবত আছে কপালে, স্যার তেড়ে আসছেন।

কত স্মৃতি, কত স্মৃতি। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে স্কুলে এসেম্বলি করি, জাতীয় সংগীত গাই, পতাকাকে সালাম জানাই, ভালো মানুষ হয়ে দেশ গড়ার শপথ করি। আমরা কী হতে পেরেছি শপথের মতো যথার্থ ভালো মানুষ?

মনে পড়ে, জলছবির মতো কত স্মৃতি মনে পড়ে। অর্ধেক মাথা কামাতেই চুল কাটবে না বলে কান্না জুড়েছে আমার ছোট ভাই। তাকে লাগছে তাই তোফাজ্জল দাদার মতন টাকপড়া। ছোট বোনকে সাইকেলে তুলে ঠেলে ঠেলে চালাচ্ছি। আমার হাফ-প্যান্ট গেল খুলে। না পারছি সাইকেল সামলাতে, না পারছি খোলা প্যান্ট ঠিক করতে। পারিবারিক অ্যালবামে একটা ছবি আছে আমার চুল কামানো, গায়ে জামা নেই, পা থেকে মাথা অব্ধি একেবারে এক কালার। এইসব দিন কোনোদিন ফিরবে না আর।

আকিব শিকদার : কবি ও গল্পকার। প্রকাশিত বই : কাব্যগ্রন্থ— কবির বিধ্বস্ত কঙ্কাল (২০১৪), দেশদ্রোহীর অগ্নিদগ্ধ মুখ (২০১৫) কৃষ্ণপক্ষে যে দেয় উষ্ণ চুম্বন (২০১৬), জ্বালাই মশাল মানবমনে (২০১৮)।

শিশুতোষ— দোলনা দোলার কাব্য (২০২১)

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

অগ্নিবাসর

Read Next

নুশান : দ্য স্পেশাল চাইল্ড – প্রথম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *