অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৮, ২০২৪
৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৮, ২০২৪
৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সময়টিভির পক্ষে মহির মারুফ কর্তৃক মানস চৌধুরীর সাক্ষাৎকার -
লেখকের দায়, পাঠকের রুচি ও আবেগের বইমেলা

সাক্ষাৎকার –
লেখকের দায়, পাঠকের রুচি ও আবেগের বইমেলা

মানস চৌধুরী* (সাক্ষাৎকারটি  নিয়েছেন মহির মারুফ)

১. প্রায় চার দশকের বেশি সময় ধরে আয়োজিত হয়ে আসছে অমর একুশে বইমেলা। এখন পর্যন্ত বইমেলা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠেনি। বইমেলা মানেই বাংলা বই ও বাংলা সাহিত্য (অন্তঃপক্ষে সিংহভাগ পরিসরের বিবেচনায়)। বইমেলা ও বাংলা একাডেমির এ আয়োজনকে বিশ্বজনীন কিংবা এটিকে আন্তর্জাতিক মানের করতে না পারাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মানস: বিশ্বজনীন বা আন্তর্জাতিক মান ইত্যাদি ভাষামালা নিয়ে আমার খুব উত্তেজনা কাজ করে না। আশা করি আপনার প্রশ্নকে তাতে গৌণ করা হলো না। এভাবে বলছি কারণ এই ভাষামালা বা বিশেষণগুলো যার যখন যেভাবে ইচ্ছা প্রয়োগ করছেন; এবং কখনো কখনো প্রডাক্ট/পণ্য বা পরিষেবা ইত্যাদির কোনোরকম কাণ্ডজ্ঞানমূলক সামঞ্জস্য ছাড়াই। পানির ট্যাংক থেকে শুরু করে সিমেন্ট, চিপস থেকে শুরু করে জুতা – তালিকাটা যে বড় হবে এটুকু বলার পরই সকলের মনে পড়ার কথা। এখন এসব দাবিনামাকে কি আমি মিথ্যাচার মনে করি, বা অতিরঞ্জন মনে করি? প্রথমে এবং প্রধানত একটা অহেতু উত্তেজনা মনে করি যা বালখিল্য। ওদিকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি অঞ্চলে গুণমান অনুভব করার মতো কোনো রকম প্রস্তুতি কি আমার নেই? আমার ধারণা, গুণমান বোঝাবুঝির সাধারণ কিছু বোধবুদ্ধি আমারও কাজ করে। বরং, আমার মনে হয় এগুলো বলতে থাকার মধ্যে প্রায়শই একটা অপ্রাসঙ্গিকতা বা কাণ্ডজ্ঞানহীনতা; আবার অন্যত্র মুখস্তভাবে বলতে থাকার বাতিক মনে হয়। বাংলাদেশে যখন সত্যি সত্যি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান হয়, সেগুলোতে উদ্বোধনী-সমাপনী অংশগুলো কখনো লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না। তবে অবশ্যই দুয়েকটা ক্রীড়া-ইভেন্টের এই অংশগুলো আমি টিভিতে মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। ওই করুণ পার্ফর্ম্যান্সগুলো দেখলে থানা শহরের স্কুলগুলোতে যাঁরা এসব আয়োজন করে থাকেন, তাঁদেরও মায়া হবে। এসবের পরে গুণমানের কোনো আলাপ খুবই বেখাপ্পা হতে বাধ্য।

আপনার প্রশ্নটিকে অন্য একটা ধরনে উত্তর দেবার সুযোগ আছে। এরকম একটা আয়োজনে, নানান দেশের সাহিত্যানুরাগী ও সাহিত্যিকদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু প্রথমেই সেরকম কোনো উদ্যোগ থাকতে হবে রাষ্ট্রপ্রশাসকদের। আমার মনে হয় না, বাংলাদেশে এরকম কল্পনাসম্পন্ন প্রশাসক আছেন। এবং আমি আদৌ সাহিত্য-শিল্প তৎপরতা নিয়ে দক্ষ-দূরদর্শী কোনো পরিকাঠামো নিকট ভবিষ্যতে আশা করি না।

২. এবারের বইমেলা ও সাবেক সময়েও ভিন্নমতের বইগুলোকে নিষিদ্ধ করা ও কেউ অন্য ধাচে স্পর্শকাতর কিছু নিয়ে কথা বলতে গেলে তার টুটি চেপে ধরার যে স্বভাবজাত সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে এটি কী ধরণের সতর্কবাণী দিচ্ছে কিংবা এ ধরণের কাজ মুক্তচেতনা ও বাকস্বাধীনতার কতটা পরিপন্থী?

মানস: মুক্তচেতনা ও বাকস্বাধীনতা ভাষামালাও আমার অতিরঞ্জিত ও হৈহৈ ধরনের মনে হয়। ভেঙে বললে, কে কখন কোনগুলোকে এসবের লক্ষণ হিসাবে দাবি করেন, কে কোন সময় কার বিরুদ্ধে এগুলো নষ্ট করার অভিযোগ তোলেন তার কোনো গ্রাহ্য বিধিমালা আছে বলে আমার মনে হয়নি। তার থেকেও বড় যে সমস্যাটা আমি বোধ করি তা হলো প্রায়শই এই হৈহৈটা পরিপ্রেক্ষিত-বিযুক্তভাবে হাজির করে থাকেন এসবের প্রবক্তারা। যেমন, যদি সাম্প্রতিক সময়কালের উদাহরণ থেকেও বলি, যত সহজে এসবের প্রবক্তারা খুশি হয়ে উদাহরণ দেবেন যে বিএলএম আন্দোলনে উপনিবেশকারী দাসত্বপ্রথার সমর্থকদের মূর্তি ভেঙেছেন, কিছুতেই তাঁরা এই ব্যাখ্যা দেবেন না যে কীভাবে এতদিন যুক্তরাজ্যে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে এসব ব্যক্তিত্বের অধিষ্ঠান বলবৎ আছে; কিংবা তাঁরা বলবেন না যে ভাঙা মূর্তিগুলোর থেকে অনেক বেশি এখনো প্রোথিত হয়ে আছেন এসব দাসকারবারী। এ কথা হয়তো তাঁরা জানেনই না যে ওসব রাষ্ট্রে এরকম উপনিবেশ-বিরুদ্ধ অনেক লোকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকদ্দমা ও শাস্তি চলমান আছে। সারাংশে, এই হৈহৈকাণ্ডটা কিতাবী ও ইতিহাস-অদর্শী বলে আমি বিবেচনা করি।কিন্তু তারপরও সাধারণভাবেই আমি আদর্শ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বাংলা একাডেমির খড়গহস্ত হওয়াতে যারপরনাই সংক্ষুব্ধ। আরো বেশি সংক্ষুব্ধ বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেসব সাহিত্যিক-চিন্তক একটা মাথামোটা ক্রুদ্ধ সরকার-অনুচর শাস্তিপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে সাহায্য করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে। নিষিদ্ধ হওয়া বই বা ছায়াছবি নিয়ে তথাকথিত গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামান্যই বলার সুযোগ থাকে। সরকারের বা সরকার অনুগতদের কিংবা রাষ্ট্রবাদীদের কোপানলে পড়া বই বা চলচ্চিত্র বা চিত্রকর্মকে অকুণ্ঠে সমর্থন করাই আমাদের একমাত্র উপায় হয়ে পড়ে। তবে অতীতে এরকম অজস্র নজির আছে যে কমবেশি আবোলতাবোল কন্টেন্টের বইকে বা ছায়াছবিকে নিষিদ্ধ করে এগুলোর বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রপ্রশাসন। সত্যি কথা যদি বলি, তখন আমার ব্যাক্কল ধরনের অনুভূতি হয়। তথাকথিত স্যেকুলারপন্থী সরকার কিংবা স্বঘোষিত ধর্মভক্তিশীল সরকার উভয়েই এসব আজেবাজে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দুর্বল কন্টেন্টের কাজকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন – বই বা ছায়াছবি। আবার কাণ্ডজ্ঞানহীন অভিব্যক্তিকেও ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র ব্যানারের নিচে রেখে দেবার লোক আমি নই। মত প্রকাশের ওয়ান সাইজ ফিটস অল স্বাধীনতা থাকতে পারে এই ধারণা দুর্বল। কিন্তু এগুলো খুবই সূক্ষ্ম প্রসঙ্গ; খুব অল্পতেই পক্ষবিপক্ষ ভেজাল বেধে যেতে পারার মতো।

৩. বলা হচ্ছে, দিন যাচ্ছে লেখকের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বইয়ের মান বাড়ছে না। বিশেষ করে মানসম্মত ফিকশন লেখক পাচ্ছে না পাঠক। এর কারণ কী হতে পারে? আদৌ ভালো ফিকশন লেখক নেই নাকি আমরা তাদেরকে তুলে ধরতে পারছি না?

মানস: এই হাহাকারটার সাথে আমি পরিচিত। কিন্তু, আসলেই, মানের আলাপটা সহজ নয় এবং মানহীনতার অভিমান আমার নাই বললেই চলে। বরং এখানে মোডালিটি ও পাটাতনবৃদ্ধির প্রসঙ্গটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। অন্য দুয়েকটা আলাপেও প্রসঙ্গটা স্পষ্ট করে তুলেছি। তার মধ্যে বহু আগে কবিসভাতে, এবং সম্প্রতি বয়ান পত্রিকার আলাপে তুলেছি বলে আমার মনে পড়ে। যদিও আমার মনে হয়েছে, পর্যবেক্ষণটা যাঁদের সামনে হাজির করছি, তাঁরা হয় লক্ষ্য করেছেন কম, কিংবা হয়তো মান্য করতে চাননি। যে কালে, প্রাযুক্তিক ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করি সেখানে অভিব্যক্তি উৎপাদন অনায়াস। সাহিত্যিক অভিব্যক্তিও। একে আপনি মানসম্পন্ন বলতে চান বা না-চান অজস্র মানুষ যখন অপেক্ষাকৃত কম আয়াসে অজস্র পরিসরে রচনা করতে পারছেন তখন এটাকে সাহিত্যস্ফীতি (মুদ্রাস্ফীতির মতো) হিসাবে দেখা চলে। এখন লেখার মানের ওই ধ্রুপদী/অর্থোডক্স আন্দাজগুলো অকার্যকর। এমনকি ওসব আন্দাজ বজায় রেখে যাঁরা নয়া যুগের ‘অমর’ সাহিত্য বানানোর স্বপ্ন দেখেন তাঁদেরকে নিয়ে আমার বেশ মায়ামমতা বাৎসল্য কাজ করে। নানান মানের কাজ আগেও হতো, এখনও হচ্ছে। কিন্তু প্রেস মোডালিটির রচনা প্রকাশনাতে জমজমাট মূল্যমান সৃষ্টি করে ফেলার সাথে তুলনীয় কিছু হবার সম্ভাবনা কমে গেছে। এটা সহজে বুঝতে পারলে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহিত্যিক অমরতাজনিত বাসনালাঘব ও বেদনা-উপশম হবে। কিন্তু নানান মানের গল্প-বলিয়ে/লিখিয়ে এখনও আছেন, আগেও ছিলেন। তাঁদের তারকামূল্য সৃষ্টি না হ
বার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা।

৪. সাদা চোখে দেখতে গেলে পাঠকদের পছন্দ সহজ-সরল সস্তা মানের লেখা (অন্তঃত বড় সংখ্যার)। এক কথায় রুচিশীল পাঠকের একটা খরা দেখা যাচ্ছে। কীভাবে দেখেন ব্যাপারটিকে? লেখকের পাশাপাশি পাঠকদেরও কী একটা দায় থেকে যায় না?

মানস: আমি অনায়াসে রুচিদারির লোক নই। তা সত্ত্বেও, কোনো লেখাকে সস্তা বলা যাবে না কিংবা কোনো রচনাকে আপনি ‘রুচিশীল’ বললে আমি মানা করব তা নয় আসলে। কিন্তু সত্যি সত্যিই পাঠকের বড় অংশ কী পছন্দ করবেন তা নিয়ে মান-অভিমান করা নিরর্থক। আমার ধারণা আমাদের সকলেরই মা-দাদি, খালু-চাচা চিপসের চাইতে চিড়া বা চিরতা ভেজার স্বাস্থ্যকরতা সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একদল আগ বাড়িয়ে চিড়া ভিজিয়েও রেখে থাকতে পারেন; কিংবা আপনার কপাল মন্দ হলে হয়তো চিরতাই ভিজিয়েছিলেন। এসব বক্তৃতার কারণে আমাদের চিপস খাওয়া কমে গেছে বা কমে যাবার আশু সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না। আর তা নিয়ে চিড়ার পক্ষাবলম্বন করে আমি গাল ফুলাতে অনিচ্ছুক। এগুলো এরকমই। উপরন্তু, জনপ্রিয়তার যেমন কিছু আন্দাজযোগ্য লক্ষণ বের করা যায়, তেমনি জনপ্রিয়তার অনেক কিছুই একদম দৈবাৎ বা আরবিট্রারি। কখন কোনটা কীভাবে “লোখে খেয়ে ফেলবেন” তার নির্দিষ্ট রুটম্যাপ বানিয়ে দেয়া যায় না।বরং, লেখক-পাঠকের এই সম্পর্কটাকে আমি দ্বান্দ্বিক হিসাবে দেখি। জ্বি, যদি এতে মার্ক্সবাদী শব্দ ব্যবহার মনে হয়, তাহলে আমি নিলাজভাবে সেটাই করছি। এখানে দ্বান্দ্বিক বলতে আমি বোঝাতে চাইছি লেখক কী লেখেন আর পাঠক কী পড়েন তার একটা আন্তঃনির্ভরশীলতা আছে। উভয়েই উভয়কে মারাত্মক প্রভাবিত করেন। আর এই চক্রাকার/দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটার গুরুত্বপূর্ণ কারক হলেন প্রকাশক। ব্যবস্থাতন্ত্র হিসাবে বললে প্রকাশনা ব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে সত্যেন সেনের রচনাবলীও বিক্রি হয়েছে হাজারের হিসাবে। কিংবা মান্টো বা চুগতাইয়ের অনুবাদ পড়তেন লোকে। মুক্তধারা বা পুঁথিঘরের মতো প্রকাশক বাদ দিলেও, খোদ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল প্লেটোর ‘সংলাপ’ কিংবা ম্যানহাইমের ‘সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব’ কিংবা মর্গানের ‘আদিম সমাজ’। এগুলোর কোনোটাই কম বিক্রিত বই ছিল না। একটু কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে প্রকাশনা ব্যবস্থাতন্ত্রকে ‘পরিচালিত’ করতে হয় যদি পাঠকের বিশেষ তালিম কেউ চান। আর পাঠকও তাতে প্রস্তুত হতে থাকেন। ঠিক এসব কারণেই, আগের প্রশ্নটাকে আবার স্মরণ করে বলি, ‘মুক্তচিন্তা’র হৈচৈকে আমার পরিপ্রেক্ষিতবিযুক্ত মনে হয়। এত এত বই বের হওয়াকে বরং ‘মুক্তপ্রকাশ’ হিসাবে দেখবেন তাঁরা। যদি পাঠকের চিন্তার কারিগরি আপনার লক্ষ্য হয়, তাহলে অতটা ‘মুক্ত’ থাকলে আপনি মুক্তকচ্ছ হয়ে যাবেন। এগুলো সম্পর্কিত প্রসঙ্গ।

৫.  সাহিত্যের একটা ভিন্নধারা দেখতে পাচ্ছি আমরা। ফেসবুক কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা ও কমিক সাহিত্যের এ নতুন ধারাকে কীভাবে দেখেন আপনি?

মানস: ফেসবুক বা যেকোনো মাধ্যমে রচনাদি করা নিছকই মাধ্যমের প্রশ্ন। আমি পাটাতনকে সারবস্তু ভাবার সঙ্কটে ভুগি না। তবে আমার মনে পড়ছে যে যখন লেটারপ্রেসে একফর্মা কবিতা ছাপা হতো, সেসব কবিতা লিখতেন ‘অন্ত্যজ’ কবিকুল। সুরেলা ছন্দের কিসসানির্ভর ওই কবিগণকে আবার নাগরিক কবিরা নিম্নপদস্থ ভাবতেন। ফলে, আমার অস্বীকারে বদলে যাবে না যে, পাটাতন বা মোডালিটির বিচারেই কোনো কোনো শিল্প-সাহিত্য চর্চাকে খাটো করে দেখার চল আছে। যেমনটা ‘বটতলার’র সাহিত্য বলা হতো অবজ্ঞা করতেই। কোনো প্ল্যাটফর্ম বা মোডালিটিকে বড়জোর বাহন হিসাবেই দেখার লোক আমি, সাহিত্যিক সারবত্তার পরিচায়ক হিসাবে দেখি না। কিন্তু এগুলো তো আছে চারপাশে! আল মাহমুদ পর্যন্ত বহুদিন “মফস্বলী” খেতাব বহন করেছেন অবজ্ঞা হিসাবে। কবিসভা বলে একটা প্ল্যাটফর্ম ব্রাত্য রা্‌ইসু ২০০৩-৭ সময়কালটাতে জাগরূক রেখেছিলেন। সেখানে অনেকেই অল্প আলাপ করতেন, সম্ভবত এই কারণে যে প্রধান দৈনিকে তাঁদের প্রকাশিত-ব্যক্তিত্বের সাপেক্ষে জায়গাটাকে ঊণ ভাবতেন। এগুলো প্রমাণ করা কঠিন, কিন্তু অনুভব করা সহজ। যখন আর্টস পত্রিকা অনলাইনে এল, তখন অবশ্য অনেক সময় লাগেনি সম্পাদক রাইসুর লেখকদের ওই পোর্টালে আগ্রহী করতে। ফলে এগুলো মূল্যমানের কতগুলো চলমান লড়াই মাত্র।
ফেসবুক একটা চালু প্ল্যাটফর্ম। লোকে অবারিতভাবে এখানে লিখবেনই। মান বা সারবত্তার ব্যাপারটা স্বতন্ত্রভাবে দেখতে হবে। প্রশ্নটার অন্য অংশ বরং আরও চিত্তাকর্ষক। নতুন যেসব প্রাযুক্তিক বিকাশ ঘটেছে তাতে দৃশ্য ও শ্রুতি সাহিত্যিক অভিব্যক্তির জায়গা হিসাবে বিস্তৃত হবেই। আপনি আমি মানার আগেই লোকে তা করতে শুরু করেছেন। মুস্কিল হচ্ছে, কমিক নিয়ে আমার যা আগ্রহ তা অনেক পরিতৃপ্ত হয়নি। যে দুয়েকটা চোখে পড়েছে তা একেবারেই বেরাজনীতিক/এপলিটিক্যাল। বাংলাদেশের দৃশ্য রাজনীতিতে যে হাল তাতে প্রধান পত্রিকাগুলোর পর্যন্ত কার্টুনের মতো শক্তিশালী বিষয়গুলোকে লুকিয়ে ফেলতে হয়েছে। এখানে ফেসবুকে বা সাধারণভাবে সাইবার মাধ্যমে তীব্র অর্থময়তার কাজকর্ম হবার বাস্তবিক পটভূমি আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি না আচমকা গুরুতর কোনো রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়, তাহলে যেসব কাজ হতে পারে তা নিয়ে আমার আগ্রহ কম। কতগুলো চর্ব্বিত জিনিসই আবার ছবি-গল্প হিসাবে হাজির হলে তা নিয়ে উৎসাহ বোধ করার কারণ নেই। ওগুলো মীনা কার্টুন বা জাতিসংঘের স্যানিটারি কার্যক্রমেই যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু তীব্র শ্লেষাত্মক, গাঢ় অর্থময় ছবি-গল্পের আমি অনুগ্রাহী থাকব। সেগুলো ফেসবুকে প্রকাশিত হলেও।

৬. আমরা প্রায়ই ‘উত্তারাধুনিক’ শব্দটি ব্যবহার করি। সেটা হোক সাহিত্যে কিংবা সংস্কৃতিতে। আদতে আমরা কতটুকু উত্তারাধুনিক হতে পেরেছি?

মানস: তাত্ত্বিক স্কুল নিয়ে যেসব প্রপাগাণ্ডা হতে থাকে, ওগুলো আমাকে আসলেই অত উৎসাহী করে না। এই প্রশ্নের মধ্যে যে ঝোঁকটা আছে যে ‘আমাদের উত্তরাধুনিক হতে হবে’ এরকম ঝোঁক আমার স্কিমেটিক লাগে। নির্দিষ্ট অর্থের দুনিয়ায় অজস্র লোক বন্দি থাকেন; আবার অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক তা থাকেন না। অর্থের দুনিয়ার এই বদলপ্রস্তাবগুলোকে উত্তরাধুনিক তৎপরতা নাম দেব নাকি দেব না তার থেকে অনেক জরুরি ছকবাঁধা অর্থের দুনিয়া থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের বের হতে পারাটা। এখানে আরও একটা সতর্কতার বিষয়ও আছে। যখন কোনো বিশেষণ গুরুবাচক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়, তখন সেই বিশেষণের উচ্চকিত প্রয়োগ হয়। গুরুবাচকতার ব্যাকরণ নিয়ে সতর্কতা দরকার। কারণ ওখানে মুখ্যত গুরুত্বপ্রাপ্তির লড়াই চলে; অর্থপ্রতিষ্ঠার নয়।

৭. লাতিন আমেরিকার ধাচে বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা ব্যবহারের একটা প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে জাদুটাও মুখ্য থাকে গৌণ হয়ে পড়ে বাস্তবতা। এই যে জোর করে থিউরি কপচিয়ে সাহিত্য লেখা- এর প্রভাব সম্পর্কে যদি একটু বলেন।

মানস: খানিকটা আগের প্রশ্নে এই বিষয়টার কারিগরি নিয়ে আমার অবস্থান স্পষ্ট করেছি। জাদু বাস্তবতা পদপ্রত্যয়টা বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চায় বেহুদা অতি-উচ্চারিত। আমার বক্তব্য এই নয় যে, এখানকার কিছু কাজের প্রবণতাকে তুল্য বিচারে ‘জাদু বাস্তবতা’মূলক বলা যাবে না; বরং আমার বক্তব্য এই যে যাবে কি যাবে-না তা বিচারের জন্য আমি দুর্বল লোক, এবং আমি অনাগ্রহী লোক। আমি বেশি আগ্রহী বুঝতে যে কেন কিছু লেখক ‘আমার কাজে জাদু বাস্তবতা আছে’ কিংবা ‘আমার কাছে জাদু আছে’ বলতে ব্যগ্র। এই ব্যগ্রতাটা আমার মোটের উপর একটা অনিরাপত্তাবোধজনিত মনে হয়, ইনসিক্যুরিটি। এছাড়া আরও গুরুত্ব দিয়ে বলবার আছে এই অঞ্চলের গল্পপ্রবণতার প্রাক-আধুনিক কলাকৌশলের বিষয়ে। এখানে লোকগাথা এবং পৌরাণিক কাহিনি অতিশয় শক্তিশালী চর্চা হিসাবে ছিল। উত্তর-ঔপনিবেশিক ‘আধুনিক’ সাহিত্য চর্চার মধ্যে সেইসব কাহিনিপ্রণালী সূক্ষ্মভাবে আসতে-থাকাই বরং খুব সঙ্গত। ‘আধুনিক’ যুক্তিগ্রাহ্যতার বাইরে গল্পনির্মাণ নিয়ে তাই আচমকা লটারি পাবার মতো লাফালাফি করা এই অঞ্চলের সাধারণ ইতিহাসের প্রতিও কোনো সুবিচার নয়। কিন্তু নাম জাদু বাস্তবতা দিই বা অন্য কিছু, আপনি যথার্থ বলেছেন। বাস্তবতার বিষয়ে লেখকের গভীর অনুধ্যান না থাকলে জাদুটা ঝোলের বাড়তি তেলের মতো উপরে কুৎসিতভাবে ভাসতে থাকবে। আবার বাস্তবতার বিষয়ে অনুধ্যান/মনোযোগ লেখকের জগদ্বীক্ষা আর রাজনৈতিক সত্তার উপর গড়ে ওঠে। এটা নিছক একটা ক্র্যাফটের বিষয় হবার কথা নয়। ফলে, আমার অবস্থান হবে, যে যা বলে নিজের কাজ নিয়ে খুশি থাকছেন তা নিয়ে নির্লিপ্ত থাকা। কোনো রচয়িতার বাস্তবতা অনুধাবন প্রকাশিত হবে, তা সেই রচনা জাদুময় হোক বা না হোক, রচনাটি হৈহৈ বিখ্যাত হোক বা না হোক।

৮. এবারের বইমেলায় আপনার প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কিছু বলুন। কী ধরনের লেখালেখির মধ্যে আছেন? কী কী বই প্রকাশিত হলো।

মানস: এই প্রশ্নটা করার জন্য আমি ঠিক পঠিত বা খ্যাতিমান লেখক নই। মানে যাঁদেরকে এই ধরনের প্রশ্ন করলে মানায়, আমি তার থেকে অনেক অল্প-পাঠকের লেখক, যদি আদৌ পাঠক থেকে থাকেন। উপরন্তু, বইমেলা ধরে আমার লেখালেখি চলে না। আমি অলস লেখক। যখন আলসেমি ডিঙিয়ে লেখা আগায়, তখনও সম্পাদক বা প্রকাশকের একটা চাপ আমার জন্য দরকার পড়ে প্রকাশের জন্য। তারপরও যদি গত বইমেলার পরের প্রকাশনাগুলোকে এই বইমেলার বই হিসাবে বলি, তাহলে চারটা বইয়ের কথা বলা যায়। ম্যাজিক লণ্ঠন একটা পুস্তিকা করেছেন সিনেমা বিষয়ে, দুয়েন্দে একটা রাজনৈতিক-সামাজিক বিশ্লেষণের বই করেছেন যদিও মেলায় এঁদের স্টল থাকে না। উপকথা বের করেছেন অকথাসাহিত্যের একটা বই; আর ইউপিএল করেছেন আরেকটা রাজনৈতিক বিশ্লেষণের বই।

এর বাইরে পেণ্ডুলাম প্রকাশনী অদ্ভুত একটা কাজ করেছেন। আমার অপাঠ্য কিছু পুরান কবিতা নিয়ে দুটো সাইবার বই করেছিলেন কোলকাতার স্বপ্নছেঁড়া বা রোহণ কুদ্দুস, ২০০৫ সালে। সেই বই দুটোর খোঁজ ওঁরা পেয়েছেন ও মুদ্রিত করছেন এবার। আমিও লজ্জাশরম বাদ দিয়ে কাব্যযশোলোভী হিসাবে ওই বেশ খারাপ-কবিতার বই দুটোতে সায় দিয়েছি। ২০২১ সালে আমি সমকালের ঈদসংখ্যাতে প্রথমবারের মতো একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। অবশ্য উপন্যাস হিসেবে এটাকে পাঠকে মানবেন কিনা আমি অতটা নিশ্চিত নই। সেই বইটাও পেণ্ডুলাম আনছেন।

*অধ্যাপক। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়।

নোট- লেখাটি সময়টিভি অনলাইনে প্রকাশিত।

+ posts

Read Previous

এলিজা খাতুনের  “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি”

Read Next

এলিজা খাতুনের “চিটেধান, প্রার্থনামগ্ন মাটি” : একটি নিবিড় পাঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *