অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খসরু পারভেজ -
এলিজা খাতুনের “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি” : একটি নিবিড় পাঠ

এলিজা খাতুনের “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি” : একটি নিবিড় পাঠ
খসরু পারভেজ

মাটিলগ্ন এবং স্বকীয়তায় উজ্জ্বল কবি এলিজা খাতুন,  যিনি ভালো গল্পও লেখেন। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। গল্পে তিনি শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কথা বলেন বরাবরই। কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি ব্রাত‍্যজীবনের কাছে নিবেদিত। জীবনযন্ত্রণায় দগ্ধ সমাজের অন্ত‍্যজশ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষা তাঁর শিল্পিত চেতনায় ধরা পড়ে। কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রেও তার যথার্থ প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেছেন, “সেদ্ধধানের ভাপে যাদের সমস্ত মুখ কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর হয়ে ওঠে, অথবা তুষপোড়া আগুনের আলোয় যাদের চোখের কোণে গোধূলি জমতে থাকে তাদের প্রতিফোঁটা ঘামবিন্দুর প্রতি।”  উৎসর্গপত্রের এই অভিব‍্যক্তিই বলে দেয় কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থে কতখানি হৃদয়সংবেদী।

বইমেলা ২০২৩ এ ‘অনুপ্রাণন’ থেকে প্রকাশিত এলিজা খাতুনের নবম কাব্যগ্রন্থ “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি” সাক্ষ্য দেয় এলিজার কবিতা মৃত্তিকাগন্ধী। জীবনশেকড় ও মাটির প্রলেপ মাখানো এসব কবিতা জীবনের ভাঁজ খুলে খুলে আমাদেরকে দেখায়। শিরোনামের কবিতায় কবি বলেছেন:

” লাঙল ফলার কর্ষণে কতখানি ব্যথা, জানে মাটি
কতটা সহনীয় হলে বৃক্ষ শেকড় ছড়ায়
কতটা বুকের রক্ত নিংড়ে দিলে ধানের অন্তঃকোণে
দুধ জমা হয় — মাটি জানে ও মানে

মাটির মতো দরদী কে আর আছে!
তুমুল কর্ষণের অপেক্ষায় পৃথিবীর জমিন ও সময়

(চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি)

চিটেধান,প্রার্থনামগ্ন মাটি || এলিজা খাতুন || অনুপ্রাণন প্রকাশন, বি৬৩-৬৪ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, কাঁটাবন, ঢাকা। প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান || মূল্য: ২৪০ টাকা।

মাটির প্রার্থনায় চিটেধান পরিপুষ্ট হয়, দুধ জমে হয় ধান; যা আমাদের জীবনকে বাঁচায়। মাটিই তো শত যন্ত্রণা সহ্য করে ফসল ফলায়, ফুল ফোটায়। ধানের ভেতরে জমে থাকা দুধ সে তো মাটির রক্ত। মাটিকে  মানুষ তাকে ভালোবাসুক, সমীহ করুক। কী চমৎকার বোধ!

এলিজার কবিতায় যতখানি কবি-কল্পনা, শিল্পের মাধুরী, তার চেয়ে বেশি মূর্ত চারপাশের দুঃখ-বেদনা, অসঙ্গতির চিত্র বা সময়ের ক্ষরণ। দুঃসময়, পৃথিবীর অসুখ কবিকে বিচলিত করে। তিনি বলেন-

” বেড়ে চলেছে পৃথিবীর অসুখ
খোলা মাঠ আর দিগন্তকে ছুটি দিয়ে
মৃত্যুর নদী বয়ে যায় — ভেতরে, বাহিরে”

(অন্তর্গত আশ্বাস)

অথবা

“স্বপ্ন-শরীর ছটফট করছে, কাতরাচ্ছে ভীষণ
অবশেষে মারা যাবে হয়ত ঘাম চোয়া ক্ষত-বিক্ষত স্বপ্নেরা
চার রাস্তার মোড়ে কিছু জীবন্ত স্বপ্নদের
অপেক্ষা -আহাজারি তবু দারুণ বিশ্বাসে!

(শীঘ্রই আসবে অ্যাম্বুলেন্স)

সমকালে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সাধারণ মানুষের হাহাকার কবির কবিতায় উচ্চকিত। তিনি সরাসরি বলেন-

“পাতা পচে গেলে
মাটিতে তার শিরা উপশিরা
থাকে কিছুদিন কঙ্কালের মতো

দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী তাণ্ডবে
ক্ষুধা ও স্বপ্ন গুড়িয়ে শূন্যে মিশে গেলে
মানুষের শরীরের মতো-
হৃদয় কি কঙ্কাল হয়!”

(কঙ্কাল)

সমকালে আকাশচুম্বী এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে দুর্দশা, সেটা ভুক্তভোগীর মুখ দিয়ে বলান-

“আমরা পরস্পরের ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে
সঞ্চয় করে চলেছি অশনি সংকেত
মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির সংলাপ শুনি
দগ্ধ-চূর্ণ প্রাণ নিয়ে, খাঁ খাঁ তপ্ত উদর নিয়ে”

(নিশ্চিতভাবে চাই)

এরপরই তিনি বলেন-

“শুধু সংলাপে বদলে ফেলা যাবে কি এ-সব ক্ষতচিত্র!
আমরা বললাম -“প‍্যাটের তাগিদে রাস্তায় বের হইছি”
আমাদের পথ মৃত্যুর খুব কাছাকাছি গেলেও
আমাদের পেট বাঁচতে চায়। যন্ত্রণার হাত থেকে”

(নিশ্চিতভাবে চাই)

কবি এলিজা খাতুন।

কবিতায় “প‍্যাটের তাগিদে রাস্তায় বাইর হইছি”, এই একটি বাক‍্য থেকেই যেন ক্ষুধার্ত বাংলার রূপ ফুটে ওঠে। এখানেই কবির কৃতিত্ব ।

কবি জানেন, কতিপয় দানব-স্বভাব বিনাশের গভীর প্লাবন এসে গেছে এই পথে। এই প্লাবন ঠেকাতে তিনি নগরের ক্রমশ বেড়ে ওঠা কতক অপচ্ছায়াকে বললেন তাদের কর্মকাণ্ড থামাতে। এই আপচ্ছায়া কারা, এটা আমাদের জানতে বাকি থাকে না। এই অপচ্ছায়া তারাই, যারা সিন্ডিকেট গড়ে তোলা অবৈধ মজুদদার, অসাধু ব‍্যবসায়ী, যারা সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে সম্বল করে কালো টাকার পাহাড় তোলে।

কবির কবিতায় সমকালীনতা কত প্রখর আমি তার আর একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র পাঠ করি। কবিও পাঠ করেন, প্রতিদিন তিনি দেখতে পান মৃত্যুর খবর, মানুষের অমানবিকতার খবর, ঘুষ, দালালী, দুর্নীতির খবর। প্রতিদিন এসব খবর পাঠ করে কবি যখন বিপর্যস্ত; তখন তিনি খবরের কাগজ পাঠ করে ভাবেন যদি এসবের উল্টোটা হত! এই ভাবনায় কবি বলেন-

“সেদিন সারারাত দু’চোখ বেয়ে নক্ষত্র, আর ত্বক বেয়ে গ্রীষ্ম ঝরতে ঝরতে
সকাল হয়ে গেছে। বৃষ্টি-বিভোর চোখে দেখি খবরের কাগজে বেরিয়েছে-”

(সংবাদ শিরোনাম)

এটুকু বলেই তিনি খবরের কাগজ উল্টিয়ে দেখেন, প্রথম পাতায় খাদ‍্যমন্ত্রীর চাউল বিতরণের খবর। জানা গেল, চাউল বিতরণ করতে করতে মন্ত্রী তাঁর ঘরের শেষ চালটুকু সর্বশেষ ক্ষুধার্তের হাতে তুলে দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী গ্রামের একজন অভিজ্ঞ কৃষককে ডেকে এনে বসিয়েছেন তাঁর চেয়ারে। তিনি কৃষকের একনিষ্ঠ সহকারি হয়ে গেছেন। অপর পাতায় তিনি দেখলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক পড়াশোনা কম বিধায় তিনি পদত‍্যাগ করেছেন। সুবিধাবাদীরা রাজনীতি থেকে কেউ কেউ নাম কেটে দিয়ে বিপাকে পড়ে ভোগান্তি পোহানো মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অন্য পাতার খবর- যাদের হিংস্র থাবার নীচে চাপা পড়ে হলুদ হয়ে গিয়েছিল সবুজ দূর্বাঘাস, তাদের তালু ফুঁড়ে উঠেছে অচ্ছুত ফুসকুড়ি। পাতা কুড়ানি মেয়েরা পাতা কুড়াতে এসে নির্দ্বিধায় আকাশের তারা কুড়িয়ে এনে ভরে তুলেছে তাদের উঠোন। আজ থেকে ওরা তারার মালা গাঁথবে। এভাবে খবর পড়তে পড়তে কবির চোখ পড়ে সাহিত‍্যপাতায়। তিনি পড়েন, কবিতা লেখক কিছু উচ্চপদস্থ আমলা পদক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাষ্ট্র-দায়িত্বে মনোনিবেশ করেছে। এমনভাবে কবি খবরের কাগজে পড়ছেন সব ইতিবাচক খবর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব খবরের উল্টোটাই ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। কবির প্রত‍্যাশাময় পঙক্তিগুলোর বিপরীত দিকে চোখ ফেরালেই আমরা বুঝতে পারি কবির সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি কত প্রখর।

এলিজার কবিতায় চারপাশ, সমাজ-স্বদেশের পোড় খাওয়া ছবি ক‍্যামেরায় তোলা নিখুঁত আলোকচিত্রের মত ফুটে উঠে শিল্পমন্ডিত হয়ে। তাঁর কবিতা নিছক কবিতা নয়। কবিতার আসরে হারিয়ে গেছে কবিতা। তিনি তাঁর কাব্যিক দৃষ্টিতে কেমন দ্যাখেন, দেখে নিতে পারি-

“যখন আহত সৈনিক গল্প করে তোমাকে নিয়ে
তুমিই কবিতা
সূর্যাস্তকে যে হৃদয় দিয়ে দ‍্যাখে আগামী ভোরের অপেক্ষায়
যদি তার চোখে পড়ে যাও, তুমি রোদমাখা কবিতা
যদি উদ্ভাসিত হও কবরে ফোটা দোলনচাঁপার মতো
তুমি পূর্ণ কবিতা
তুমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে গেলে বাজারের দিকে
দু’হাতে আতর, গোলাপজল, সাবান শ্যাম্পুর বদলে
ফিরে এলে একমুঠো চাল আর
একমুঠো আসন্ন দুর্ভিক্ষ নিয়ে
ভেবে নিয়েছি- তুমিই কবিতা!

তোমার উদ্ধত ভঙ্গির কাছে প্রতারক-মহাজন পরাস্ত হলেই
জানবো নিশ্চিত তুমি কবিতা… তুমি কবিতা…”

(জানবো নিশ্চিত)

কবির কাব্যপ্রতিভায় কবিতা হয়ে ওঠে বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ। মানুষের অধিকার বঞ্চিত করে চললে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। কবির উচ্চারণ-

“এভাবে চলতে থাকলে সমস্ত সংসার অরণ্য হয়ে যায়
তপ্ত রক্তে সিক্ত আমাদের শিমুলেরা ক্রমশ বিবর্ণ হয়
এভাবে চলতে চলতে
চিরচেনা তুমি ভালোবাসার মতো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠো
একগোছা নিষ্পাপ ফুলে প্রহর ভেঙে পড়ে

এভাবে চলতে থাকলে
মানুষ ভুলে যায় — ফুল দেবার মৌলিক অর্থ
চোখের কার্নিশে জমতে থাকে প্রতীক্ষার ধুলোবালি”

(যদি শোনা যায়)

মূলত মানুষই মানুষের প্রতিপক্ষ। শেষ পর্যন্ত যে যার শূন‍্যতার কাছে ফিরে যায়, অভাবের কাছে ফিরে যায়।মানুষের ভেতরে দুটি শ্রেণী, শোষক আর শোষিত । শোষিতের যে চিত্র কবি আঁকেন তাঁর কবিতায়, তা এরকম–

“ঘাম-রক্ত থরেথরে সাজানো এ মাটি পুড়ে ইট হয়
ওদের চকচকে দেয়াল হয়। এ মাটি-মানুষ
নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে ভরে তোলে ওদের পানপাত্র
এ মাটিতে রাখেনি ওরা আর কোন সার
আরাধ্য লাঙ্গল নেই ঢেলার কাছাকাছি
এ মাটি এখন মুমূর্ষু, এখানে অ্যাম্বুলেন্স দরকার।”

(আরাধ্য পথের দিকে)

কবি শুধু শোষণের চিত্র এঁকে থেমে যান না। তিনি আশাবাদী হন। পাললিক তীর খোঁজার যে প্রত্যাশা কবির, তা আশাবাদী করে তোলে পাঠককে-

“এ মাটিতে সার-জল -বীজের শুশ্রূষা প্রয়োজন
একটা নিড়ানি চাই তোয়াজ-নিঃসৃত আগাছা উপড়াতে

তাকাই আরাধ্য পথের দিকে
আর মৃতপ্রায় নদীর জলপিপাসা কণ্ঠে সেঁটে
খুঁজে চলি ফসল বোনার পাললিক তীর”

(আরাধ্য পথের দিকে)

কেন অবসান হয় না বৈষম্যের, অমানবিকতার! কেন বন্ধ হয় না দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচারের! কবি পৃথিবীর কাছ থেকে শিক্ষা নেন। কবির মত আমরাও  সর্বংসহা জননী-পৃথিবীর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃত মানুষ হতে পারি। তিনি বলেছেন:

সবকিছুর মধ্যে তোমাকে স্পর্শ করে
তোমার কাছেই জীবনের মানে শিখি
হে আমার শিক্ষাগুরু: পৃথিবী, প্রিয় গ্রহ

(অনুশীলন)

কবি অমানুষদের আহবান করেন শান্তিনগরে। শান্তিনগরের এই ঠিকানায় এলে যদি মানুষের মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে! কবি অবলোকন করেন-

এখানে নেই মজুতদারি, বাজার উধাও, মূল্য বৃদ্ধি
নেই ঈদে বাড়ি ফেরার টিকিট সংকট,
অতিমারীর নকল মাস্ক আর উচ্চবিত্ত ঝাড়ুদার নেই
এখানে টকশো-টেবিল,সমঝদার, কল্লাকাটা তোলপাড় নেই
রাষ্ট্রীয় খরচে হজ্জ্ব পালনের বালাই নেই, রূপপুরের বালিশ নেই।

ওই তো মাটি খুঁড়ে ঘর হচ্ছে আরেকটা, নতুন বাসিন্দা আসবে

কী আশ্চর্য! সাক্ষাৎ নেই, কথা নেই;
সবাই এখানে মৃত মানুষের শান্তি চাইছে অবিরাম
অথচ শান্তির খোঁজে
জীবিতদের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জীবিতরা!

(শান্তিনগর)

কবি মূলত কবরস্থানকেই বলেছেন শান্তিনগর। এখানে মানুষের কোনো ঝগড়া -বিবাদ নেই। অন‍্যায়-অবিচার নেই। মৃতদের উদ্দেশে এখানে দেয়ালে লেখা আছে ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ কিন্তু জীবিত মানুষ মানুষের কল্যাণ কামনা করে না। সত‍্যিই মানুষ বড় বিচিত্র, আজব! মানুষকে মানুষ হওয়ার জন্য কবির বিনম্র আক্ষেপ-

“ঘাস আর ধুলো মেশা ফুল খুঁটে
হৃদয়ে মস্তিষ্কে খরার নৈবদ‍্য সাজিয়ে—-
ফাগুনে যে ফুল হাত ছুঁয়ে দিয়েছি তোমায়
চৈত্রের অনিবার্য শুষ্কতায় তা কি শুকালো!
যদি নূন‍্যতম আদ্রতাও বেঁচে থাকে সে ফুলে
তা দিয়ে কি আমাদের উপেক্ষিত হৃদয় ধুয়ে মুছে
শুদ্ধ করে ফিরিয়ে আনা যায় না– মানবিক বিপুল বৈভব!

(চৈত্রের অনিবার্য শুষ্কতায়)

আমরা মানুষ? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে এলিজার কবিতা কতখানি উসকে দেয় আমাদের ভেতরের বোধকে, এক টুকরো উদ্ধৃতিতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে-

” জীবাণুরা মানুষের মাংসের ক্ষত খোঁজে
মানুষেরা খোঁজে মানুষের হৃদয়ের ক্ষত
যে পায় খুঁজে; সে-ই পারে সারিয়ে তুলতে

(ক্ষত)

অথবা,

বাতাসে জীবাণুর গন্ধ
বন্দর থেমে গেলো
ভেঙে গেলো ভরা হাট
রাস্তার শূন্যতা ঠোকরায় কাকেরা
দিন তো আসে না
ক্ষুধার্ত উঠোনে পৌঁছায় কে কার ভাত?
রাজপথে নেমে আসে ক্ষুধাময় অজস্র উদর

