অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মারুফ আহমেদ নয়ন -
মারুফ আহমেদ নয়নের গুচ্ছ কবিতা

হারানো ঘোড়া ও তার সহিস

আমি তোমার কাছে বন্ধকী রাখবো নিজেকে, তারপর চড়া সুদে নেবো ঋণ। যেনো বন্ধকী ছাড়াতে গেলে মনে পড়ে, অসহায়ের একমাত্র সম্বল তুমি। যেমন অন্ধের কাছে তার লাঠি। এইসব ভেবে নিদ্রার ভেতরে কেটে যায়, প্রার্থনার সকাল। জেগে উঠি, রোদ ও হাওয়াকে ফিসফিস করে বলি, তার কি ভেঙ্গেছে ঘুম !

আমি তার স্বপ্নের ভেতরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। যেনো রাত দীর্ঘায়িত হয়। তার চোখের পাতায় লেগে রাত্রির পরশ। পৃথিবীর নির্মল আনন্দে স্বাগত জানাই। তাকে আঁকবো বলে প্রাচীন খূমের রাজ্যে বিচরণ করি। তারপর এক পাহাড়ি গুহায়, এক চক্ষু বিশিষ্ট চিত্রল হরিণীর সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। যখন জেগে উঠে শরীর, ভেঙ্গে পড়ে হাড়ের শেকল। কথা বললে, দূর্বোধ্য মনে হয়।

এমন নিরক্ষর আমি। জানি না, কোনো ভাষাপথ। কি রূপে প্রকাশ করি তোমার মায়াবী রুপের অনল। তাই আদিম মানুষের মতো, তোমার মুখশ্রী আঁকি। একটি জ্বলন্ত আগুনের মশাল আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। হাওয়া এসে উড়িয়ে নেয়। তারপর বৃষ্টির দিন, জলের মৌসুম। কোথায় যেনো হারিয়ে যাই। আমাকে পাওনা তুমি। যেমন হারানো ঘোড়া খুঁজে পায় না তার সহিস।

গোলাপের মৃতদেহ

তোমাকে বিদায় জানিয়ে, পৌঁছাতে পারিনি নিজের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে। নির্জন রাত্রিতে যে শিউলি ফুল ফোটে, সাদা পাপড়ির শরীর নিয়ে সু-ঘ্রাণ ছড়ায় এবং পতঙ্গপরাগী, তা রাত্রিতে ঝরে যাবে এমন সত্যি জেনেও, তুমি কাফনে মুড়িয়ে আমার জন্যে একটি গোলাপের পচন দৃশ্য পাঠালে। তা খুলে নিজেকে আবিষ্কার করা। আমার জ্যোৎস্না খচিত রাত্রি, এসো তোমাকে আলিঙ্গন করি।

তারপর মৌনব্রত ভেঙে, দৃষ্টিপাত করি, চাঁদ-তারকারাজির দিকে। ও চাঁদ, তুমি কি হবে মাশুকের কপালে টিপ। জানো তো, আমার মতো আশেক পাবে না খুঁজে। আমার যা কিছু সব নিলামে তুলে দিতে পারি, বিনিময় যোগ্য কেবল তোমার একটি চুম্বন। সম্মতি জ্ঞাপন করো, এতো স্তুতি করছি, যেনো তুমি প্রাচীন বেদের কোনো শ্লোক।

আকাশের মেঘপুঞ্জ রুপালি পর্দার মতো টেনে দিচ্ছি, তোমাকে ছায়া দেবে বলে। দেখো, বৃক্ষেরা কেমন অপরাগ। তোমার চুলে খেলা করে রোদের ঝিলিক। যেনো বুকের ভেতর একটা মাছ কেবলই ঘাই মারছে, মৌমাছিরা ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহের প্রকল্পে যাচ্ছে ডুবে। তোমাকে বলছি, চতুর্দিকে তুমি। আমাকে ঘিরে হাসি-উল্লাস করছো আর আমি উঁচু একটা পর্বতশৃঙ্গ থেকে গড়িয়ে পড়ছি, লক্ষ ফিট নিচের অন্ধকারে।

তোমার মুখশ্রীর ভাষা

মনে পড়ে না, তোমার মুখশ্রীর ভাষা। কি দুর্বোধ্য। তোমাকে পাই না নিবিড় আলিঙ্গনে, অথচ জড়ো কলসি পেয়ে যায়, তোমার কোমরের গহীন বাঁক। একটা খরগোস ছানা কেবল অরণ্যের অন্ধকারে, অজগরের সামনে লাফিয়ে বেড়ায়, সেই ধূর্ত অজগরটি শিকারকে গিলে ফেলে, তারপর হজমের জন্য পাতার ওমে লুকিয়ে থাকে বেশ কিছুদিন।

এই সুযোগে তোমাকে বুঝে নেবো পুরোপুরি। পৃথিবীর আকাশে উজ্জল চাঁদের সাথে তোমার তুলনা দেবো। ভিজে যাবো অপরুপ জ্যোস্নার পয়ারে। বৌদ্ধবিহারের একটি নির্জন কক্ষে রচনা করবো পদ, তোমাকে পাবার সাধন সংগীত। যেনো লুইপা/কাহ্নপা। তোমার শরীর শস্যবতী মাঠ, কেবল ঘ্রাণে ঘর ছেড়ে বাহির হই। আমার কৃষক মন, শস্যের লোভে উদ্বেল হয়ে পড়ে।

যেনো তুমি আদিম কোনো পুস্তক, তালপাতার পুঁথি-শাস্ত্র। যা কোনোদিন পাঠ করিনি। কেবল অচেনা বর্ণের সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে উঠে যাই, তীরের বালুকায়। স্মৃতিতে, গভীর সমুদ্রের তলদেশ, প্রবালদের বেঁচে থাকা। কাঁকড়াদের কুচকাওয়াজ। জানি, মৃত্যু খুব সহজে পেয়ে যাবে আমাকে বরং তুমি পাবে না। আমার না থাকা জুড়ে, তোমার বিরহ বাগানে হাহাকার করবে মাথা কাটা গোলাপের কুঁড়িরা।

মাংসের হিমায়িত কারাগার

দীর্ঘকাল তোমার হৃদপিন্ড ও মাংসের ওমে ঘুমিয়ে থেকেছি। তোমার শরীর কবে যেনো রুপান্তরিত হয়েছে, মাংসের হিমায়িত কারাগারে। স্মরণে আসে না। কেবল খুনির পোশাক পড়া, তিলাইয়া প্রজাপতির মতো নার্সটি চিড়ে ফেড়ে দিচ্ছে বুকের ছাতি। তখন আমি শ্বাস-প্রশ্বাসহীন,বেখেয়ালে লাশের সঙ্গে বদল করে নিয়েছি, জীবন। যেনো বিনিময় প্রথা।

তারপর নিজের আত্মার প্রতি সংশয়। পাখিদের ক্ষেত্রে এমন ঘটে না, তারা তো প্রবল আত্মবিশ্বাসী। তোমার চোখে কাজলের মাধুর্যতা আমাকে সেই প্রাচীন শাল-পিয়ালের বনভূমির দিকে টেনে নিয়ে যায়। ঋতুস্রাব সেরে উঠা বালিকার মতো কোমল তুমি। আমরা ঘাসে গলা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতাম, চাঁদের আলোয়। আমার মূর্খতা দেখো, তোমাকে হারিয়ে ফেললাম।

তারপর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাইনি। মহাকাশ থেকে মহাপাতাল পর্যন্ত। বুঝিনি, হারানো কোহিনূর হাত বদলে শোভা পাবে অন্যের রাজকীয় মুকুটে। সে পেয়ে যাবে স্বর্গীয় ঝরনাধারা। অবিরত পানের পিপাসা, জানি তাকে আরও পিপাসার্ত করে তুলবে। তুমি হলুদ পাতাদের জীবনী পড়তে গিয়ে, নিরক্ষর পোকাদের ভাষা বুঝে ফেলবে। জানবে, আগুন যতোটা না পোড়ায় বাহ্যিক ত্বক, তারও অধিক হৃদয় পোড়ায়।

আদিম মৃত্তিকার ঘ্রাণ

এক সুন্দরের সাধনায় বরবাদ হয়েছি। তাকে গোপনে বলেছি, ভালোবাসি। শব্দটি যেনো অভিশাপের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গ্রহান্তরে। এখন যেখানেই  যাই, বৃক্ষের শীতল ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিই। চতুর্দিকে শুনি, হারানো শব্দটির ফিরে আসার প্রতিধ্বনি। আত্মমগ্ন বালকের মতো, দিঘির জলে দেখি নিজের ছায়া। নার্সিসাস নয়। এক জলময়ূরীর নৃত্যের মুগ্ধতা দেখি, পদ্মের পাতায় পাতায়।

আমি এই জলময়ূরীর প্রেমে পড়েছি। আমি ওই পদ্মফুলের প্রেমে পড়েছি। যখনই পেয়েছে সে, তোমার হাতের স্পর্শ, জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এইসব উপমা ও ভাবের বাহন। আমি প্রেমে পড়েছি তোমার। এক আদিম মৃত্তিকার। আমাকে গ্রহণ করো। যদিও তোমার প্রেম, গ্রাস করতে পারেনি সম্পূর্ণ মনোজগৎ। আমার আত্মার অনুবাদ তুমি, প্রতিধ্বনি তাড়িত শব্দের ব্যঞ্জনা। আমি ভাঙা চোরা ইমারতের জীবন।

পেয়েছি এক বৃক্ষজন্ম, ছড়ানো শেকড়ের বন্ধন। আমাকে চিনে রাখো, বিদায়ের মতো করুণ কন্ঠস্বর। ছাদবিহীন প্রাসাদের গম্বুজ ও কাঠের বেষ্টনী।  জেনো, মানুষ এক ভ্রমের সকাল। বেজে উঠা তানপুরার বাজনা। আমাকে করিও ক্ষমা, যত লিখি তোমার প্রসঙ্গে কেবল কম হয়ে যায়।

+ posts

Read Previous

মোহাম্মদ হোসাইনের গুচ্ছ কবিতা

Read Next

লতিফ জোয়ার্দার-এর গুচ্ছ কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *