তিবারের মতো এবারও স্বপনকাকুর স্মৃতিতে আমাদের পাড়ায় ফাইভ-এ সাইড ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে। তবে, ফুটবল নিয়ে যখন কথা তুললামই, তখন জানিয়ে রাখা ভালো যে ফুটবলটা সমুদা বেশ ভালোই খেলে। লেফট ফুটার হলেও, বলে শট মারার ক্ষেত্রে তার দু-পায়েই সমান দক্ষতা রয়েছে। স্কুল ও কলেজে চুটিয়ে ফুটবল খেললেও, আমাদের পাড়ার রাস্তাটাই ছিল সমুদার প্রাণকেন্দ্র। এখনও সময় পেলে, সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে সমানভাবে ঘাম ঝরাতে ফুটবল পায়ে নেমে পড়ে। সমুদার বিশ্বাস, ফুটবল খেলা হল এমন এক খেলা যার দ্বারা শরীর এবং মন দুটোই তরতাজা রাখা সম্ভব।
ফিরে আসি পাড়ার টুর্নামেন্টের কথায়। এবারের টুর্নামেন্টের সেক্রেটারি হয়েছে সমুদা। সুতরাং তার আর এবার খেলা হচ্ছে না। সমুদার এখন অনেক দায়িত্ব। সেদিন ঘুম চোখে সমুদার হাত থেকে খবরের কাগজটা নেওয়ার সময় তার মুখটা গম্ভীর দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সকাল সকাল এত গম্ভীর মুখ। কিছু হয়েছে নাকি সমুদা?”
খবরের কাগজটা আমার হাতে দিয়ে সমুদার উত্তর, “আর গম্ভীর। পাড়ার টুর্নামেন্টের সেক্রেটারি হওয়া কি আর চাট্টিখানি ব্যাপার রে! পাড়ার কাকু-কাকিমাদের বুঝিয়ে ওই রাস্তাকে ফুটবল খেলার উপযোগী করে তোলা থেকে শুরু করে সবাইকে একত্র করা, পুরোটাই তো আমার কাঁধে”।
“তা কীভাবে কী করবে ভাবছ?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে সমুদাকে বলে উঠল, “ভেবেছি তো অনেক কিছুই। তবে, পুরোটা তো আর আমি একার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই পাড়ার ছেলেদের বাড়িতে ডেকেছি, একটা আলোচনা করে নিয়ে তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়তে হবে।”
আমাদের কথোপকথনের মাঝেই হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল এবং দরজা খুলতেই দেখি শিবুদাদু ও ওনার সঙ্গে আরেকজন ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছেন। এখানে বলে রাখি, শিবুদাদু হলেন আমার স্বর্গীয় ঠাকুরদার পরম বন্ধু। ওনার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বহুদিনের, বলতে গেলে আমার জন্মেরও আগের।
আমাকে দেখা মাত্রই শিবুদাদু একগাল হাসি নিয়ে বলল, “কী বঙ্কুবাবু, কেমন আছ? এই বুড়োটাকে তো তোমরা একেবারে ভুলেই গেছ। তা, আজ বাড়িতে সবাই আছে নিশ্চয়ই?”
আমিও হেসে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ! দাদু, সবাই আছে”।
শিবুদাদুর গলার আওয়াজ পেয়ে বাবা আর সমুদা বেড়িয়ে আসতেই শিবুদাদু সমুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে সমু, আজকাল তো আর শিবুকাকার কাছে যাওয়াই হয় না। আজ তাই তোর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। না! না! গোয়েন্দা সমরেশের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বলতে পারিস”।
শিবুদাদুর কথা শুনে সমুদা একটু লজ্জাই পেয়েছিল, সেইসঙ্গে তাকে বলতে শুনলাম, “না, মানে আর বলো না শিবুকাকা, পাড়ার ছেলেরা জোর করে আমাকে এবারের ফুটবল টুর্নামেন্টের সেক্রেটারি বানিয়েছে আর সেই নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে তোমাদের ওইদিকে ইদানীং সেইভাবে আর যাওয়া হয়ে উঠছে না”।
সমুদার কথার মাঝেই বাবা বলে উঠল, “আরে সমু, কাকাকে ভেতরে আসতে দে, সব কথা কি এখানেই সারবি? আসো কাকা ভেতরে আসো, আপনিও আসুন”।
সমুদা ওনাদের নিয়ে ভেতরের ঘরে আসার পর বাবা আমাকে বলল, “বঙ্কু, কাকাবাবুরা কথা বলুক, ততক্ষণে তুই ওনাদের জন্য সরবতটা নিয়ে আয়”।
“এক্ষুনি যাচ্ছি বাবা”। বলেই আমি সরবত আনতে ছুটলাম।
সমুদার সঙ্গে সেই অচেনা ব্যক্তির আলাপ করিয়ে শিবুদাদু বললেন, “সমু, ইনি হলেন মি. ঝুনঝুনওয়ালা, এই শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমার সঙ্গে এনার আলাপ বহুদিনের। ওনার একটা সমস্যার কারণেই আজ তোর কাছে ছুটে আসা”।
শিবুদাদু এরপর মি. ঝুনঝুনওয়ালাকে ওনার সমস্যার কথা সমুদাকে খুলে বলতে বললেন আর তখনই সেই রহস্যময় ঘটনার কথা সকলের সামনে উঠে এল। কিন্তু কী সেই রহস্যময় ঘটনা?
মি. ঝুনঝুনওয়ালা বললেন, “আমার বহত দিনের হোটেলের ব্যবসা, নতুন হোটেল কেনার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরে থাকি। দো সাল পহলে, আমার সন্ধানে আসে মালদার সুজাপুর এরিয়ার, হোটেল তাজমহল”।
নামটা শুনেই, মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সৃষ্টি সেই ঐতিহাসিক আগ্রার তাজমহলের কথা মনে পড়ে গেল। যদিও বা সেই ঐতিহাসিক তাজমহলের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই।
আবারও ফেরা যাক মি. ঝুনঝুনওয়ালার কথায়। উনি বললেন, “এক বাঙালি ভদ্রলোকের থেকে আমি হোটেলটা কিনেছিলাম, অউর কেনার পর সাব কুচ্ছ ভালোই চলছিল। লেকিন কুচ্ছ মহিনা পহলে, আচানাক এক টুরিস্টের মৌত কে সাথ হোটেলের ব্যবসাটা ভেঙ্গে পড়ল। পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে জানতে পারে, ওই টুরিস্টের মৌত হার্ট-অ্যাটাকে হয়েছিল। লেকিন উস ঘটনা কে বাদ, ওখানকার লোকেদের মুখে এক অন্য কথা শোনা যেতে লাগল। সাবকা মাননা ইয়ে হেয় কি, হোটেলে নাকি ভূত আছে। আউর সেই কারণেই ওই টুরিস্টের মৌত হয়েছে। ব্যস! তাব সে হি আমার তাজমহলে ট্যুরিস্ট আসা বন্ধ হয়ে গেল। এই ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেল আমার, সমরেশবাবু। আজ তাই সাহায্যের জন্যই আপকে পাস ছুটে এলাম”।
পুরো বিষয়টা শোনার পর ওনাকে সমুদার প্রশ্ন, “আপনার হোটেলের কি পুরনো কোনও ইতিহাস রয়েছে?”
কথাটা শোনা মাত্র মি. ঝুনঝুনওয়ালা বলে উঠলেন, “হ্যাঁ! উসি এরিয়ার সবাই বলে নাকি মেরা হোটেল আগে এক জমিদারের বাংলো ছিল। কিন্তু আমার ওসব কথায় একদাম বিশ্বাস নেই, যত বানানো কাহানি সাব”।
ফের সমুদাকে উনি বললেন, “সমরেশবাবু, আপকো মেরা ইয়ে কেস লেনা হি হোগা, আপনিই এখন আমাকে এই মুসিবাদ থেকে বাঁচাতে পারেন”।
সমুদা ওনার কথা আর ফেলতে পারল না, সে দিব্বি টুর্নামেন্টের কথা ভুলে গিয়ে রাজি হয়ে গেল এবং ঠিক করল এই রহস্যের সমাধান সে করেই ছাড়বে।
কথা পাওয়ার পর মি. ঝুনঝুনওয়ালা খুবই খুশি হলেন এবং সমুদাকে এই বিষয় সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গেলেন।
শিবুদাদু আর ওনার প্রস্থানের পর সমুদাকে আমি একটু রেগেই বললাম, “তুমি কি টুর্নামেন্টের কথাটা ভুলে গেলে? পাড়ার ছেলেরা তোমার দিকে চেয়ে রয়েছে, এখন কী বলবে ওদের?”
সমুদা টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “টুর্নামেন্ট হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি, তাই ভরসা রাখ। একবার যখন সব দায়িত্ব নিয়েছি তখন ফুটবলের ভাষায়, সেম সাইড গোল খাওয়াব না”।
আমি হেসে সমুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, “শিবুদাদু যে মি. ঝুনঝুনওয়ালাকে নিয়ে আসবে তা আমাকে বলোনি কেন?”
সমুদা কাগজ পড়তে পড়তে উত্তর দিল, “সব কথা বলে দিলে কি আর এক্সসাইটমেন্ট থাকে রে? তোর সব বস্তা পচা কমিক্সের বইগুলো কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রাখ আর নিজেকে তৈরি কর কারণ আবার এক রহস্যের সন্ধান পাওয়া গেছে, তবে এবারের রহস্যটা কিন্তু একটু আলাদা”।
হ্যাঁ! এই রহস্য সত্যিই আলাদা কারণ এই রহস্য তাজমহল নিয়ে সুতরাং এই তদন্তের নাম সহজেই দেওয়া যায়, রহস্যময় তাজমহল।
তারপর আর বেশি সময় নষ্ট না করে, সমুদা রহস্য সমাধানের লক্ষ্যে লেগে পড়ল। পরদিন সমুদার কথা মতো আমরা দু-জনে চলে গেলাম কিছু ইতিহাসের খোঁজে শিবুদাদুর বাড়ি, যেই ইতিহাস অবশ্যই মালদা জেলাকে ঘিরে। শিবুদাদু ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক, তাই খুব স্বাভাবিক ওনার থেকে পাওয়া কিছু বহুমূল্য তথ্য আমাদের এই তদন্তের স্বার্থে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
শিবুদাদু থাকেন বেহালায়, ওনার বাড়িতে আমাদের যেতে দেখে উনি খুবই আপ্লুত হলেন, “আরে কী সৌভাগ্য আমার! গোয়েন্দা সমরেশ আর তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট আজ আমার বাড়িতে। তা এই বুড়োটাকে তোমাদের কোন কাজে লাগবে শুনি?”
“কাকা, এখনকার ইন্টারনেটের যুগেও বলতে দ্বিধা নেই যে প্রযুক্তির চেয়ে তোমার মতো কিছু পোড়খাওয়া ইতিহাসবিদের থেকে পাওয়া তথ্য অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। আর তাই তোমার কাছে আজ ছুটে আসা”। সমুদার কথা শুনে মুচকি হাসলেন শিবুদাদু।
এরপর উনি বললেন, “বুঝেছি মালদার সুজাপুর সম্বন্ধে জানতে ছুটে আসা হয়েছে, তাই তো? তা বঙ্কুবাবু, বলো তো দেখি মালদা সম্মন্ধে তুমি কি জানো?”
“দাদু, মালদা হল উত্তরবঙ্গের এক জেলা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Gateway of North Bengal’। এই জেলা এক কালে গৌরবঙ্গের রাজধানী ছিল। এখানকার আম খুবই বিখ্যাত”।
আমার কথা শুনে শিবুদাদু হেসে উঠল, “হা-হা-হা! ঠিক, ঠিক। তবে, আরেকটু জেনে রাখো দাদুভাই, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে পুর্বতন মালদা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে মালদা জেলা স্থাপিত হয়৷ মালদহ ও চাঁচল মহকুমা দুটি নিয়ে মালদহ জেলা গঠিত। মালদহ জেলার নামকরণ এই জেলার আদি বাসিন্দা ‘মলদ’ কৌমগোষ্ঠীর নাম থেকে। অন্যমতে ফার্সি ‘মাল’ ও বাংলা ‘দহ’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে এই জেলার নামটির উৎপত্তি। বিশিষ্ট দার্শনিক ও বৈয়াকরণ পাণিনি তার লেখায় গৌড়পুরা নামক একটি প্রাচীন জনপদের কথা উল্লেখ করেন এবং সেই উল্লেখিত জনপদটিই বর্তমানে মালদা জেলায় উপস্থিত গৌড় অঞ্চল। প্রাচীন ও মধ্যযুগ সমকালীন নগর দুটির অবস্থান মালদহ জেলার বর্তমান সদর ইংরেজ বাজার এর উত্তর ও দক্ষিণে বলে অনুমান করা হয়৷ মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর তট বরাবর অবস্থিত এই মালদা জেলা এককালে যেমন গৌরবঙ্গের রাজধানী ছিল, তেমনই ব্রিটিশ আমলে এখানে জমিদারদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বহু দর্শনীয় স্থান এবং অনেক ঐতিহাসিক জিনিস এই গোটা মালদার নানান দিকে ছড়িয়ে রয়েছে। তবে, এবার আসা যাক সুজাপুরের কথায়। সুজাপুর হল দক্ষিণ মালদার একটি শহর যেখানে মুসলমান বাসিন্দার সংখ্যাই বেশি। এখানে নানা সময় যেমন মুসলিমরা শাসন করেছে, ঠিক একইভাবে বাংলার সালতানাতের পর কিছু হিন্দু জমিদাররাও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছেন”।
শিবুদাদুর থেকে পাওয়া মালদার বিষয় এইসব অমূল্য তথ্য আমরা সংগ্রহ করার পর, চললাম মি. ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে দেখা করতে ওনার অফিসে। মি. ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে দেখা হতেই সমুদা ওনাকে বলল, “আপনি দু-তিন দিনের মধ্যেই আমাদের মালদা যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলুন, এখানে বসে তাজমহলের রহস্য সমাধান করা যাবে না”।
সমুদার কথা শুনে মি. ঝুনঝুনওয়ালা বললেন, “হ্যাঁ! হ্যাঁ! কিঁউ নেহি। আজই সাব বান্দবাস্ত করে দেব আমি। লেকিন সমরেশবাবু, আপনারা কি আমার হোটেলেই উঠবেন?”
সমুদার উত্তর, “না! না! এখনই নয়। আপনি আমাদের জন্য একটা অন্য হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করুন এবং দেখবেন সেই হোটেল যেন আপনার তাজমহলের আশপাশেই হয়”।
মি. ঝুনঝুনওয়ালা সমুদার কথায় রাজি হয়ে গেলেন এবং সমুদাকে কথা দিলেন, সব কিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর উনি স্বয়ং নিজে আমাদের বাড়িতে এসে জানিয়ে যাবেন আর তারপর আমরা মালদার উদ্দেশ্যে রওনা দেব।
দু-দিনের মধ্যে মি. ঝুনঝুনওয়ালা আমাদের বাড়িতে এসে সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার খবর জানিয়ে গেলেন এবং আর দেরি না করে, পরের দিনই সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম মালদার উদ্দেশ্যে। বাবা আমাকে নিয়ে একটু চিন্তা করছিল কারণ এটা আমার একেবারে প্রথম তাকে ছাড়া কোথাও যাওয়া, তাও আবার সমুদার সঙ্গে রহস্যের কিনারা করতে। সমুদা অবশ্য বাবাকে বোঝাল যে সে থাকতে আমার কোনও বিপদ সে হতে দেবে না। আর সেই আশ্বাস পেয়ে বাবা কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু এ যে বাবার মন, এত সহজে কি নিশ্চিন্ত হতে পারে? তাই আমাদের ফেরা না অবধি, তার যে চিন্তা থেকেই যাবে, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম। এদিকে, ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করল আর আমরাও অপেক্ষায় রইলাম সেই তাজমহলের।
মালদা পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল, স্টেশন তখন প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। একজন ব্যক্তি হঠাৎ আমাদের দেখে এগিয়ে এসে সমুদাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা! আপনি কি সমরেশ দত্ত?”
উত্তরে সমুদা বলল, “হ্যাঁ! আমি সমরেশ দত্ত”।
সমুদার নাম শুনে তিনি এক গাল হেসে বললেন, “নমস্কার! আমি পরিমল, আমাকে মি. ঝুনঝুনওয়ালা পাঠিয়েছেন আপনাদের স্টেশন থেকে হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য”।
তারপর আর কথা না বাড়িয়ে আমরা পরিমলবাবুর সঙ্গে চললাম হোটেলের পথে। সেদিন হোটেল পৌঁছে, আমরা ট্রেনের ক্লান্তি দূর করতে একটু জিরিয়ে নিলাম।
সকাল তখন এগারটা, সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম মালদা ঘুরতে, যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে সেই রহস্যময় তাজমহল। তবে, প্রথমেই তাজমহলে না গিয়ে আমরা পুরনো মালদহ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত বিখ্যাত আদিনা মসজিদ দেখতে গেলাম। যাওয়ার পথে সমুদাকে এই আদিনা মসজিদ সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, “বঙ্কু, আদিনা মসজিদ সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদের আদলে তৈরি। এটি বাংলার সালতানাতের সময় সিকান্দার শাহ কর্তৃক একটি রাজকীয় মসজিদ হিসেবে নির্মিত হয়। উনি ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের সদস্য। একসময় এই আদিনা মসজিদ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ”।
আদিনা মসজিদ দেখে ফেরার পথে, এক ধাবায় বসে দুপুরের খাওয়া সারলাম কিন্তু ওখানে ঘটল এক অদ্ভুত কাণ্ড!
একজন পাঞ্জাবি লোককে আমাদের দিকে বারবার তাকাতে দেখে সমুদার কেমন যেন তাকে সন্দেহ হচ্ছিল। আমরা সেই ধাবা থেকে বেরিয়ে যখন মি. ঝুনঝুনওয়ালার হোটেলের দিকে যাচ্ছি, তখন সমুদা আমায় বলল, “বঙ্কু, লোকটাকে ভালো করে লক্ষ করলি? ওর আচরণ কিন্তু বাকি আর পাঁচটা পাঞ্জাবি লোকের মতো নয়”।
আমি প্রশ্ন করলাম, “কেন সমুদা?”
সমুদার উত্তর, “একজন অবাঙালি লোকের পক্ষে এত ভালো বাংলা শব্দের উচ্চারণ করা কি আদৌ সম্ভব? খাওয়ার সময় তাকে মশা কামড়ানোয় সে বলে উঠল, উফ্! মা গো! যেটা পাঞ্জাবিদের মুখে কিন্তু একেবারেই কাম্য নয়”।
আমি কথাটা শুনে বেশ চমকে উঠলাম, মনে মনে ভাবলাম আমাদের তদন্তের কাজ হয়ত এই ঘটনা দিয়েই শুরু হয়ে গেল।
এরপর আমরা যখন হোটেল তাজমহলের সামনে এসে পৌঁছালাম তখন দেখি সেখানে হোটেলের চৌকিদার, সামনে রাখা চেয়ারে বসে ঢুলছে আর তার হাতের কাছে রাখা একটি রেডিওয়ে পুরনো দিনের হিন্দি গান চলছে।
সমুদা তাকে ডাকতেই সে যেন চমকে উঠল। আচমকা তার ঘুম ভাঙানোর জন্য সে একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠল, “কে আপনি? কী কাম আপনার এখানে?”
সমুদা তার উত্তরে বলল, “আমি মি. ঝুনঝুনওয়ালার পরিচিত, সমরেশ দত্ত আর ও আমার ভাইপো। এখানে ঘুরতে আসায়, ওনার হোটেলটা একটু দেখতে এলাম”।
মি. ঝুনঝুনওয়ালার পরিচিত শুনে ওই চৌকিদার ওমনি সমুদার পা ধরে বলতে লাগল, “ক্ষমা করেন বাবু, আমি আসলে আপনাদের বুঝতে পারিনি। এখানে অনেকদিন হলো কোনও লোক আসে না, তাই ওইভাবে বলে ফেলেছি। আমারে ক্ষমা করেন”।
সমুদা ওকে ওর এই আচরণ পাল্টানোর পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি ওর নাম জিজ্ঞেস করল এবং তার উত্তরে ও বলল, “আমি হলাম মোহন, অনেক বছর ধরেই আমি আর আমার বউ, এই হোটেলের দেখাশোনার কাজ করি”।
হোটেলে ঢোকার সময় মোহনকে সমুদার প্রশ্ন, “আচ্ছা! মোহন, তোমাদের এই হোটেলের এইরকম অবস্থা কেন? এই হোটেলে আর লোক আসে না কেন বলতে পারো?”
মোহনের উত্তর, “বাবু, আমাদের এই হোটেলে নাকি ভূত আছে, তাই সবাই ভয় পায় এখানে আসতে”।
সেই শুনে আমি বলে উঠলাম, “কিন্তু মোহনদা, এখানে কি তুমি কোনওদিন ভূত দেখেছ?”
আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এল ওর স্ত্রী রেনুকা। সে বলল, “বাবু, দেখেছি বইকি বহুতবার দেখেছি। একজন সাফেদ শাড়ি পরা ওড়াত, রাতে ঘুরে বেরাচ্ছে এখানে”।
তার কথায় দেখলাম সমুদার তেমন বিশ্বাস হল না। তবে, তার অবিশ্বাসের মনোভাব সমুদা সবার সামনে প্রকট করল না, আমরা ঘুরে দেখলাম হোটেলটা।
মোহন আরও জানাল, “বাবু, আপনরা কি জানেন এই বাড়ি আসলে আগে হোটেল ছিল না। এটা আগে এক জমিদারের বাংলো ছিল, এখানে জমিদারের আমলে নানান সময় অনেক খারাপ কাজ হয়েছে কিন্তু সবই আমাদের কাছে অজানা”।
আমরা আরও কিছুটা সময় ওখানে ওই দম্পতির সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। আমাদের হোটেল ছিল ঠিক তাজমহল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। সেদিন সারা সন্ধ্যে আমরা হোটেলেই কাটিয়ে দিলাম এবং রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম কিন্তু ঘুম এল না সমুদার চোখে। আমি সমুদাকে এমন অস্বস্তিতে আগে কখনও দেখিনি।
তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “সমুদা, তোমার কি কিছু হয়েছে?”
সমুদা সেই উত্তর না দিয়ে বরং আমাকে বলল, “আচ্ছা! তোর কি রেনুকার কথায় বিশ্বাস হল? আমার পুরো ব্যাপারটাই কেমন ধোঁয়াশা লাগছে। কারণ রেনুকা যখন কথা বলছিল, তখন ওর চোখ কিন্তু অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর কেনইবা ও মোহনকে তোর প্রশ্নের উত্তর না দিতে দিয়ে, স্বয়ং নিজেই এগিয়ে এল?”
আমি বুঝলাম, তখন আমার ভাবনাটাই একদম সঠিক! আমার মন বলছিল সমুদা ওই মুহূর্তে, এই পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহের চোখে দেখছে।
ওই মুহূর্তে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে এখন কী করবে?”
সমুদার জবাব, “এখন সবার আগে ওই জমিদারের বিষয় জানতে হবে কারণ এই তাজমহলে ভূত ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক অজানা রহস্য”।
আমরা তখন আর এই বিষয় নিয়ে কথা না বাড়িয়ে, শুয়ে পড়লাম এবং আগামী দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
সকাল হতেই সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম আশপাশে ঘুরে ওই জমিদার সম্মন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে। অনেক জায়গায় ঘুরলাম কিন্তু ওনার সম্বন্ধে কেউই সঠিকভাবে কিছু বলতে পারল না। শুধু একটাই কথা সবার মুখে শুনলাম সেটা হল— উনি নাকি খুবই অত্যাচারী জমিদার ছিলেন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বেশ খিদে পাচ্ছিল আর তাই দুপুরের খাওয়া সারতে আমরা গিয়ে ঢুকলাম তাজমহলেরই সামনের এক দোকানে। খেতে খেতে আমি বললাম, “সমুদা, জমিদারের ব্যাপারে তো তেমন কিছুই জানা গেল না। তাজমহলে কি আদৌ কোনও রহস্য আছে? তুমি কী ভাবছ বলত?”
“না, রে। রহস্য তো আছেই। তবে, যতক্ষণ না এই জমিদারের বিষয় ভালোমতো জানতে পারছি, ততক্ষণ এই কেসে কোনোভাবেই এগোনো সম্ভবপর হচ্ছে না রে, বঙ্কু”।
সমুদার কথা শেষ হতে না হতেই আবারও এক কাণ্ড ঘটল সেখানে! আমাদের দুজনকে তাজমহল নিয়ে আলোচনা করতে দেখে দোকানের আরেক খদ্দের এগিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা! আপনারা কি সামনের ওই হোটেল তাজমহল নিয়ে আলোচনা করছেন?”
আমি তো তার কথা শুনে, ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে গেলাম কিন্তু সমুদা আমায় থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলল, “না! না! আমরা আগ্রার তাজমহল নিয়ে কথা বলছিলাম, আসলে আমার ভাইপো এই উল্টো দিকের তাজমহল লেখা হোটেলটার সাইন বোর্ড দেখে আগ্রার তাজমহলের কথা জানতে চাইল, তাই ওকে সেই ব্যাপারেই বলছিলাম”।
“আচ্ছা! এই তাজমহলেরও কি ওইরকম কোনও ইতিহাস আছে নাকি?” প্রশ্নটা সমুদা তার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিল এবং সেই উত্তরে ওই ব্যক্তি সমুদাকে বলল, “আছে বইকি, একশ’বার আছে মশাই”।
তারপর তিনি আরও জানালেন, “ওই হোটেল যেটা আপনারা দেখছেন, সেটা আসলে জমিদার জ্ঞানদাশঙ্কর রায়ের বাসভবন ছিল। এই বাংলোর দুটি ভাগ রয়েছে, একটি কিছু বছর আগেই ভেঙ্গে পরে যায় আর অপরটি এখন হোটেল হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ভেঙ্গে যাওয়া ভাগটি অর্থাৎ বাংলোর পেছনের অংশটাই ছিল বাড়ির অন্দরমহল আর সামনের দিকটা, জমিদারের বাড়িতে আসা লোকজনের স্বার্থেই ব্যাবহার করা হত”।
এইসব শুনে সমুদা তাকে ফের জিজ্ঞেস করল, “তাহলে ভূতবাড়ি বলে যে এই হোটেল এখানকার মানুষের কাছে প্রচলিত, তার ব্যাখ্যা আপনি কী দেবেন?”
এই কথার উত্তরে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “দেখুন, ভূত থাকতেই পারে কারণ উনি খুবই অত্যাচারী জমিদার ছিলেন। কতজনকেই না এর ভেতরে উনি খুন করিয়েছেন, তার আর কে খবর রাখতে গেছে বলুন”।
সব শোনার পর সমুদা তাকে বলল, “আপনার এই বিষয় এত জ্ঞান, তা আপনি কি এখানকার বাসিন্দা?”
তিনি ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, “আরে, না! না! মশাই। আসলে আমি ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসি, ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতেই আমার এখানে আসা সুতরাং এইসব ব্যাপারে খবর রাখি, আমার নাম তিঙ্করি মল্লিক। তা আপনাদের পরিচয়টা কি জানতে পারি?”
সমুদা তাকে আমাদের পরিচয় দিল এবং সেটা শোনার পর তিনি সমুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখানে ঘুরতে এসেছেন নাকি কোনও তদন্তের স্বার্থে?”
সমুদা সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিল, “না! ঘুরতেই এসেছি বলতে পারেন”।
তিঙ্করিবাবু আমাদের সঙ্গে আলাপ করে খুবই আনন্দিত হলেন এবং ওনার হোটেলে যাওয়ার জন্য আমাদের আমন্ত্রণও জানিয়ে গেলেন।
আমরা ওই দোকান থেকে বেরতেই, আবারও সেই পাঞ্জাবি লোকটিকে দেখতে পেলাম। সমুদার বুঝতে দেরি হয়নি যে ওই পাঞ্জাবি মুখোশধারী লোকটি আমাদের আসার দিন থেকেই, আমাদের উপর সর্বদা নজর রাখছে এবং এখন আমাদের আসল পরিচয় যেনে যাওয়ায়, রহস্য যে আরও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল, তা বলা বাহুল্য।
সমুদা আর আমি ফিরে এলাম হোটেলে এবং সেই রাতেই সমুদা জমিদার জ্ঞানদাশঙ্কর রায়ের বিষয় জানতে শিবুদাদুর সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। ওনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর, সমুদাকে বেশ গম্ভীর মুখে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে দেখলাম। আমি সেই বিষয় সমুদাকে জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর, “কেসটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে রে, বঙ্কু। তাই এর সমাধান করতে গেলে তিঙ্করি মল্লিককে আমাদের প্রয়োজন। অতএব আমাদের পরের কাজ হবে, তিঙ্করিবাবুর সঙ্গে ওনার হোটেলে গিয়ে দেখা করা”।
আমাকে শুয়ে পড়তে বলে সমুদা চলল হোটেলর বারান্দায়, আমি শুয়ে পড়লাম কিন্তু ঘুম এল না চোখে। আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল জানালায়, সেখান থেকে তাজমহলের চূড়াটা স্পষ্ট দেখা যেত। সেই চূড়ার দিকে তাকাতেই কেন জানি না মনে হতে লাগল, ওই রাতের অন্ধকার যেমনভাবে ঢেকে রেখেছে তার সৌন্দর্য, ঠিক একইভাবে ওই অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে তার কত অজানা রহস্য। তবে, বিশ্বাস ছিল সেই অন্ধকার দূর করতে পারবে সমুদা। সুতরাং সেই বিশ্বাস নিয়ে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
পরদিন ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই দেখি তিঙ্করিবাবু স্বয়ং আমাদের হোটেলে এসে উপস্থিত। এ যেন মেঘ না চাইতে জল! তিনি এসে সমুদাকে বললেন, “সমরেশবাবু, আপনাদের কি আজ সময় হবে? আসলে আমি এমন এক লোকের সন্ধান পেয়েছি, যিনি ওই জমিদারের বিষয় আমাদের আরও বেশ কিছু তথ্য দিতে পারবেন। যাবেন নাকি একবার সেখানে?”
তার কথা শুনে সমুদার বেশ আগ্রহ হল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তাই আমরা তিঙ্করিবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সেখানে পৌঁছে ওই লোকটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওনার মুখ থেকে শুনলাম, “দেখুন, প্রথমত এই জ্ঞানদাশঙ্কর রায় একজন অত্যাচারী জমিদার হলেও ওনার স্ত্রী বসুন্ধরা দেবীর প্রতি ওনার অজ্ঞাত স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল। দ্বিতীয়ত, ওনাদের কোনও সন্তান না থাকার কারণে ওনারা খুবই দুঃখী ছিলেন। অনেক মুনি ঋষির উপদেশ মতো কাজ করেও কোনও সুফল পাননি। ফলে, সেই দুঃখ কিছুটা ভোলাতে এবং ওনার স্ত্রীর তাজমহল দেখার বহুদিনের ইচ্ছাকে পূরণ করতে, জমিদার একদিন স্ত্রীকে নিয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আগ্রা পৌঁছানোর আগেই ওনার স্ত্রী এক মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেন, যার জন্য ওনারা ফিরে আসতে বাধ্য হন। জ্ঞানদাশঙ্কর, স্ত্রীর সেই ইচ্ছা পূরণ করতে না পারায়, তখনকার মালদার নামী স্বর্ণকারদের আগ্রার সেই তাজমহলের আদলেই একটি সোনার তাজমহলের মূর্তি, বানাবার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু যতদিনে ওই তাজমহল তৈরি হয়ে বাংলোতে এল, ততদিনে ওনার স্ত্রী দেহ রেখেছিলেন। আর ওই শোকে জমিদার ক্রমশই নানান বিষয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলেন। আমার বাপ-কাকারা তাঁদের ঠাকুরদাদের মুখে শুনেছিলেন যে স্ত্রীর মৃত্যুর পর উনি কিছুদিনের মধ্যেই ওনার স্ত্রীর সমস্ত পছন্দের জিনিস এক বাক্সতে পুরে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন মহানন্দার স্রোতে এবং নিজেও সংসার ত্যাগ করে চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ইতিহাসের পাতায়, সেই জমিদারের বিষয় আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না”।
তাহলে কি হলো সেই সোনার তাজমহলের?? সেই রহস্য কি বাংলোর ওই বিশেষ ভাগটির সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে গেছে, নাকি এটাকে কেন্দ্র করে, নতুন মোড় নিতে চলেছে আমাদের এই তাজমহল রহস্য?
ওই মুহূর্তে আমাদের সামনে বেশ অনেক তথ্যই উঠে এল, যা ঐতিহাসিক বললে ভুল হবে না। সুতরাং সব তথ্য পেয়ে যাওয়ার পর, ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম আমাদের হোটেলর উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাঝ পথেই তিঙ্করিবাবু তার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন, “আচ্ছা! সমরেশবাবু, তাজমহলের সেই ধ্বংসস্তূপ ভাগটি একবার দেখে ফিরলে হত না? এতকিছু জানার পর, সেখানে একবার ঢুঁ মেরে যাওয়ার লোভটা কিছুতেই সম্বরণ করতে পারছি না”। তিঙ্করিবাবুর কথায় দেখলাম সমুদাও রাজি সুতরাং আমরা আবারও চললাম হোটেল তাজমহল দেখতে।
তখন বিকেল হয়ে এসেছে, আমরা ওখানে যেতেই চোখে পড়ল একটা সাদা গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। আমরা তিনজনেই সোজা ঢুকে গেলাম এবং গিয়ে দেখি একজন ব্যক্তি সেখানে মোহনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
আমাদের আসতে দেখে ওই ব্যক্তি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনারা কারা?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা দেওয়ার আগেই, মোহন আমাদের হয়ে ওনাকে বলল, “আজ্ঞে, উনি হলেন বাবুর বন্ধু, সমরেশবাবু”।
বন্ধু শুনে ওই ব্যক্তি ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললেন, “আপনারা ঝুনঝুনওয়ালার দোস্ত আছেন, তা ওর দোস্ত মানে তো আমারও দোস্ত। কতদিন পর এখানে ওর কোনও খাস লোক এল”।
সমুদা ওনার কথা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করল, “আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। আপনি কে হন ওনার? আর এখানেইবা কী করছেন?”
উত্তরে উনি বললেন, “আমার নাম রামেশ্বর তেওয়ারী। এখানকার লোকেরা আমাকে ভালোবেসে তেওয়ারী শেঠ বলেই ডাকে। সবার খুব প্রিয় একজন মানুষ আমাকে বলতে পারেন। আমার সঙ্গে ঝুনঝুনওয়ালারও খুব ভালো সম্পর্ক আছে, তাই মাঝে মধ্যে এখানে এসে সাব কুচ্ছ ঠিক আছে কিনা দেখে যাই”।
তারপর উনি তিঙ্করিবাবু ও আমার দিকে তাকিয়ে সমুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওনাদের পরিচয় কী জানতে পারি, সমরেশবাবু?”
তিঙ্করিবাবু আর আমাকে দেখিয়ে সমুদা বলল, “উনি হলেন তিঙ্করি মল্লিক, এখানকার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে এসেছেন আর ও হল আমার ভাইপো, বঙ্কু”।
আমাদের পরিচয় জেনে তেওয়ারী শেঠ হাসতে হাসতে বললেন, “আচ্ছা! আচ্ছা! বহত খুব। বহত খুব। তাহলে একদিন আমার গারিবখানায় আসুন, ভালো করে গল্প করা যাবে। আপনারা কালই চলে আসুন, আপনাদের হোটেলে আমি কাল সকালেই গাড়ি পাঠিয়ে দেব”।
সমুদা আর না করতে পারল না। তেওয়ারী শেঠ অনেক অনুরোধ করায়, শেষে সে রাজি হতে বাধ্য হল। ঠিক হল আগামীকাল সকালে তেওয়ারী শেঠের গাড়ি এসে আমাদের ওনার বাড়ি নিয়ে যাবে।
তারপর উনি চলে গেলেন এবং আমরাও প্রবেশ করলাম তাজমহলের সেই ধ্বংসস্তূপ স্থানে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ায়, আমরা টর্চের সাহায্য নিলাম ঠিকই কিন্তু খুব একটা যে সুবিধা হল তা কখনই বলা যাবে না। তবে, খুবই খারাপ লাগছিল সেই দৃশ্য দেখে। কারণ এরকম ঐতিহ্য ভরা জায়গা যদি এইভাবে ধ্বংস হয়ে পড়ে থাকে, তাহলে কারইবা ভালো লাগে!
তবে, এখানে যেটা উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা হল আমরা যতক্ষণ ওখানে ছিলাম, ততক্ষণ ওখানে একভাবে দাঁড়িয়েছিল ওই দম্পতি অর্থাৎ মোহন ও তার স্ত্রী রেনুকা। আমরা তিনজন সেখান থেকে বেরিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে।
ফিরে এসে সমুদাকে দিনে হাজারও ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে কিছু উপলব্ধি হল কি না জানতে চাওয়ায় সে বলল, “বঙ্কু, আজ মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। কে এই তিঙ্করি মল্লিক? উনি কি আদৌ ইতিহাসের গবেষক, কী তার আসল পরিচয়? কেনইবা সে ওই লোকটার পরিচয় দিয়ে আমাদের সাহায্য করল? আবার কে এই তেওয়ারী শেঠ? কেন ওনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য উনি আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন? ওনার সাথে কি আদৌ মি. ঝুনঝুনওয়ালার ভালো সম্পর্ক রয়েছে? উনি তখন কী কথাইবা বলছিলেন মোহনকে, যার জন্য উনি আমাদের দেখামাত্রই হকচকিয়ে গেলেন? আর অবশ্যই, ওই সোনার তাজমহল কি কোনওভাবে এদের কারওর সঙ্গে জড়িয়ে? এই সব প্রশ্নের উত্তর একবার পেয়ে গেলেই, আমাদের এই রহস্য সমাধান হয়ে যাবে”।
সমুদার কথা শুনে আমারও কেন জানি না মনে হচ্ছিল, মি. ঝুনঝুনওয়ালার হোটেলের যত রহস্য, সব ওই সোনার তাজমহলকে ঘিরে।
পরদিন কথামতো তেওয়ারী শেঠের গাড়ি আমাদের হোটেলের সামনে এসে হাজির। গাড়িতে ওঠার সময় তিঙ্করিবাবুকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আমি সমুদাকে সেই বিষয় জিজ্ঞেস করতেই সে আমায় বলল, “বঙ্কু, তিঙ্করিবাবুর হঠাৎ এক জরুরি কাজ পরে যাওয়ায়, আজ আর তার যাওয়া হচ্ছে না রে। ভোরবেলা আমাকে তিনি ফোন করে সেটা জানিয়ে দিয়েছেন”।
সুতরাং আর দেরি না করে সমুদার সঙ্গে আমি, তেওয়ারী শেঠের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ওনার বাড়ি পৌঁছাতেই দেখি, বেশ কিছু লম্বা-চওড়া লোক পাহারায় দাঁড়িয়ে এবং তাদের মধ্যে থেকে দুজন আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। সেই বাড়ি যেন এক প্রাসাদ, কত ঘর আর কত কাজের লোক, সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
ভেতরে দেখলাম তেওয়ারী শেঠ সোফায় বসে গজল শুনছেন এবং আমাদের দেখা মাত্রই উনি টেপটা বন্ধ করে দিয়ে সমুদার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আইয়ে, আইয়ে, সমরেশবাবু। আমার এই গাড়িবখানায় আসতে আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?”
সমুদার উত্তর, “না! হয়নি। তবে, আমাদের এখানে ডেকে আনার আসল উদ্দেশ্যটা কী জানতে পারি?”
এবারে তেওয়ারী শেঠকে বলতে শুনলাম, “আ-হা! কামের কথা নয় পরে হবে, তার আগে আমাকে কুচ্ছ খাতিরদারি করতে দিন”।
কথা শেষ হওয়া মাত্রই উনি ওনার লোকেদের ইশারা করলেন এবং তারা আমাদের জন্য দইয়ের ঘোল আর মিষ্টি নিয়ে এল। আমি তো বেশ মুগ্ধ হলাম ওনার এই আপ্যায়ন দেখে! কিন্তু সমুদাকে লক্ষ করলাম, সে যেন পুরো বিষয়টাকেই সন্দেহের চোখে দেখছে।
এরপর নানান কথা বলতে বলতে উনি হঠাৎ সমুদাকে আমাদের এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন আর সমুদাও ওনাকে উত্তরে বলল, “ভাইপোকে নিয়ে মালদা আসব আগেই ঠিক করেছিলাম। তারপর মি. ঝুনঝুনওয়ালার থেকে ওনার হোটেল সম্বন্ধে শোনার পর, আর সেটাকে উপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না। চলেই এলাম সুজাপুর”।
তেওয়ারী শেঠ একটু থেমে বললেন, “বহুত খুব, বহুত খুব। তা ভাইপোকে নিয়ে এখানে হলিডে করুন, ইংলিশবাজারে আমার বাগানবাড়ি আছে, সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। আমি সব বন্দোবস্ত করে দিব। লেকিন খামকা ওই তাজমহলের ইতিহাস নিয়ে কেন পড়লেন?”
কথাটা শুনে সমুদা বুঝতে পারল এই তেওয়ারী শেঠ কোনও সাধারণ ব্যক্তি নয়, ওনার সব দিকেই বেশ নজর রয়েছে সুতরাং সমুদা ওনাকে হেসেই উত্তর দিল, “ভালোই খবর রাখেন দেখছি। তা আমার বিষয় এত খবর আপনাকে কে দিল, এই পাঞ্জাবি মুখোশধারী সুরজ?”
সমুদার কথা শুনে তো তেওয়ারী শেঠ একেবারে চটে লাল। তিনি বললেন, “সে যেই দিক। আপনার দেখার দরকার নেই। আপনাকে আমি আমার ইংলিশবাজারের বাগান বাড়ি থেকে ঘুরে আসার অফার দিচ্ছি। বলেন তো কুচ্ছ টাকাও দিতে পারি, যদি আপনি এই ডিটেকটিভগিরি বন্ধ করেন”।
সমুদা গম্ভীর স্বরে বলল, “আমাকে আপনার চেনা বাকি আর পাঁচজনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না তেওয়ারী শেঠ, অসৎভাবে টাকা রোজগার আমার রক্তে নেই”।
তেওয়ারী শেঠ আবারও একটু থমকে বললেন, “বহুত খুব, বহুত খুব। তা ভাইপোকে ভালোবাসেন তো? ওর যদি কিছু হয়ে যায়, নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?”
কথা শেষ হতে না হতেই সুরজ এগিয়ে এসে আমার মাথায় পিস্তল ঠেকাল আর সেই দেখে সমুদাও উঠে দাঁড়াল। আমি তখন বুঝতেই পেরেছিলাম এই কাজ উনি করাচ্ছেন শুধু সমুদাকে ভয় দেখানোর জন্য। আর ওদিকে সমুদাও ভাবল আমি ভয় পেয়েছি।
তাকে আমার দিকে এগতে দেখে তেওয়ারী শেঠ বলে উঠলেন, “আরে কী করছেন আপনি? কুচ্ছ নেহি হগা আপকা বঙ্কু কো। আমি তো সিফ্ বোঝাতে চাইলাম কী হতে পারে, যদি আমার কথা না শুনেন”।
এই বলে উনি সুরজকে আদেশ দিলেন, “সুরজ, ছোড় দো বাচ্চে কো। যান সমরেশবাবু, নিয়ে যান আপনার ভাইপোকে, আউর ইয়াদ রাখবেন ওই গোল্ড তাজমহল আমি ঠিকই পেয়ে যাব। তাই ওয়ান অ্যাডভাইজ, বেকার নিজেকে এর মধ্যে জড়াবেন না”।
এর উত্তরে সমুদা বলল, “উপদেশ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ কিন্তু মনে রাখবেন তেওয়ারী শেঠ, অসৎ ব্যক্তির কাছে যতই ক্ষমতা থাকুক না কেন, শেষে কিন্তু সত্যেরই জয় হয়”।
সমুদার কথা শুনে তেওয়ারী শেঠ হাসতে হাসতে বললেন, “সত্যের জয়? হা হা হা। দারুণ মজার কথা বলেন আপনি! তবে, সমরেশবাবু এরপর যেটা হবে তখন কিন্তু আপনি আমাকে কিছু বলতে পারবেন না। আমি আপনাকে আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি”।
“বিপদে পড়ে পিছিয়ে আসা আমার স্বভাব নয় তেওয়ারী শেঠ, খেলা সবে শুরু। কথাটা মনে রাখবেন”। এই কথা বলে সমুদা আমাকে নিয়ে তেওয়ারী শেঠের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এবং রাস্তায় যেতে যেতে সমুদা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “বঙ্কু, তুই ভয় পাসনি তো? আমি থাকতে তোর কিছু হবে না”।
না! আমি সত্যি পিস্তলের নলের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাইনি কারণ আমার বিশ্বাস আছে সমুদার উপর, যেই বিশ্বাসের মর্যাদা সমুদা এর আগেও রেখেছে।
হোটেলে ফিরে এসে সমুদাকে বেশ চিন্তিত লাগল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! তুমি কীভাবে বুঝলে ওই পাঞ্জাবি মুখোশধারী লোকটাই আসলে তেওয়ারী শেঠের সেই সুরজ?”
সমুদা আমার প্রশ্নের উত্তর দিল, “তুই কি আগে লক্ষ করেছিলিস ওই পাঞ্জাবি লোকটার গলার ডান দিকে একটা কাটা দাগ ছিল। আজ সুরজের গলার ডান দিকে ঠিক একই রকম জায়গায় ওই একই কাটার দাগটা আমি লক্ষ করলাম। ওর মুখটাও আমার কেমন যেন দেখেছি বলে মনে হল আর তাতেই দুয়ে-দুয়ে চার হয়ে গেল! রহস্যের জট এবার ক্রমশই খুলতে লেগেছে রে, বঙ্কু। এখন তাই তেওয়ারী শেঠকে আর হালকাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। ওনার পক্ষে যে কোনও কাজই করা সম্ভব। এখন বুঝতে পারছি এই পাঞ্জাবি মুখোশধারী সুরজই সব খবর ওনাকে পাচার করত, উনি আমার ব্যাপারে আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন আর তাই নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাদের সাবধান করে দেওয়ার সাথে সাথে হুমকিও দিয়ে রাখলেন”।
সমুদার কথা শুনে আমি ফের তাকে প্রশ্ন করলাম, “এবার কী করবে?”
উত্তরে সমুদা বলল, “এখন আমাদের দুটো কাজ। এক. সেই সোনার তাজমহলের সন্ধান করা। আর দুই. তিঙ্করিবাবুর আসল উদ্দেশ্য জানা”।
পুরো বিষয়টা শোনার পর আমার কেমন যেন সব জট পাকিয়ে গেল কিন্তু একটা কথা বুঝলাম, সেই সোনার তাজমহলকে কিছুতেই তেওয়ারী শেঠের মতো লোকের হাতে পৌঁছাতে দেওয়া চলবে না। সমুদা ঠিক করল ওই রাতে আমরা আবারও তাজমহলে যাব, ওখানকার রাতের গোপনীয়তা জানতে। সেদিন আর আমরা তিঙ্করিবাবুর টিকিও দেখতে পেলাম না। হতে পারে, তিনি আগে থেকেই তেওয়ারী শেঠের বিষয় অনুমান করতে পেরেছিলেন। আর এইভাবে ওনার বাড়ি যাওয়ার বিষয়টা তিনি এড়িয়ে যেতে পারলেন।
রাত তখন বারটা, চারিদিক নিস্তব্ধ আর এর মধ্যেই সমুদা আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাতের তাজমহল অভিযানে। তাজমহলের গেট দেখি বন্ধ কিন্তু ভেতরে রিশেপসনে আলো জ্বলছে।
সমুদাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! আমরা ঢুকব কীভাবে?”
সমুদা বলল, “আগে এখানটা ভালো করে দেখে নিই, তারপর পেছনের দেওয়াল টপকে ঢুকব”।
কথামতোই কাজ, আমরা নিঃশব্দে হোটেলের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আলো কম থাকায়, কিছুই ভালোমতো বোঝা যাচ্ছিল না। অবশেষে আমরা পেছনের দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রচুর নোংরা চারিপাশে কিন্তু সেই সব উপেক্ষা করেই সমুদা ওই দেওয়াল টপকাতে গেল, আর ঠিক তখনই তার পায়ে কীসে যেন ঠক্কর লাগল।
সমুদা নিচে নেমে আমার থেকে টর্চ চেয়ে নিয়ে ওই জিনিসটা কুড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ টর্চের আলোয় দেখার পর, আমাকে বলল, “বঙ্কু, এটা তো পুলিশের আইডেন্টিটি কার্ড রে। আর এতে তিঙ্করিবাবুর ছবিসহ তার নাম লেখা রয়েছে”।
কথাটা শোনা মাত্রই অবাক হয়ে গিয়ে বললাম, “তাহলে তিঙ্করিবাবু কি পুলিশের লোক?”
মাথা নেড়ে সমুদা বলল, “হুম! তিঙ্করিবাবু একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর, কোনও ইতিহাসের গবেষক নন। বরং আমার মনে হয়, তিনিও আমাদের মতো এই রহস্যের সমাধান করতে এখানে এসেছেন”।
সমুদা ওই আইডেন্টিটি কার্ডটা নিজের কাছেই রেখে দিল এবং দেওয়াল টপকে আমরা পেছনের বাগানে ঢুকলাম। সেখানে যা যা ভাঙ্গাচোরা জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তা আমরা সরিয়ে নেড়ে ঘেঁটে দেখলাম বটে কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কিছুই খুঁজে পেলাম না। শুধু চোখে পড়ল, এক জায়গায় মাটি খোঁড়া রয়েছে এবং সেটা যে বেশ অনেকটাই গভীর, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আমি সেই বিষয় সমুদার থেকে জানতে চাওয়ায় সে বলল, “এখন কোনও কথা নয়। যা কথা সব হোটেলে ফিরে হবে”।
আমি সেই শুনে চুপ করে রইলাম এবং সমুদার আজ্ঞা মতো কাজ করতে লাগলাম। তবে, এর মাঝেই হঠাৎ এক শব্দ আমাদের কানে এল, একটু কান পাততেই শুনতে পেলাম একজনের কান্নার আওয়াজ।
সেই আওয়াজ যে তিঙ্করিবাবুর, তা বুঝতে দেরি লাগল না। সমুদা আমার উদ্দেশ্যে বলল, “তিঙ্করিবাবুর গলা পেলাম মনে হল। চল তো দেখি, ওই দিকে কী ঘটছে”।
সেদিকে যেতেই লক্ষ্য করলাম, একটা বন্ধ ঘরের ভেতরে ছোট একটা আলো জ্বলছে আর সেই ঘরের সামনে বসে রয়েছে আমাদের পেছনে পড়ে থাকা ওই পাঞ্জাবি মুখোশধারী সুরজ। সমুদা আর আমার বুঝতে দেরি হল না যে তিঙ্করিবাবুকেই ওই ঘরে জোর করে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এবং সেই কাজ আর কারওর নয় স্বয়ং তেওয়ারী শেঠের।
আমরা সামনের বাগানে একটা গাছের আড়াল থেকে পুরো ঘটনাটার উপর লক্ষ রাখছিলাম। আরও কিছুটা সময় যেতে, আমরা দেখতে পেলাম সেখানে এসে হাজির হল মোহন ও তার স্ত্রী রেনুকা।
ওই দৃশ্য দেখে সমুদা বলল, “আমি যা ভেবেছিলাম তা একেবারেই মিলে গেল। এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে মোহন আর রেনুকাও জড়িত আছে”।
কথাটা শোনার পর আমি সমুদাকে একগুচ্ছ প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা! এরা এখানে কী করছে? আর কেনইবা তিঙ্করিবাবুকে বন্ধ করে রেখেছে? আমরা তাহলে কীভাবে ওই ঘর থেকে তিঙ্করিবাবুকে বের করব, সমুদা?”
এই সকল প্রশ্নের উত্তরে সমুদা শুধু বলল, “তোর এত প্রশ্নের উত্তর এখানে দেওয়া সম্ভব নয় রে, বঙ্কু। তবে এটা জেনে রাখ, আজ তিঙ্করিবাবুকে আমরা এখান থেকে নিয়েই ফিরব”।
কিন্তু তিনজনের মধ্যে দিয়ে তাকে আমরা কীভাবে উদ্ধার করব? এই প্রশ্নই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। তবে, সেই সময় সমুদাকে এই প্রশ্ন করার আর আমার সাহস হল না।
বেশ কিছুক্ষণ পর মোহন আর রেনুকা সেখান থেকে উঠে চলে গেল আর তারপর যেটা দেখলাম সেটা আরও অবাক করার মতো ঘটনা! ওরা সেই ধ্বংসস্তূপ স্থানে গিয়ে সেখানকার মাটি কোদাল দিয়ে খুঁড়তে শুরু করল, একইসঙ্গে সেই খোঁড়ার আওয়াজকে আড়াল করতে রেডিওয়ে গান চালিয়ে দিল।
এই মাটি খোঁড়ার আসল উদ্দেশ্যটা সমুদার আর বুঝতে সময় লাগল না। এদিকে, আমরা তখন দু-জনেই মুখে রুমাল বেঁধে নিলাম এবং ওই বাগান থেকে একটা লাঠি জোগার করে নিয়ে এগিয়ে গেলাম ওই ঘরের দিকে আর তারপর সুরজের অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগ নিতে অপেক্ষায় রইলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই সুযোগ আমাদের সামনে এসে উপস্থিত, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম সুরজের উপর। তাকে কিছু করার মতো সময় আমরা একদমই দিইনি, ফলে ওই আচমকা হামলায় সে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল।
কিছু মুহূর্তের মধ্যে, ওই পাঞ্জাবি মুখোশধারী সুরজ আমাদের হাতে বন্দি হয়ে গেল। সমুদার নির্দেশে আমি সুরজের কোমর থেকে ওই ঘরে চাবি নিয়ে ঘর খুলে, তিঙ্করিবাবুকে উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে এলাম।
তিঙ্করিবাবুকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল, সারাদিন কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি তাকে এবং ওই ঘরের এক কোণে বেঁধে তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন এই সুরজকে নিয়ে কী করব সেটাই প্রশ্ন!
আমরা তাকে ওই ঘরে একইভাবে বেঁধে রেখে এলাম। তবে, আমাদের ভাগ্য ভালো বলতেই হবে কারণ এতসব কাণ্ড ঘটে গেল আর সেই বিষয় বিন্দুমাত্র টের পেল না ওই দম্পতি। এর জন্য অবশ্য কৃতিত্ব দিতে হবে সেই রেডিওকে, জোরে গান চলায় ওরা হয়ত এই পুরো ঘটনাটা উপেক্ষা করে গেছে।
এবার আসা যাক তিঙ্করিবাবুর কথায়, তিনি পুরো ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছিলেন না, তাকে কারা এসে ওই ঘর থেকে উদ্ধার করল আর কেনইবা করল কিন্তু আমরা মুখ থেকে রুমাল সরাতেই, তিঙ্করিবাবু আমাদের চিনতে পারলেন এবং ওই মুহূর্তে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি ভুললেন না।
সমুদা তখন তাকে বলল, “তিঙ্করিবাবু, এখন আর এখানে বেশি কথা নয়। মোহনদের আসার আগেই চলুন এখান থেকে বেরিয়ে পড়া যাক”।
সমুদার কথামতো আমরা সেখানে আর কথা না বাড়িয়ে, সামনের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এলাম। এদিকে, ভোর হয়ে এসেছে, চারিদিকে কাক ডাকছে এবং সারারাত ধরে যে পরিশ্রম করলাম তার ক্লান্তি ভাব কাটাতে আমরা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। সমুদা ও তিঙ্করিবাবু সেখানে চা খেলেন আর আমি খেলাম শুধু বিস্কুট। রাতের সব ঘটনা যেন আমার চোখের সামনে তখনও ভাসছিল।
ওই দোকান থেকে বেড়িয়ে আমরা সোজা আমাদের হোটেলে গেলাম এবং তিঙ্করিবাবুও গেলেন আমাদের সঙ্গে। সমুদাই তাকে আমাদের সঙ্গে যেতে বলল, “তিঙ্করিবাবু, আপনার অসুবিধা না থাকলে একবার আমাদের সঙ্গে আমাদের হোটেলে চলুন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে”।
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। চলুন, সমরেশবাবু, আমার কোনও সমস্যা নেই। তবে, আপনাদের রুমে যাওয়ার আগে রাস্তাতেই এই ধুলো-ময়লাগুলো কিছুটা পরিষ্কার করে নিলে ভালো হতো না?”
তিঙ্করিবাবুর কথামতো হোটেল পৌঁছে আমি গেলাম স্নানে এবং সমুদা ও তিঙ্করিবাবু নিজেদের মুখ হাত-পা ধুতে গেল হোটেলের কলপাড়ে। সব সেরে তারা যখন হোটেলের ঘরে ফিরে এল তখন সমুদা তাকে প্রশ্ন করল, “তাহলে তিঙ্করিবাবু, আপনি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমার কাছে এই পরিচয়টা আপনি ঠিক কী কারণে গোপন করলেন জানতে পারি?”
উত্তরে তিঙ্করিবাবু বললেন, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। সমরেশবাবু, আমি একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর আর এই তাজমহলের ভেতর ঘটে যাওয়া খুনের তদন্ত করতেই এখানে এসেছি। এই কেসের স্বার্থেই নিজের পরিচয় গোপন করতে আমি বাধ্য হয়েছি। কিন্তু আপনি এইসব ধরলেন কীভাবে?”
সমুদা একটু হেসে বলল, “আপনি যে ইতিহাসপড়ুয়া লোক নন, তা আমি অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম কিন্তু আপনি যে ইন্সপেক্টর সেটা জানতে পারলাম গতকাল রাতে যখন তাজমহলে ঢোকার সময় আপনার এই আইডেন্টিটি কার্ডটা খুঁজে পাই। এটার সাহায্যেই আপনার আসল পরিচয়ের সঙ্গে এটাও বুঝলাম যে আপনি তখন আশপাশেই কোথাও রয়েছেন”।
কথা শেষ হতেই, আইডেন্টিটি কার্ডের সঙ্গে সমুদা আরও একটা কাগজ তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এটাই তো সেই সার্চ ওয়ারেন্ট তাই না?”
তিঙ্করিবাবু সমুদার থেকে জিনিসগুলো নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। এটাই সার্চ ওয়ারেন্ট, ধন্যবাদ সমরেশবাবু। তবে, আপনিও কি এই কেসের তদন্তে এখানে এসেছেন?”
সমুদা বলল, “হুম! আমিও এসেছি তাজমহলের রহস্যের সমাধান করতে। তবে, কোনও খুনের নয়, এখানে থাকা ভূতের। হোটেলের মালিক মি. ঝুনঝুনওয়ালাই আমাকে এই তদন্তের ভার দিয়েছেন”।
তারপর তিঙ্করিবাবু সেদিনের ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনার কথা খুলে বললেন। তার কথা অনুযায়ী, তিনি হোটেলে তদন্ত করতে যাওয়ার স্বার্থেই আমাদের সঙ্গে তেওয়ারী শেঠের বাড়ি যেতে পারেননি।
তিনি আরও বললেন, “আপনাদের বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা পর আমি তাজমহলে প্রবেশ করি আর একাই ঢুকে যাই ওই ধ্বংসস্তূপ স্থানে। তবে, আমাকে ঢুকতে দেখে মোহন আর রেনুকা, দু-জনেরই হয়ত মনে সন্দেহ জাগে। ফলে, তারা সেই বিষয় আমার কাছে জানতে চাওয়ায়, আমি তখন তাদের বলি যে জমিদারের বিষয় নানা তথ্য সংগ্রহ করতেই আমার আসা কিন্তু এই উত্তর ওই দম্পতির মন সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলেই আমার ধারণা। আর তাই, তারা আমার ওপর সর্বদা নজর রাখছিল। আমি ওইসবের মাঝেই একটা ডায়েরি খুঁজে পেয়েছিলাম এবং খুব সতর্কভাবে সেটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটেও ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম”।
তিঙ্করিবাবু একটু থেমে ফের বললেন, “কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে আরও কিছু লোক এসে আমাকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল আর কথা বলতে বলতে হঠাৎ তারা আমাকে চেপে ধরল। পেছন থেকে এসে মোহন বাকিদের সাহায্যে আমায় দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল আর তারপর সেই বাগানের ঘরে নিয়ে গিয়ে আমায় বন্দি করে রাখল। সন্ধ্যের দিকে ওই দম্পতি সুরজকে খবর দেওয়ায়, সেও ওখানে এসে হাজির হয়”।
তিঙ্করিবাবুর কথা শেষ হল ঠিকই কিন্তু এখন কথা হল, ওনার কুড়িয়ে পাওয়া ডায়েরিটা আসলে কীসের? সব ঘটনা জানানোর পর তিঙ্করিবাবু সেই ডায়েরি সমুদার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “সমরেশবাবু, ডায়েরিটা আপনার কাছে রাখুন। এটা হয়ত অনেক অজানা পথের সন্ধান দিলেও দিতে পারে, যা রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশ কিছুটা কাছে পৌঁছে দেবে”।
তিঙ্করিবাবুর থেকে ওই ডায়েরি নিয়ে সমুদা নিজের কাছেই রেখে দিল। তারপর আরও কিছু কথাবার্তা সেরে আমরা গেলাম সকালের জলখাবার সারতে, খাওয়ার পর তিঙ্করিবাবু ফিরে গেলেন তার হোটেলে এবং আমরাও ফিরে এলাম হোটেলের ঘরে।
সমুদা সারা দুপুর ওই ডায়েরি নিয়ে বসে রইল আর আমি দুপুরের খাওয়ার পর একটু শুয়ে জিরিয়ে নিলাম। তবে, আমার মাথায় সেই ডায়েরিকে কেন্দ্র করে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। কী থাকতে পারে সেই ডায়েরিতে? কারইবা হতে পারে সেই ডায়েরি? সেই ডায়েরি কি এই রহস্যে নতুন কোনও মোড় আনবে?
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এদিকে সমুদার ওই ডায়েরি পড়াও শেষ কিন্তু তখনও আমার ঘুম ভাঙ্গেনি। আমাকে সমুদা ঘুম থেকে উঠিয়ে বলল, “শোন বঙ্কু, আজ অনেক কাজ আছে আর সব কাজ রাতের মধ্যেই সারতে হবে”।
সেই শুনে আমি সমুদাকে ওই ডায়েরির বিষয় প্রশ্ন করলাম কিন্তু সে স্পষ্ট করে কিছুই বলল না। শুধু বলল, “যা জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে, এখন শুধু মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল অপরাধীদের টেনে বার করতে হবে”।
সমুদার কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, রহস্যের সমাধান সে করেই ফেলেছে সুতরাং ওই রাতই যে হতে চলেছে এই রহস্যের অন্তিম পর্ব, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এত সহজেই কি মিটে যাবে এই রহস্য? না! একবারেই নয়, এই রহস্য যে এত সহজে মেটার নয়, তা সমুদা ভালোভাবেই জানত। ফলে, ওই ডায়রি হাতে পাওয়ার অনেক আগেই সে মি. ঝুনঝুনওয়ালাকে সুজাপুর চলে আসার জন্য অনুরোধ করেছিল এবং উনিও যে সুজাপুর চলে এসেছেন, তা বলতে দ্বিধা নেই।
সমুদা বিকেলেই তিঙ্করিবাবুকে বলে দিয়েছিল যাতে ওই রাতে তিনি তার ফোর্স নিয়ে চলে আসেন এবং সমুদার ইশারা পাওয়া মাত্রই হোটেল তাজমহলকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেন, যাতে দোষীরা আর সেখান থেকে পালাতে না পারে। তারপর আর দেরি নয়, সমুদা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম এই গল্পের শেষ গন্তব্য স্থান অর্থাৎ তাজমহলের সেই ধ্বংসস্তূপ স্থানের উদ্দেশ্যে।
আমরা পৌঁছে দেখি, তেওয়ারী শেঠের গাড়ি অনেক আগেই সেখানে এসে হাজির। সমুদা বিষয়টা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল। কারণ এই রহস্যের আসল কাণ্ডারী যে তেওয়ারী শেঠ, সেটা এতদিনে আমরা খুব ভালো মতো বুঝে গিয়েছিলাম সুতরাং আমরা খুব সতর্কভাবে তাজমহলে ঢুকলাম। কিন্তু হঠাৎ ভীষণ এক চেনা গলার স্বর কানে ভেসে এল, “আইয়ে, আইয়ে, সমরেশবাবু। আপনার জন্যই তো এখানে ইন্তেজার করছি”।
এই গলার স্বর যে তেওয়ারী শেঠের, তা আমরা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। উনি আগেই আমাদের এখানে আসার কথা টের পেয়ে গিয়েছিলেন ফলে, কিছু মুহূর্তের মধ্যে দু-জন লম্বা-চওড়া লোক এসে আমাদের ওই বাগানে ধরে নিয়ে গেল এবং সেখানে গিয়ে আমরা তো অবাক!
হ্যাঁ! অবাক হলাম তিঙ্করিবাবু ও মি. ঝুনঝুনওয়ালাকে সেখানে বাঁধা অবস্থায় দেখে। তাদের পাহারায় তখন সেই পাঞ্জাবি মুখোশধারী সুরজ ও তার সঙ্গে ওই দম্পতি, অর্থাৎ মোহন আর রেনুকা। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে তিঙ্করিবাবু আবারও ওই দুষ্টু লোকগুলোর হাতে বন্দি হয়েছেন, সেই সঙ্গে আমার চিন্তাও হচ্ছিল এই ভেবে যে এবার আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে কে উদ্ধার করবে?
তেওয়ারী শেঠ সমুদার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি কি ভেবেছিলেন, এত সহজেই আমায় হারিয়ে দেবেন? আমিও গোয়েন্দা দিমাগ রাখি সমরেশবাবু, তাই এই খেলায় আপনি হেরে গেলেন। হা হা হা”।
এর উত্তরে সমুদা ওনাকে শুধু বলল, “এত সহজে আমি হাল ছাড়ি না তেওয়ারী শেঠ, খেলা এখনও বাকি”।
তেওয়ারী শেঠ ও ওনার লোকেরা সমুদার কথা শুনে হেসে উঠল এবং তাকে ব্যঙ্গ করতে লাগল। এরপর তেওয়ারী শেঠ ওনার অনুচরদের নির্দেশ দিলেন, “সুরাজ সাবকো উস কামরে মে বান্ধ কার দো আউর ভীম সিং, তুম আপনা কাম শুরু কারো। মুঝে তাজমহল আজই চাহি হে, আজ হি”।
কথা শেষ করে তেওয়ারী শেঠ মোহনের সেই রেডিওটা জোরে চালিয়ে দিয়ে হোটেলের ভেতর ঢুকে গেলেন। এদিকে, বাগানের ওই ঘরে আমাদের বন্ধ করে রাখার দায়িত্বে কেবল সুরাজই ছিল তেমনটা নয়, মোহন আর রেনুকাও ছিল ওর সঙ্গে। আর অন্যদিকে, ভীম সিং তার আরেকজন সাগরেদকে নিয়ে সেই সোনার তাজমহলের খোঁজে মাটি খোঁড়ার কাজ আরম্ভ করল।
কিন্তু আমাদের ওই ঘরে ঢোকানোর সময় কাকতালীয়ভাবে ঘরের আলোটা গেল নিভে আর তখনই শুরু হল এক হুলুস্থুল কাণ্ড! সেই কাণ্ড যে একমাত্র সমুদার দ্বারাই ঘটানো সম্ভব, তা আমি জানতাম।
ঘর অন্ধকার হওয়ার আগে সমুদা লক্ষ করেছিল যে ঘরের ডান দিকের লম্বা তাক বরাবর অনেকগুলো অব্যবহৃত পুরনো মশলার কৌটো রাখা রয়েছে। ফলে, ওই অন্ধকারের মধ্যে কোনও রকমে হাত বাড়িয়ে একটা কৌটো নিজের অধীনে আনতে সে সক্ষম হয়েছিল এবং তারপর সেই কৌটোতে কী আছে, তা সে না জেনেই কৌটো খুলে ওই বদমাশগুলোর উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিল। কৌটোর মধ্যে ছিল শুঁকনো লঙ্কার গুড়ো!
যেই লঙ্কার গুড়ো চোখে যেতেই ওরা সকলে চিৎকার করতে লাগল, “ওরে বাপ রে, জলে গেল সব। মোরে গেলাম, মার গায়া, মার গায়া”।
ওই মুহূর্তে সমুদা তৎক্ষণাৎ আমায় বলল, “বঙ্কু, তাড়াতাড়ি গিয়ে তিঙ্করিবাবু আর মি. ঝুনঝুনওয়ালার বাধন খুলে দে। আমি ততক্ষণ এদের ব্যবস্থা করছি”।
সমুদার কথামতো আমি দৌড়ে গিয়ে তাদের বাঁধন খুলে দিলাম এবং সবাই মিলে সমুদার সঙ্গে ওই সব কটা শয়তানকে তাদেরই আনা দড়ি দিয়ে বেশ ভালো করে বেঁধে ওই ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিলাম। এর মাঝেই থানা থেকে তিঙ্করিবাবুর পুলিশ ফোর্স এসে হাজির এবং তার নির্দেশেই ওই পুরো চত্বরটা তারা ঘিরে ফেলল।
এবারে আসা যাক আসল খলনায়ক অর্থাৎ তেওয়ারী শেঠের কথায়, উনি এতক্ষণ ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনারই বিন্দুমাত্র টের পাননি। তার প্রধান কারণ অবশ্যই, সেই রেডিও আর সেই স্থানে ওনার অনুস্থিতি।
ওনার সামনে সমুদাকে যেতে দেখে তেওয়ারী শেঠ কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “সুরজ, মোহন, রেনুকা তুম সাব কাহা হো? কৈইসে ইয়ে লোগ বাহার আয়া?”
সমুদা ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কেউ আর এখানে আপনার কথা শুনতে আসবে না তেওয়ারী শেঠ। সবাই এখন লঙ্কার ঝালে জ্বলছে! আপনি এতক্ষণ ওখানে ঘটে যাওয়া কোনও কিছুই টের পাননি। এর জন্য অবশ্য আপনাকে আর আপনার ওই রেডিওকে কৃতজ্ঞতা জানাব। এটাকেই তো আপনি মাটি খোঁড়ার শব্দকে আড়াল করতে ব্যবহার করতেন?”
হ্যাঁ! তেওয়ারী শেঠ ওনার পরিকল্পনা অনুযায়ী রেডিওটা ব্যাবহার করতেন, ওই মাটি খোঁড়ার শব্দকে আড়াল করতে কিন্তু কী অদ্ভুতভাবে সেই একই শব্দকে আড়াল করতে গিয়ে উনি আজ স্বয়ং নিজেরই বিপদ ডেকে আনলেন।
সমুদার কথা শুনে তেওয়ারী শেঠকে লক্ষ করলাম উনি রেগে গিয়ে ওনার দুই মাটি খোঁড়ার লোককে আদেশ দিলেন, “ভীম, তুম দোনো যাও পাকড়ো উসকো”। কিন্তু ওই দুজন সমুদাকে ধরতে যাওয়ার আগেই, সেখানে পুলিশ এসে তাদের গ্রেপ্তার করে ফেলল।
তিঙ্করিবাবু ওনার সামনে গিয়ে বললেন, “এবার আপনার খেলা শেষ তেওয়ারী শেঠ। এখন আপনাকে কে বাঁচাবে?” সকলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন তেওয়ারী শেঠ।
সেখানে উপস্থিত মি. ঝুনঝুনওয়ালার উদ্দেশ্যে সমুদাকে বলতে শুনলাম, “মি. ঝুনঝুনওয়ালা, আপনার দোষী আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। এই তেওয়ারী শেঠই হল এই রহস্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা আসল অপরাধী। উনি সোনার তাজমহলের লোভে এইসব কিছু ঘটিয়েছেন। এখানে কোনওদিনই ভূত ছিল না, পুরোটাই ছিল ওনার সাজানো পরিকল্পনা। উনি রেনুকাকে সাদা শাড়ি পড়িয়ে ব্যাবহার করতেন ভূত সাজিয়ে, যাতে কেউ ভয়ে এই হোটেলের আশপাশে কখনো ঘেঁষতে না পারে আর ওই সুযোগে তেওয়ারী শেঠ, ওনার বাকি লোকেদের দ্বারা এই মাটি খুঁড়ে সেই সোনার তাজমহল হাতিয়ে নিতে পারেন”।
মি. ঝুনঝুনওয়ালা সব শুনে বললেন, “কেয়া বলু আপকো, সত্যি! সমরেশবাবু আপনার তারিফ না করে থাকতে পারছি না”।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, গল্প এখনও বাকি। সমুদা তাই বলল, “তিঙ্করিবাবু, যেই ব্যক্তি এখানে মারা গিয়েছিলেন তিনি এক দিক থেকে দেখতে গেলে খুনই হয়েছিলেন, কারণ ওই ঘটনার পেছনে এই মোহন আর রেনুকার হাত রয়েছে। আমার ধারণা, মোহন তার কানে নানান ভূতের অবাস্তব কাহিনি বলে তাকে ভয় পাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে এবং রাত হতেই রেনুকা, ভূতের সাজে তাকে এমন ভয় পাওয়াল যে সেই ভয় থেকেই তার হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যায়! এই সব কিছুর পেছনে রয়েছে একটাই মাথা, এই তেওয়ারী শেঠ”।
আর দেরি না করে তিঙ্করিবাবু তেওয়ারী শেঠকে গ্রেপ্তার করলেন এবং ওনাকে পুলিশ ভ্যানের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ভ্যানে ওঠানোর সময় দেখলাম সমুদা তাকে থামিয়ে বলল, “তেওয়ারী শেঠ, যেই কারণের জন্য আজ আপনার এই পরিণতি হল, সেই সোনার তাজমহল আদৌ এখানে রয়েছে কি না, সেটা যাওয়ার আগে যেনে যান”।
সমুদার কথা শেষ হতেই তিঙ্করিবাবু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “সমরেশবাবু, তাহলে কি তাজমহলটা এখানে নেই?”
সমুদার উত্তর, “না! নেই। সেই সোনার তাজমহল অনেক কাল আগেই বাক্সবন্দি হয়ে মহানন্দার স্রোতে ভেসে গেছে”।
সমুদা আরও জানাল, “ওই ডায়েরি পড়ে আমি জানতে পেরেছি, জমিদার ওনার স্ত্রীর সমস্ত জিনিসের সঙ্গেই ওই সোনার তাজমহল ভাসিয়ে দিয়েছিলেন কারণ জমিদার চাননি সেই সোনার তাজমহল অন্য কারওর হাতে গিয়ে উঠুক, যেখানে ওনার স্ত্রী সেটা একবারও নিজের হাতে স্পর্শ করে যেতে পারেননি। উনি ওনার জীবনের ভালোবাসা এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছে, সবটাই সেই সোনার তাজমহলের দ্বারা মহানন্দার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন”।
সব শোনার পর সেখানে উপস্থিত সকলকে দেখে মনে হচ্ছিল, জমিদারের স্ত্রীর প্রতি ওনার ভালোবাসা দেখে সকলেই যেন সেই আবেগে ভেসে গিয়েছিল। সত্যি! এইরকম ভালোবাসাই তো আমাদের সকলের মনের মধ্যে দিয়ে সারাজীবন অমর হয়ে থাকে। আর এর সঙ্গেই এই তাজমহল রহস্যের সমাধান করতে সক্ষম হল সমুদা।
সে আবারও প্রমাণ করল নিজেকে এবং অবশ্যই বলতে হবে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কথা। হ্যাঁ! সেই মশলার কৌটোগুলো সমুদা দেখতে পেয়েছিল বলেই আজ অপরাধীরা তাদের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছাতে পেরেছে। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমরা সবাই ফিরে গেলাম হোটেলে এবং তিঙ্করিবাবু, তেওয়ারী শেঠ সমেত ওনার বাকি অনুচরদের নিয়ে গেলেন থানায়।
সমুদার কথামতো মি. ঝুনঝুনওয়ালা আমাদের ফেরার সব ব্যবস্থা করে ফেললেন এবং পরদিনই আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। স্টেশনে পৌঁছে দেখি, সেখানে তিঙ্করিবাবু আগেই এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
সমুদা ওই ডায়েরি তাকে ফিরিয়ে দিল এবং সেটি হাতে নিয়ে তিঙ্করিবাবু, সমুদাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না। তিনি বললেন, “আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল সমরেশবাবু, আপনার জন্যই আজ এই অপরাধীরা ধরা পড়ল এবং এই তদন্ত এত তাড়াতাড়ি মিটল। আপনার মতো এইরকম সাহসী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি আছে বলেই, আমাদের পক্ষে এই কুখ্যাত অপরাধীদের ধরতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হল না”।
তিঙ্করিবাবুর কথা শুনে সমুদাও তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না, “আপনিও না থাকলে আমি এই কেস এত তাড়াতাড়ি সমাধান করতে পারতাম না, তিঙ্করিবাবু। সুতরাং এই রহস্য সমাধানের কৃতিত্ব আপনারও সমান প্রাপ্য। আপনি প্রথম থেকে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। আপনার জন্যই সেই ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছিলাম, যার দেওয়া তথ্য পরবর্তী সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আর অবশ্যই ওই ডায়রি”।
এরপর আর ফিরে দেখা নয়, আমরা ট্রেনে উঠে পড়লাম এবং মালদাকে বিদায় জানিয়ে এসে পৌঁছালাম কলকাতায়। আমাদের আসার আগাম খবর পেয়ে, বাবা স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছিল এবং আমাদের দেখা মাত্রই সে খুবই আনন্দিত হল। আজ তার আমাকে নিয়ে চিন্তার অবসান ঘটল, যেই চিন্তা আমাদের মালদা যাওয়ার সেই প্রথম দিন থেকে তার শুরু হয়েছিল।
গাড়িতে মি. ঝুনঝুনওয়ালা ও আমার মুখে সব গল্প শোনার পর, বাবার মুখের হাসি দেখেই অনুমান করতে পারছিলাম যে তার হাসির মধ্যে মিশে রয়েছে অদ্ভুত এক আনন্দ ও গর্ববোধ। হ্যাঁ! যেই গর্ববোধ অবশ্যই তার ভাই সমু আর আমার সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ার জন্য।
সেদিন আর শিবুদাদুর সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না, তবে দু-একদিনের মধ্যেই ওনার সঙ্গে দেখা করে এলাম এবং উনিও যে আমাদের কাজে খুশি হয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এক মাস পর, পাড়ার টুর্নামেন্ট বেশ ভালোভাবেই আয়োজন করতে সক্ষম হল সমুদা। এবার সে খেলতে না নেমেও যেভাবে গোল দিল, তার ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। গোল যে শুধু খেলার মাঠেই দেওয়া যায়, সেই ভাবনা আমার সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করল সমুদা। রহস্য সমাধান থেকে শুরু করে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, এই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই সমুদা ফুটবলের ভাষায় যাকে বলে কখনো ইনসাইড ডজ তো আবার কখনো আউটসাইড ডজে একের পর এক বাধাকে টপকে যেভাবে সফল হল, তা সত্যি প্রশংসনীয়। সে এই জীবনের খেলায় বলা যায়, বুলেটর মতো শটে জাল কাঁপাল।
অতএব শেষে ইশ্বরের কাছে তাই এটাই প্রার্থনা করি, যাতে সকলের আশীর্বাদ ও ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে সমুদার সঙ্গে আমি বঙ্কু, এইভাবেই যেন এগিয়ে যেতে পারি জীবনের আরও অনেক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির অনুসন্ধানে।
(সমাপ্ত)