(হাতগুলো যদি)

মানুষের বঞ্চনার প্রতিবাদ, অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি ওঠে পথেই। এলিজা খাতুনের কবিতায় পথ ফিরে আসে বারবার। তিনি রাজনীতি সচেতন কবি। সরাসরি রাজনীতি না করলেও একজন কবির অবশ্যই রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা জরুরী। এটা অনিবার্য সত্য। নিরপেক্ষতা একটা মুখোশ মাত্র। নিরপেক্ষ যে সে নির্বিকার। সে অথর্ব। একজন কবি তাই নিরপেক্ষ নন। তিনি অবশ্যই নির্যাতিতদের পক্ষে, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের পক্ষে। দাবি-দাওয়ায় উত্তাল শাহবাগ নিয়ে কবি বলেন :

“বিক্ষোভের পর্বত স্পর্শ করে প্রবাহিত হয়-
উত্তাল সমুদ্রের মতো গতিশীল জনস্রোত
বিচিত্র ব্যানারে নানা রঙে সজ্জিত শাহবাগ মোড়
ক্রমশ কলবরে বৃদ্ধি পায় মানুষের সারি ও সম্ভাবনা

তুলো তুলো স্বপ্নমেঘ আরো ঘনীভূত হতে হতে
একসময় ভারি বর্ষণে ভিজে যায় শাহবাগ
অথচ শীতল হয় না ক্ষুব্ধতার ধোঁয়া ওঠা তপ্ত পথ”

(অনড় শাহবাগ)

কবিতায় প্রচণ্ড  ক্ষোভ, প্রতিবাদ  শাহবাগ থেকে যেন ছড়িয়ে যায় লাতিন আমেরিকাতেও। বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হয়ে সাদা পুলিশের বুটের তলায় নিষ্পেষিত কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের কষ্ট, মৃত্যুযন্ত্রণাও কবিকে ব্যথিত করে। তিনি উচ্চারণ করেন-

“বেলা বেড়ে যাবার সাথে সাথে প্রবল উজ্জ্বল আর-
তীক্ষ্ম হয়–লিপিবদ্ধ বাক্যের কালচে শরীরগুলো
পৃষ্ঠা জুড়ে সারি সারি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে
বৈষম্যের দুপুরে পুড়ে পুড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর
শ্বাসরোধ করা ফ্লয়েডের কষ্টধ্বনি বুকে সেটে
বিক্ষোভ চলতে থাকে… চলতে চলতে…
বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসে রাজপথে”

(এক ফালি রোদ)

এলিজার কবিতায় উঁকি দেয় একফালি রোদ। সে রোদ ঘামঝরা সময়ের, ঐতিহ্যের স্মারক দাদার মাথোলের, শরণার্থীর প্রতি সহমর্মিতার। সে রোদ সুগন্ধি কুঁড়ির, মানুষের মঙ্গলের, শুভদিন প্রত্যাশার।

সুসময়-সুদিনের জন্য কবির প্রতীক্ষা পাঠকেরও প্রতীক্ষা হয়ে ওঠে। কবির নিবিড় উচ্চারণ-

“যারা সম্মুখে এগিয়ে গেছে ধাবমান শিখার মতো
নদীর মতো যারা এঁকে গেছে আত্মোৎসর্গের পথ
জীবনের সনদে ; যারা সীলমোহর লাগিয়ে গেছে-
দাসত্বের জোয়ারের উপর, শৃঙ্খলের লজ্জার উপর
অমন মুখ ভেবে প্রতীক্ষায় থাকি

মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক ক্ষুধা-যন্ত্রণাপ্রাপ্ত মানুষেরা
উথলে উঠুক ভাতের ফেনার মতো।
ত্রাণের শস্য লোপাটকারীর দিকে-
তেড়ে আসুক উত্তাল ঢেউয়ের মতো জনস্রোত
নদীর মতো কখন প্রবাহিত হবে জনতা!
আর কবে যাবো নদীর কাছে!

(প্রবাহ-প্রতীক্ষা)

কবির প্রতীক্ষার অবসান হোক। জেগে উঠুক বঞ্চিত মানুষ, অন‍্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ঢেউয়ের  মতো প্রবাহিত হোক জনস্রোত।

আগেই বলেছি এলিজা মাটিলগ্ন কবি। তাঁর কবিতায় বরাবরই উঠে আসে আমাদের গ্রামীণ সমাজ, ব্রাত্য সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, এই দেশ। উঠে আসে পাতার মুকুট, গ্রীষ্মের হাঁটুজল, ভোরের চোখের ঘুমঘোর, খণ্ড খণ্ড জনপদ, জ্বলন্ত কয়লার দেহ, বৈষম্যের দুপুর, শিশিরের মায়া, বিক্ষোভের ভূমিষ্ঠ চিৎকার, অমল বাতাস, কবিতার মৃত্যু, মৃত্যুর পায়ের শব্দ, বসরাই গোলাপ, ছটফট করা স্বপ্নের শরীর, জীবন্ত স্বপ্নদের অপেক্ষা-আহাজারি, শূন্যতায় কাকের ঠোকরানো, প্রাণবন্ত ভোর, শঙ্কাহীন পূর্ণিমা রাত, কার্তিকের অনটন, হৃদয়ের কঙ্কাল, শিরিষের ডাল, মধ্যদুপুরের বৈরাগ্যময় ভালোবাসা, দীর্ঘশ্বাসের কথা, হৃৎপিণ্ডের কালো কালো দাগ, আবিসিনিয়ার নিষ্পাপ মুখ, সবুজের বিবর্ণতা, একাকীত্বের মোহনবাঁশি, জীবনের দাবিমাখা খবর, দেয়াল ভাঙার পঙক্তি, শ্লথ পায়ে মধ‍্যরাতের তেলাপোকা, রৌদ্রের ভূমিকা, মায়ের প্রিয় মুখ এমনই আমাদের জীবনে মিশে থাকা অথবা আমাদের অপ্রত্যাশিত অসংখ্য শব্দসম্ভারের বুনন ‘চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি’।

এলিজা খাতুনের কবিতা থেকে কিছু চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা খুঁজে আনা যায়, যেমন: চুলের ভাঁজে ভ্রমণের ধুলো, চিটচিটে বালিশে গোঁজা স্বপ্নের তুলো, ভালোবাসার মত দুর্বোধ্য, প্রতীক্ষার ধুলোবালি, ক্ষুব্ধতার ধোঁয়া ওঠা তপ্তপথ, অচেনা ইচ্ছের মতো রহস্য রুমাল, সম্ভাবনার অ্যাম্বুলেন্স, হাতিয়ারহীন যুদ্ধের ডাক, কংক্রিট দানবের দাঁত, নির্লোভ নেতৃত্ব, পোয়াতি হেমন্ত, রোদের আদর, পায়ের পাতায় বিঁধে যাওয়া ভুল কাঁটা, উদভ্রান্ত কালের হাঁচড়-পাঁচড়, শস্যদানার স্বপ্ন, বিরতির যতিচিহ্ন, অন্ধকার শিকেয় তোলা অপ্রাপ্তির সুড়ঙ্গ, বিরহের শতরঞ্জি, নিরুপায়ের ঘনগন্ধ, খুপড়ির অন্ধকারে ভোর, ইচ্ছের পাল, লাউয়ের ডগা ফেরানোর মতো মগ্নতা, বেখেয়াল ভাদ্র, সমুদ্র ভেজা চোখের নুন, ভোরের ফালি ফালি রোদ, খরার নৈবেদ্য ইত্যাদি। চিত্রকল্প হিশেবে বা উপমা, শব্দবন্ধ, শব্দকল্প হিশেবে এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মামুলি, আমাদেরকে চমকে দেয়ার মত নয়।

আসলে আমার মনে হয়েছে এলিজা খাতুন শিল্পের বাছ-বিচার করে কবিতা লিখতে বসেন না। তাঁর কবিতা তাঁর চারপাশ, তাঁর নিত্য দেখা জীবনের প্রতিলিপি। এলিজার কবিতার শব্দ শেকড়গ্রস্ত। কবিতাকে অহেতুক দুর্বোধ্য করে তোলেন না, বরং আটপৌরে শৈল্পিকতায় আলোকিত। ইংরেজি সাহিত্যের বিরলপ্রজ অথচ শক্তিমান কবি আলফ্রেড হাউজম্যান বলেছিলেন, ‘কবিতা স্বতোঃৎসারণ’। এলিজার কবিতা পড়তে এসে এমনটিই মনে হয়েছে। তিনি জোর করে কবিতা লেখেন না। এ কারণেই তাঁর কবিতায় বোধের জটিলতা নেই, আছে গভীরতা, আছে ঘোর। তাঁর কবিতা একটি ঘোরের ভেতর নিয়ে পাঠককে প্রশান্তি দেয়। তিনি প্রতিবাদী, কিন্তু উচ্চকণ্ঠ নন।

কবিতায় ছন্দ জরুরি নয়। তবে একজন কবিকে অবশ্যই ছন্দ সচেতন হতে হয়। এলিজা ফ্রিভার্সে কবিতা লেখেন। আক্ষরিক বা শাব্দিক অর্থে কোনো ছন্দের ধার ধারেন না। তবে কবিতাপাঠে অন্তর্গত ছন্দের স্বাদ পাওয়া যায়।

চমৎকার এই বইটিতে কিছু ভুল বানান পীড়া দিয়েছে। আমি আমার লেখায় কবিতার উদ্ধৃতিতে যে ভুল বানান পেয়েছি তা উপস্থাপন করিনি ; সেগুলো সংশোধন করে নিয়েছি। কবিকে বানান ব্যবহারে একটু সচেতন হতে হয়। এক্ষেত্রে প্রকাশকের দায়িত্ব  কম নয়। একটি বইকে যথাসম্ভব নির্ভুল করে প্রকাশের জন্য প্রকাশক কর্তৃক বইটি সম্পাদনারও  প্রয়োজন রয়েছে। ‘অনুপ্রাণন’ একটি অভিজাত প্রকাশনা সংস্থা। এ ব্যাপারে তাদেরকে দৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।

এলিজা খাতুনের কবিজীবনের সাফল্য কামনা করি। একইসাথে বইটি সর্বজন পাঠকনন্দিত হোক, এই প্রত্যাশা।

———

লেখক : কবি। মধুসূদন গবেষক। পরিচালক- মধুসূদন একাডেমী, সাগরদাঁড়ি, কেশবপুর, যশোর।

ইমেইল: khondkar.khosru62@gmail.com

+ posts

Read Previous

লেখকের দায়, পাঠকের রুচি ও আবেগের বইমেলা

Read Next

জীবনের মর্মকথা

One Comment

  • এলিজা খাতুনের “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি” কাব্যগ্রন্থ নিয়ে বিস্তারিত ও ঋদ্ধ আলোচনা। একটি বই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কবি-গবেষক খসরু পারভেজ ৯টি কাব্যগ্রন্থের মালিক এলিজা খাতুনের কাব্যসত্তা, কাব্যভাবনা ও শিল্পসত্তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং দ্বিধাহীন ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন: “ আসলে আমার মনে হয়েছে এলিজা খাতুন শিল্পের বাছ-বিচার করে কবিতা লিখতে বসেন না। তাঁর কবিতা তাঁর চারপাশ, তাঁর নিত্য দেখা জীবনের প্রতিলিপি। এলিজার কবিতার শব্দ শেকড়গ্রস্ত। কবিতাকে অহেতুক দুর্বোধ্য করে তোলেন না, বরং আটপৌরে শৈল্পিকতায় আলোকিত। ইংরেজি সাহিত্যের বিরলপ্রজ অথচ শক্তিমান কবি আলফ্রেড হাউজম্যান বলেছিলেন, ‘কবিতা স্বতোঃৎসারণ’। এলিজার কবিতা পড়তে এসে এমনটিই মনে হয়েছে। তিনি জোর করে কবিতা লেখেন না। এ কারণেই তাঁর কবিতায় বোধের জটিলতা নেই, আছে গভীরতা, আছে ঘোর। তাঁর কবিতা একটি ঘোরের ভেতর নিয়ে পাঠককে প্রশান্তি দেয়। তিনি প্রতিবাদী, কিন্তু উচ্চকণ্ঠ নন।” নিঃসন্দেহে এলিজা খাতুন একজন শক্তিমান কবি। তিনি মাটিলগ্ন মানুষের কবি। অসুন্দরের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবি। তবে তিনি এখন কাব্যভাবনায় আরও বেশি সূক্ষ্ণতাগামী, আরও বেশি বৈচিত্র্য অভিসারী হতে পারেন। কবি খসরু পারভেজকে ধন্যবাদ জানাই একজন অনুজ কবির কাব্যগ্রন্থনিয়ে এমন বিস্তারিত ও আন্তরিক আলোচনার জন্য। কবি এলিজ াখাতুনকে অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *