প্রকাশিত হলো শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের ৫ম সংখ্যা। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্জালে অনুপ্রাণনের যাত্রা শুরু হয়। ইতিপূর্বে আমরা ৪টি সংখ্যা প্রকাশ করেছি। অনুপ্রাণন অন্তর্জাল ৫ম সংখ্যায় ১৭টি বিভাগে মোট ৮০টি লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই লেখাগুলো মূলত আমাদের দেশের সাহিত্যজগতের তরুণদের। বিগত প্রায় ১২ বছর যাবত অনুপ্রাণন তরুণদের সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে এবং তাদের
মোজাম্মেল হক নিয়োগী’র ট্রিলজি: জীবনগল্পের বাঁকবদলের শৈল্পিক বয়ান আবেদীন জনী
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী রচনা করলেন ত্রয়ী উপন্যাস বা ট্রিলজি নভেল। বাংলা ভাষার সাহিত্যে খ্যাতিমান ট্রিলজি-লেখকদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করলেন তিনি। এটা লেখকের ব্যক্তিগত সৃজনভাণ্ডারে যেমন একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন, তেমনই সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে, ত্রয়ী উপন্যাসগুলোর তালিকায় যুক্ত হলো আরো একফালি হীরে। ‘ফাঁদ’, ‘পুষ্পকথা’ ও ‘তৃতীয় অধ্যায়’ শিরোনামের তিনটি উপন্যাসের সমন্বয়ে মোজম্মেল হক নিয়োগী যে ট্রিলজি নির্মাণ করেছেন, তা পাঠ করে সচেতন পাঠকমহল আমার কথার সত্যতা খুঁজে পাবেন- একথা জোর দিয়েই বলা যায়।
মোজাম্মেল হক নিয়োগী ট্রিলজি রচনার পূর্বে মাত্র ৩১টি ট্রিলজি উপন্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে এ সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। বিতর্ক বাদ দিলে নিয়োগীর ট্রিলজি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ৩২তম ট্রিলজি হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ট্রিলজি ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম (১৮৮৭)- এই তিনটি উপন্যাসই প্রথম ত্রয়ী বা ট্রিলজি নামে খ্যাত। এছাড়া খ্যাতিমান ট্রিলজি লেখকরা হলেন- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, বিমল কর, গৌরকিশোর ঘোষ, বিমল মিত্র, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নবীনচন্দ্র সেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, গোপাল হালদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, সতীন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, প্রফুল্ল রায়, দিলীপ কুমার রায়, মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন মাইতি, হুমায়ূন আহমেদ, শওকত আলী, আবু জাফর শামসুদ্দিন, নূরুদ্দীন জাহাঙ্গীর, তানভীর মোকাম্মেল প্রমুখ ।
১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হানা ক্যাথেরিন মুলেন্সের উপন্যাস ‘ফুলমণি করুণার বিবরণ’ কিংবা প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) অথবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫)- যেখান থেকেই বাংলা উপন্যাস রচনার প্রারম্ভকাল ধরা হোক, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে আজ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়ে রচিত মাত্র ৩২টি উপন্যাসভিত্তিক ট্রিলজিকে খুব বেশি বলা যায় না। সংখ্যাটা কম হওয়ার কারণ হলো, ট্রিলজি নামের ধারাবাহিক গদ্যকাহিনি বা সিরিজ নির্মাণ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এছাড়া লেখকের মধ্যে থাকতে হয় চিন্তার বিস্তৃতি। থাকতে হয় গভীর নিমগ্নতা। দিতে হয় ধৈর্যের পরীক্ষা। একরণে পরিশ্রমী ও শক্তিমান গদ্যকার ব্যতীত সার্থক ট্রিলজি রচনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মোজাম্মেল হক নিয়োগীর মধ্যে আলোচ্য গুণাবলি প্রবলভাবে আছে বলেই বিশাল কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। এ লেখকের নিজস্ব সৃজনভাণ্ডারের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাঁর শক্তিমত্তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কেননা, তিনি ৩৫টি উপন্যাসসহ শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। বহুরৈখিক শিল্পভাবনার অজস্র শস্যসোনা তাঁর গোলা ভরা। নিজস্ব নির্মাণ-কৌশল এবং ভিন্ন চিন্তার সাহিত্য-উপাদানের ব্যবহার তাঁর রচনাগুলোকে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ফাঁদ, পুষ্পকথা ও তৃতীয় অধ্যায় উপন্যাসের ট্রিলজিও নিজস্ব শিল্পগুণেই পাঠকের অন্তরে জায়গা করে নেবে।
যে উপন্যাসের তিনটি পাঠ থাকে, মূলত সেটিকেই বলা হয় ট্রিলজি উপন্যাস। আর চারটি পাঠ থাকলে তাকে বলা হয় টেট্রালজি। এ ধরনের সাহিত্যকর্মগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কাহিনির ধারাবাহিকতা। আবার প্রতিটি উপন্যাস আলাদাভাবেও পাঠযোগ্য। প্রতিটি উপন্যাস আলাদাভাবে পাঠ করলে মনে হবে, প্রতিটিই সুখপাঠ্য। প্রতিটিই পূর্ণাঙ্গ ও সার্থক। এই বিশেষ গুণ যে ট্রিলজি বা টেট্রালজিতে যতবেশি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, সেটি ততবেশি সমৃদ্ধ ও সার্থক। এসব বৈশিষ্ট্যের অভাবে কোনো কোনো ট্রিলজি পাঠকদের কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সেগুলো দুর্বল ট্রিলজি বা ট্রিলজি নয় বলেও মতামত এসেছে। কিন্তু মোজাম্মেল নিয়োগীর ট্রিলজি বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুণে প্রোজ্জ্বল ও অনন্য। প্রথম অংশ ‘ফাঁদ’ পাঠ করলে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যাবতীয় মালমসলায় সমৃদ্ধ একটি উপন্যাসের পরিপূর্ণ কাঠামো। এতে সাহিত্যজাত শিল্পের রূপ-রস-গন্ধ কোনোটারই কমতি নেই। হৃদয় জড়িয়ে যাবে শিল্পজালে। শেষ দিকের সমাপ্তি-বক্তব্য সুখপাঠ্য উপন্যাসের মতোই মুগ্ধ করবে। এইভাবে দ্বিতীয় অংশ ‘পুষ্পকথা’ এবং তৃতীয় অংশ ‘তৃতীয় অধ্যায়’ আলাদা আলাদা পাঠ করলে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসের স্বাদ পাওয়া যাবে। আবার তিনটি অংশ পাঠ শেষে মনে হবে, এদের মধ্যে শক্ত সেতুবন্ধন রয়েছে। যথার্থ ও যুক্তিসংগতভাবে কাহিনিটি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তিনটি উপন্যাসকে উচ্চমূল্যের অনবদ্য ট্রিলজি বা ত্রয়ীরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
ফাঁদ উপন্যাসে হতদরিদ্র পরিবারের অষ্টম শ্রেণি পাস অনন্য সুন্দরী কিশোরী পুষ্প মুখোশপরা মানুষের কূটচালে আবাসিক যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়। এক সময় সে উচ্চবিত্ত পুরুষদের মনোরঞ্জনে উচ্চমূল্যের ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন পণ্য হয়ে ওঠে। সবকিছু হারিয়ে আর কোনো পথ না পেয়ে নিরুপায় পুষ্প শরীর বিকিয়েই কামাতে থাকে কাঁচা পয়সা। শুরু হয় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের জীবনযাপন। তাকে ঘিরেই নানাদিকে গল্পের শাখা-প্রশাখা গজাতে থাকে। ট্রিলজির পুষ্পকথা অংশে পুষ্প আবাসিক যৌনকর্মী থেকে নিজেকে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত করতে চেষ্টা করে। এ উদ্দেশ্যে সে বাসার দারোয়ান ন্যায়বান যুবক আব্দুল কাদেরকে ভালোবেসে বিয়ে করে। একসময় কাদের আর দারোয়ান থাকে না। ভালো চাকরি পেয়ে সচ্ছল, উন্নত জীবন পায়। তাদের সংসারে আসে ফুটফুটে দুই যমজ সন্তান- আলোক ও রশ্মি। ঘটনাক্রমে কাদের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হলে দুই সন্তান নিয়ে অকুল পাথারে ভাসতে থাকে পুষ্প। তৃতীয় অধ্যায়-এ এসে স্বামীহারা পুষ্প হয়ে ওঠে জীবনযুদ্ধে হার না মানা পরিশ্রমী ও সংগ্রামী এক ইস্পাতকঠিন নারী। সে নানা রকম ঘাতপ্রতিঘাত সহ্য করে বৈধ ও পরিশ্রমলব্ধ উপার্জনের মাধ্যমে সন্তানদের শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। খড়স্রোতা নদীর প্রমত্ত স্রোতের প্রতিকূলে তরী বেয়ে পুষ্প খুঁজে পায় স্বপ্নময় সবুজ তীর। একারণে এই ট্রিলজিকে বলা যায়- আভিজাত্যের রঙিন মোড়কে আচ্ছাদিত নারীলোভী মাংসাশী কুৎসিত এক সমাজকে পদাঘাত করে, হিংস্র অন্ধকার ঠেলে আলোর দিকে প্রত্যাবর্তনের সার্থক প্রকল্প- জীবনগল্পের বাঁকবদলের সুদীর্ঘ শৈল্পিক বয়ান।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তারা পরিবেশ থেকে পরিচিত এবং সাধারণ উপাদানগুলোকে সংগ্রহ করে সাহিত্য-শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গভীর মনস্তত্ত্বের কারখানায় ভাঙচুর ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে অসাধারণ বা উন্নত সাহিত্যশিল্পজাত পণ্যে রূপান্তর করতে পারেন। কাহিনি বিনির্মাণে বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার সুক্ষ্ম প্রয়োগে এমন এক ঘোর বা মায়াজাল কিংবা নাটকীয় আবহ সৃষ্টি করেন, যা পাঠকদের দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে মন্ত্রের মতো কাজ করে। এজন্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা মাপিক যথার্থ চরিত্র সৃষ্টি ও তার নিখাদ রূপায়ন অত্যন্ত জরুরি। আর চিত্রকল্প সৃষ্টির মতো জাদুমন্তরের খেলায় পারদর্শী লেখকই কথাশিল্পের সুদক্ষ কারিগর হতে পারেন। এসব বিষয়ে মোজাম্মেল হক নিয়োগী অনন্য একজন। তাঁর রয়েছে প্রখর শিল্পবোধ। দীর্ঘ আখ্যান রচনার দুঃসাহস আর অভিজ্ঞতা। এ কারণেই তাঁর রচিত ট্রিলজি শিল্পমান সম্পন্ন অনন্য এক ট্রিলজি হয়ে উঠেছে। এটি পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যায়।
এক নজরে মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ট্রিলজি:
১। ফাঁদ- প্রথম প্রকাশ: ২০১৩, দ্বিতীয় সংস্করণ: ২০২০, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২০০ ২। পুষ্পকথা- প্রকাশকাল: ২০২০, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮৮ ৩। তৃতীয় অধ্যায়- প্রকাশকাল: ২০২২, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪০০ প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন
আবেদীন জনী প্রভাষক মির্জাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ মির্জাপুর, টাঙ্গাইল। মোবাইল ০১৭১০১৭৫৬০৭ ই-মেইল: abedinjonytc@gmail.com