অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গিয়াস উদ্দিন রূপম -
ঝাঁকা ভরা একশ ছড়া: চিরন্তন শিশুমনের গল্পের ঝুড়ি

জসীম মেহবুব। ষাটোর্ধ্ব এক শিশু। চুলে পাক ধরেছে বেশ আগেই। কিন্তু মন পাকেনি আদৌ। এখনও সেই ছোট্টটিই রয়ে গেছেন। এর প্রমাণ আমরা পাই তাঁর মিষ্টি মিষ্টি ছড়ায়। ছোটদের জন্য অনেকেই লিখে থাকেন। তাঁদের বেশিরভাগই ছোটদের লেখা লিখতে গিয়ে বুড়োদের লেখা লিখে ফেলেন। এক্ষেত্রে একেবারে ব্যতিক্রম জসীম মেহবুব। তাঁর লেখা ছোটদের ছড়া-কবিতাগুলো ছোটদের মতোই সরল আর নিষ্পাপ। পড়তে গিয়ে মনে হয় যেন নিজের ছেলেবেলাকেই পড়ছি।

ঝাঁকা ভরা একশ ছড়া। শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার জসীম মেহবুবের নির্বাচিত শিশুতোষ ছড়া সংকলন। গ্রন্থটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে চিরন্তন শিশুমনের নানান গল্পকথা। না, বন্ধুরা, আর কোনো কথা নয়। দেরি না করে চলো, আমরা ঘুরে আসি ‘ঝাঁকা ভরা একশ ছড়া’র মনমাতানো ভুবনে।

‘দস্যি ছেলে’টি দিয়েই শুরু করা যাক-

‘দুধের সাথে চুন মিশিয়ে
চিনির সাথে নুন/ কে করেছে কাণ্ড এমন/ কার এরকম গুণ?
ভরদুপুরে ক্লান্ত দেহে/ আম্মু যখন ঘুমে
ওলট পালট করতে এসব/ কে ঢুকেছে রুমে?
পেয়ে গেছি কে করেছে/ দস্যিছেলে কে সে?
টোল ফেলে দুই গালে সে যে/ ফিক করে দেয় হেসে।’

সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েই ক্ষান্ত হয় না দস্যিটা। বাড়তেই থাকে তার দস্যিপনা দিনকে দিন-

‘সারাটা ঘর শূন্য খাঁ খাঁ/ খাবার আছে পড়ে
আম্মু বলেন, পাজি ছেলে/ আসুক এবার ঘরে।

আব্বু সোজা ছাদে ওঠেন/ পান যদি তার দেখা
দেখেন, খোকা লাঠি হাতে/ কাঁদছে বসে একা।
কান্না চেপে জানালো সে/ পাড়তে এলাম চাঁদ
কে ভেবেছে এই বাড়িটার/ এত্ত নিচু ছাদ!’
(কে ভেবেছে)

খোকাটা দুষ্ট হলেও কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান। দুপুর রোদে তাকে ঘরে আটকে রাখতে নানান গল্প ফাঁদে কাক্কু। কিন্তু তাকে ফাঁকি দেয়া অত সহজ না। সমস্ত ফন্দি-ফিকির নিমেষেই ধরে ফেলে সে-

‘শোনো কথা সত্যি
দুপুরে বাইরে থাকে/ ইয়া বড় দত্যি।

বিশ্বাস হয় না?
জেনে রাখো কাক্কুটা/ মিছে কথা কয় না।
বুঝে গেছি কাক্কা
আমরা ঘুমিয়ে গেলে/ দিয়ে তুমি ফাক্কা
একা একা হাওয়া খাবে/ রাজধানী ঢাক্কা।’
(বুঝে গেছি)

পড়াশোনায় মন নেই দুষ্টটার। পড়তে বসে নানান জারিজুরি দেখায় সে। বই খুললেই হাই ওঠে তার। কাকুটার ভীষণ চিন্তা তাকে নিয়ে-

‘অঙ্ক দিলে শঙ্কা বাড়ে তাকাস ইতিউতি
অকারণে মিতুর সাথে করিস গুঁতোগুঁতি।

ঘর ছেড়ে তুই ঠা ঠা রোদে ছাদে ওড়াস ঘুড়ি
সন্ধ্যে হলে পড়তে বসে দেখাস জারিজুরি।

বলতো এসব কাণ্ড করে পারবি হতে কিছু?
অবশেষে করবি ফেরি আম, কলা আর লিচু।

ঠিক বলেছ কাকু আমি হবো ফেরিঅলা
টপ টপা টপ করবো সাবাড় আম, লিচু আর কলা। (ফেরিঅলা)

দুষ্ট হলে কী হবে, খোকাটা কিন্তু ইশকুলেও যায় বাবার সঙ্গে। তবে যেতে যেতে কী মজার কাণ্ডটাই না করে বসে-

‘বাঁকা এক সিঁথি কেটে কোঁকড়ানো চুলে
আব্বুর সাথে খোকা ছোটে ইশকুলে
ব্যাগে বই, খাতা আর রঙপেনসিল
খুব খুশি খোকাবাবু, হাসে খিলখিল।
আঙ্গুলে পেঁচিয়েছে নাটাইয়ের সুতো
ইয়া বড় জামা তার পায়ে বুটজুতো।

ইশকুলে পৌঁছে সে যেই তোলে হাই
হায় একী! খোকা দেখি প্যান্ট পরে নাই।’
(খোকাবাবুর ছড়া)

দুষ্টুমিতে কাজী হলেও খোকাটা কিন্তু বড্ড সাহসী। একের পর এক দেশ ভ্রমণ করে সে বিশ্বরেকর্ড গড়তে চায়-

‘বিল্লিটা যাক দিল্লি শহর/ লক্ষ্য আমার আগ্রা
খবর পেয়ে ভড়কে যাবে/ সোঁদরবনের বাঘরা
আগ্রা গিয়ে নাগরা পরে/ ছুট দেবো কোলকাত্তা
বিল্লি বলো ব্যাঘ্র বলো/ কেউ পাবে না পাত্তা।
আমার সাথে পাল্লা দিয়ে/ পারবে কিছু করতে?
পণ করেছি দেশভ্রমণে/ বিশ্বরেকর্ড গড়তে।’
(থাকবো সবার শীর্ষে)

সাহসী খোকাটা মায়ের কাছে স্বাধীনতার গল্প শোনে-

‘স্বাধীনতা সে কেমন/ বলো না মা তুমি?
ওটা বুঝি বাবুটার/ প্রিয় ঝিমঝুমি
নাকি ওটা আকাশের/ চাঁদ-তারা-পাখি?
দাও না মা স্বাধীনতা/ ব্যাগে ভরে রাখি।
শোন খোকা শোন
স্বাধীনতা ধানে ভরা/ সাজানো উঠোন’
(স্বাধীনতা)

গল্প শুনে শুনে খোকারও সাধ জাগে স্বাধীনতাকে কাছে পাওয়ার। তাইতো একদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে-

‘কাকভোরো একা একা/ খোকা গেছে বেরিয়ে
ভাই-বোন-বাবা-মার/
চোখ-কান এড়িয়ে।
…. ….
বাবা খোঁজে পথে-ঘাটে/ ছলছলে মা’র চোখ
খোকা ফিরে আসবেই/ আজ কিবা কাল হোক।
নয় মাস যুদ্ধের/ লেলিহান শিখাতে
মা’র খোকা দেয়নি কো/ দেশটাকে বিকাতে।’
(খোকা ফিরে আসবেই)

জসীম মেহবুবের দস্যি খোকাটার ছোট্ট এক বোনও আছে। দুষ্টুমিতে সেও কম যায় না। দু’জন একসঙ্গে হলে তো কথাই নেই-

‘ছোট দুটি ভাই-বোন/ গুটি গুটি পায়
বিষটিতে ভিজে ভিজে/ লুটোপুটি খায়।
হুটোপুটি খেয়ে ওরা/ ছুটোছুটি করে
ফোঁটা ফোঁটা বিষটিতে/ মুঠো দুটি ভরে
বুটি বুটি জামা পরে/ জুটি বেঁধে হাঁটে
এ রকম দুষ্টু কি/ আছে তল্লাটে?’
( দুষ্টু )

ইশকুলে যেতে মন চায় না খোকাটার। ফুলে ফুলে প্রজাপতিকে উড়ে বেড়াতে দেখে তারও সাধ জাগে প্রজাপতি হবার। তাইতো প্রজাপতির প্রতি খোকার আবদার-

‘তুমি যদি খোকা হতে, আমি প্রজাপতি
বলো না দুষ্টু, হতো কী এমন ক্ষতি?
… …
ভারি মজা হবে, তুমি যাবে ইশকুলে
আর আমি ছুটে যাবো লাল-নীল ফুলে।’
(প্রজাপতি শোনো)

এতক্ষণ বললাম, দস্যি খোকার গল্প। এবার ছোট্ট সোনামণিদের কথা। কী আর বলব! একে খামচি দেয় তো ওকে কামড় বসায়। শ্যাম্পু, সাবান থেকে শুরু করে তেলাপোকার ডিম, লাল পিঁপড়ার ডিম কিছুই বাদ যায় না তাদের খাদ্যতালিকা থেকে। এমনই তিন সোনামণির গল্প-

‘এত্তটুকুন পিচ্চিসোনার/ পিচ্চি দুটো দাঁত
সেই না দাঁতের কামড় খেয়ে/ অন্তুমিয়া কাত।
… …
টপ করে দেয় মুখে পুরে/ তেলাপোকার ডিম
পিচ্চিকে মা সামলাতে হায়/
খাচ্ছে কী হিমশিম!’
(এত্তটুকুন পিচ্চি)

‘তঙ্কাসোনার ডঙ্কা বাজে/ শঙ্কা বাড়ে মার
লঙ্কা খেয়ে কী জানি হয়/ কাণ্ড চমৎকার।’
(তঙ্কাসোনার ডঙ্কা বাজে)

‘মারতে মশা কামান দাগে পুতু
অর্পিতাকে হঠাৎ মারে গুঁতু
ছোট্ট বিনুর বেণীতে টান মারে
ধিতাং তালে নাচতে পুতু পারে।
… … …
পুতুর কথা বলবো আমি কত?
বলতে গিয়ে খাচ্ছি থতমত
পুতুর গল্প যাক না চুকেবুকে
কারণ পুতু খামচি মারে মুখে।’
(পুতু)

পালকির কথা শুনলেই মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা। আর মনে পড়ে ঘোমটা টানা নববধূর কথা। এমনই একটা মজার ছড়া-

‘পালকি চলে হুনহুনা/ ও পাখি তুই গুনগুনা।
… …
জলদি ছুটে আয় না রে/ বউ ধরেছে বায়না রে।
… …
বউ চলেছে পালকিতে/ খোঁপায় বাঁধা লাল ফিতে
নাকে নোলক, দুল কানে/ কোন সখী ওর চুল টানে!
(পালকি চলে হুনহুনা)

জ্যৈষ্ঠ মানেই কাঠফাটা রোদ আর কাঠফাটা রোদ মানেই গ্রীষ্মের ছুটি। আর গ্রীষ্মের ছুটি মানেই পুকুরে লাফঝাঁপ-

‘আম পাকা জ্যৈষ্ঠের/ উত্তাপে ঘামি
জলভরা পুক্কুরে/ ঝুপ করে নামি।
টুপ করে ডুব দিয়ে/ ভুস করে উঠি
আজ নেই কোনো পড়া/ ইশকুল ছুটি।
কাঁচা আমে নুনে-ঝাল/ জিভে জল আসে
কী যে মজা হইচই/ এই মধুমাসে।’
(এই মধুমাসে)

মনে হতে পারে খোকারা কেবল দুষ্টুমিই করে। না, তা নয়; প্রয়োজনে দেশের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা জীবন বিলিয়ে দিতেও পিছপা হয় না। এমনই এক খোকার কথা আমরা জানতে পারি ‘লক্ষ তারার ফাঁকে’ ছড়াটিতে-

‘রক্তঝরা একাত্তরে/ যুদ্ধে গেল রুমী
যাবার আগে বললো মাকে—/ কাঁদছো কেন তুমি?
… …
বলবে আরো—দেশের জন্য/ লড়ছে তোমার খোকা
ফিরবে নিয়ে স্বাধীনতার/ গোলাপ থোকা থোকা।
মায়ের খোকন আর ফেরেনি/ পায়রা উড়ে উড়ে
খুঁজতে থাকে সেই রুমীকে/ বাকুম বাকুম সুরে।’

ছোটোদের আবৃত্তি উপযোগী এ রকম মনমাতানো একঝুড়ি নির্বাচিত ছড়া নিয়ে জসীম মেহবুবের ‘ঝাঁকা ভরা একশ ছড়া’।

প্রচ্ছদ করেছেন মনিরুজ্জামান পলাশ।
অলঙ্করণ করেছেন উত্তম সেন, মোমিন উদ্দীন খালেদ, সব্যসাচী মিস্ত্রী, ফারজানা পায়েল।
আদিগন্ত প্রকাশন থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ বইটি প্রকাশ করেছেন মোশতাক রায়হান।
মূল্য ধরা হয়েছে দুইশত টাকা মাত্র।

বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার রাশেদ রউফকে উৎসর্গ করা বইটি ছোটদের পাশাপাশি বড়দেরও ভালো লাগবে নিশ্চয়ই।

Read Previous

ব‌ই পর্যালোচনা : স্বপ্ন জলে জ্যোৎস্না

Read Next

বই আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *