অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ২১, ২০২৪
৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ২১, ২০২৪
৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মারুফ আহমেদ নয়ন – গুচ্ছকবিতা

মারুফ আহমেদ নয়ন

স্তোত্রসমূহ লীন হয় মাশুকের নামে

তাবেবুয়া গোলাপের অরণ্য তোমার প্রশংসা লিখি। বিপর্যস্ত হলো সবকিছু। বুনো হস্তিনীর ক্রোধ নেমে এল সবুজ শস্যভূমিতে। মাহুত বন্ধু কি জানে, স্তোত্রসমূহ লীন হয় মাশুকের নামে! মহুয়া ফুলের সুবাস তাহার দেহের উপকূলে। ঢলে পড়ি গাঢ় অন্ধকার বন্দরে। তোমার খোঁপায় গুঁজে দিই নক্ষত্রের গাজরা। ইর্ষান্বিত হয় স্বর্গীয় অপ্সরা।

হাওয়া ও অগ্নিতে আশ্চর্য সুর ও সংগীতের মহড়া। নিকটে এসেও তুমি ব্যথিত হবে। খাঁচায় বন্দি ডাহুকীর প্রাণ। ছটফট করে। বুঝি, তোমাকে ভুলে কি দুর্গতি আমার। জেনো, সৃষ্টিলগ্নে জলমগ্ন ছিল পৃথিবী, জন্ম হলো প্রাণের। আদিতে নিরাকার ঈশ্বরই সত্য ছিলেন। পাখির কুহুতান এল। ভূ-মণ্ডলজুড়ে ফুটে উঠলো মন্টসেশিয়া ভিডালি।

তখনো কি তোমাকে বেসেছি সম্পূর্ণ ভালো। গুহার দেয়ালে এঁকেছি, বনমোরগের লাল ঝুঁটি। পরনে গাছের ছাল-বাকল। মাতা হিসেবে জেনেছি প্রকৃতিতে। তোমাকে জেনেছি মরমিয়া ধনুক, আমার মরণ। অযুত নিযুত কোটি বছর ধরে শুধু তোমার প্রেমে সাব্যস্ত হয়েছি। বরফের কফিনে ঢুকে পড়েছি, অমর যুবা। চিরউন্মাদ এই অক্ষরযোজক বলো, কেন তোমাতে হলো ধ্বংসোন্মুখ।

সুফি নৃত্যের পাঠ

মোনাক প্রজাপতি ও চন্দন বনের রূপকথা তোমাকে শোনাব বলে, মাসালং নদী তীরে পেতেছি মাছরাঙ্গার সংসার। শিকার করি মাছের আয়ু। লুকিয়ে পড়ি গাছের স্বর্গে। রাত্রির সামিয়ানা নিয়ে নেমে আসবেন, দ্রাক্ষারসের দেবী। যিনি জানেন, ঝর্ণা ও পাখিদের তদারকি। তিনি আমাকে দেবেন, মহব্বতের ফায়সালা। এতকাল বিদীর্ণ হৃদয় নিয়ে কেন ঘুরেছি সূর্যমুখী ও সাপেদের অভয়ারণ্যে।

জেনেছি, ফুলের যৌনতা। তোমার কুশল। উদ্ভিদের কামনায় অপরিচিত পতঙ্গজন্ম। তোমাকে পেতে মরিয়া আমি, হারিয়েছি রাত্রির পূর্ণ চন্দ্রিমা। মধুর লগন পেরিয়ে যায়। তুতেনখামেনের সৌরনৌকা ভাসে নীলনদের জলে। সম্রাট মেনকৌরকে যখন পাতার আয়ুর প্রসঙ্গে বললেন পুরোহিত। তাতেই বিমর্ষ সম্রাট উজ্জ্বল আলোকে কয়েদ করলেন রাত্রির পিঞ্জিরায়। নিদ্রাকে ডুবিয়ে রাখলেন মদের পাত্রে। মত্ততা আমোদ-প্রমোদে।

তোমাকে হারানোর ভয়ে ভীত হৃদয়। নির্জন রাত্রির শরীরে চুম্বন করি। বলি, আমাকে করলে হরণ। লুকিয়ে রাখলে প্যাংগং লেকের জলাধারে। যেদিকে দৃষ্টিপাত করি, রুক্ষ পাহাড় ও মরু জ্যোৎস্নায়, নিজেকে ভারবাহী গাধা মনে হয়। বলি, এক সামান্য বংশীবাদকে কেন শেখালে তুমি সুফি নৃত্যের পাঠ!

মারসুপিয়ালের মার্গ সংগীত

আমার প্রণয়পীড়িত হৃদয়, তোমাকে দিলাম। সঙ্গমরত মারসুপিয়ালের মার্গ সংগীত। ভাষান্তরে অকেজো হতে থাকি। কেবল নিঃসরণ হয় টেস্টোস্টেরন হরমোন। পাখিদের স্বরলিপি গাইতে এসে ভুলে গেছি, রজনীবৃত্তের সংখ্যাতত্ত্ব। আমাকে সরিসৃপের পাঠশালায় কে শেখাল, মুরসি বিবাহের গীত। সে এক সুললিত কমলাবউ।

যখন বুনো সন্ধ্যায় বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনায় করছিল পাখিরা। তখন খণ্ড খণ্ড মেঘদল এসে জড়ো হচ্ছিল আকাশে। বৃক্ষেরা যূথবদ্ধ হয়ে পড়ছিলো স্রষ্টার নামের তাসবীহ। তখন ভাল্লুক দম্পতি রুগ্‌ণ শিশুটিকে শোনাচ্ছিল অরণ্যের রূপকথা। বুনো খরগোশ ও কচ্ছপের মশকরা। স্বপ্নের ভেতরে কেবল পোকামাকড়ের রহস্য। জানি, মৃত্যুর পরে ভাল্লুক শিশুটি দাঁড়িয়ে থাকবে দু-পায়ে ভর করে।

ভোরের আলো ফুটছে চারদিকে। গাছে গাছে পাখিদের কলহ। তোমার শোকে বিহ্বলতা এল। তোমার দিকে যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অন্ধকার এসেছে। অরণ্যে প্রেত সেজেছি। আমাকে দেখে ভীত হয়ো না।

জাদুকরী ভ্রমের বাঁশরী

তোমার নিকটে এলে, হিম্বাদের জাদুকরী ভ্রমের বাঁশরী। অ্যাঙ্গোলার কুনেনে নদীর জলস্রোতের লহরী শুনি। বন্য মহিষের মেজাজ কি শিশুসুলভ! বসন্ত ঋতুতে, স্বামী গিয়েছেন পশুচারণ ভূমির সন্ধানে। গৃহে একাকী স্ত্রী খুলে দিচ্ছে চুলের বেণি। লাবণ্যময় প্রভা। কয়লার আগুনে পুড়ছে কফিফোরার পাতা। ধোঁয়ায় সেরে নেবে ধূম্রস্নান। গলা থেকে খুলে রাখে পুঁথির কারুকাজ।

সন্তান প্রসবকালীন ঋতুতে, নারীটি লাভ করবেন মাতৃত্ব। বিজ্ঞ ধাত্রীটি এসেছেন সঙ্গে দূরের পবিত্রভূমিতে। সেখানে পূর্বপুরুষগণ প্রার্থনায় ঋজু হয়েছেন। শিশু ভূমিষ্ঠের পরে পাঠ করা হবে জন্মগীতিকা। পবিত্র অগ্নি বিলিয়ে দেবে তার শুভেচ্ছা। জানাবে, দীর্ঘায়ু হও, ভূমিপুত্র। এই শস্য ও সমৃদ্ধির ঋতুতে তোমাকে স্বাগতম। নিকটে এসো বার্তাবাহক। বখশিশ নাও, এই পশুপাল।

জেনো, সন্তান শুভ সংকেত। শস্যবীজ ও পশুপাল প্রাচুর্য। অমরত্ব প্রাপ্তির রাতে মহাকাশে ঘটেছিলো উল্কাপিণ্ডের পতনদৃশ্য। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে! মৃত্যু। পশুর শিং দ্বারা চিহ্নিত পাথরখণ্ডের ভূমিতে মাটিতে দাফন করে দাও আমাকে। অনন্ত ঘুমে ডুবে যাই। যাকে বলছো শেষকৃত্য। সে এক দীর্ঘ ভোজসভা, পশু উৎসর্গের উৎসব।

পূর্ণজন্মের এক সন্ধ্যায়

তোমার প্রেমে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছি। পূর্বজন্মের এক সন্ধ্যায় ল্যাটমাস পর্বতের তৃণভূমিতে মেষপালকের মতো ঘুরেছি। আকাশে মেঘের উড়াল রথে চন্দ্রদেবী উদিত হলেন পূর্ণ প্রভায়। যদি পূর্ণ হয় মনোবাসনা, তোমার প্রতি গভীর অনুযোগের কাল। ক্লান্তি আসে, মেষের পশমের ন্যায়। গৃহে ফেরার পথ হারিয়ে ঘুরছি অনন্ত পর্বতলোকে।

ঘুমিয়ে পড়েছি পাহাড়ি ঢালে। মখমলে ঘাস যেন শীতলপাটি। একদা এমন নিদ্রামগ্ন হতে চন্দ্রদেবী সেলেনে জিউসের নিকটে করজোড়ে মিনতি করেছিলেন, চিরযুবা অ্যান্ডিমিয়ন নিদ্রামগ্ন থাকবে। যেন ক্ষয় না হয় রূপ ও লাবণ্যের মৃৎ। যেন তুমি এসে মিশে যেতে পারো হৃদয়ের গভীরতম খাদে। অনুভবে পাও, উষ্ণ আলিঙ্গন। যদিও করুণ এই ঋতুতে, অ্যানিমোন ফুল ঝরে।

জানি, তুমি আমার হৃদয় বধ করেছিলে কৌশলে। অরণ্যে বুনো শূকরের বেশে অ্যাডোনিসকে হত্যা করেছিলেন যুদ্ধদেবতা অ্যারিস আর প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি তার শবদেহটি অরণ্যের ভেতর থেকে টেনেহিচঁড়ে বের করছেন। ক্ষতস্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অমৃতের বাসনা। পাতালপুরীতে গুঞ্জন উঠছে, তোমার প্রেম হত্যাকারী। তুমিও হত্যাকারী।

ওলেন্ডার ফুলের পাপড়ি

প্রাচীন পাপে বিদ্ধ হৃদয়! চিরসবুজ বনতলে কাঠময়ূর ডেকে উঠে তীব্র শিসে। মহামহিম ফাগুনে, ফুটছে কখন নীলাভ কাঞ্চন, তার সৌরভ বয়ে আনছে মাটির খাঁচায়। আমি মহুয়া মাতাল হাতিটির মতো ঘুমিয়ে পড়েছি। বুঝি, শরীরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলো রুহের। তোমার সুমিষ্ট কথার বিষে জর্জরিত হৃদয়, পান করতো ওলেন্ডার ফুলের পাপড়ি। এতদিন ভুল প্রেমের মরুভূমিতে ফোটালাম সাগুয়ারো ক্যাকটাস।

তোমাকে পাঠালাম, এ হৃদয় তোয়ফা। কবুল করো। অথচ তুমি ফিরিয়ে দিলে। খোয়াবে হেঁটে গেলে ত্রিবেণীর স্রোতে। নিজেকে প্রস্তুত করলাম, পাথর হতে। যেহেতু পাথরের চোখে আসে না, অশ্রু। তাই ফোগস্ট্যান্ড বিটলের মতো কুয়াশা থেকে সিঞ্চন করেছি জল। হাওয়ায় আর্দ্রতায় শিখেছি, মোমের দহন প্রাচুর্যের স্মৃতি। মৈথুনপ্রিয় বালকের মতো খেলছি জুয়া। যদি এ আসরে নিজেকে রাখি বন্ধকী।

তবে কি ব্যর্থ হবে শতরঞ্জের চাল। তুমি অনায়াসে তুলে নেবে জিত। আমার নসিব গোলামের। মিশর থেকে কেনানে ঘুরছি দাস বিক্রির হাটে। অনুগ্রহপূর্বক আমাকে ক্রয় করুন, লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে। যেহেতু এ তল্লাটে আমিই একমাত্র বাধ্য গোলাম।

 

+ posts

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা