অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১২, ২০২৪
২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ১২, ২০২৪
২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রেহানা বীথি -
অচিনপাখি

একটা মশা কানের কাছে পোঁ পোঁ শব্দ করছে সেই তখন থেকে। আরামের তন্দ্রাঘোর কেটে যাচ্ছে বারবার। কেটে যেতে যেতে কখন যে সুখীর অবসন্ন শরীরটা তলিয়ে যায় ঘুমে , ও টেরই পায় না! অচেতন হয়ে পড়ে অল্প সময়েই। সারাদিন ধরে ও প্রতীক্ষায় থাকে রাতের। আহা রাত, বড়ো আরামের রাত! শক্ত সিমেন্টের মেঝেতে পাটি, তার ওপর একটা মোটা কাঁথা, সিথানে বালিশ… বড়ো আরাম দেয় সুখীকে। সব কাজ সাঙ্গ করে যখন গুটিয়ে রাখা বিছানাটায় পেতে দেয় শরীর, যেন তখন মটমট শব্দ করে ওঠে ওর শরীরের সবগুলো খিল। মটমট করে খুলে যায় খিলধরা শরীরের বাঁধন। আলগা হয়। আলগা হয়ে আরামে ঢলে পড়ে ঘুমে।

এই আরামের মাঝে একটা স্বপ্ন আসে রোজ। স্বপ্নে কী সব যে দেখে সুখী! যা দেখে, সেসবের কোনো ঠিকানা করা ওর মতো একটা আধা পাগলির জন্য মোটেও সহজ কাজ নয় গো! যে আরামে ঘুমে ঢলে পড়ে ওর শরীর, কেন যেন মনে হয় ওই স্বপ্ন তার চাইতেও বেশি আরামের। এমন আরাম যে স্বপ্নে পাওয়া যায়, তা ও জানতোই না! প্রতি রাতে স্বপ্নটা যখন শুরু হয়, সারা গায়ে আচমকা এক শিরশিরানি। ওই শিরশিরানিতে থেকে থেকে হেসে ওঠে ও। কিন্তু জোরে হাসে না। জোরে হাসতে হয় না। স্বপ্নটাই তো ওকে ফিসফিসিয়ে বলেছে সেকথা,

 -খবরদার সুখী, জোরে হাসবি না, কোনো শব্দও করবি না। তাহলে কিন্তু আমি আসবো না তোর কাছে। এই আরামের স্বপন তোর আর ধরা দিবে না!
জেনেশুনে নিজের এতবড়ো ক্ষতি করার মতো পাগল তো সুখী নয়! তাই ও হাসে, কিন্তু নিঃশব্দে। আর আরামের তোড়ে যে শব্দগুলো আসতে চায় একেবারে গলার গভীর থেকে, সেগুলোকে অনেক চেষ্টা করে ওই গভীরেই রেখে দেয়। তারপর… স্বপ্নটা যখন শেষ হয়, আবারও অচেতন হয়ে ঢলে পড়ে। সেই অচেতন থেকে চেতনায় ফেরে ভোরবেলায়, মামির ডাকে।

চেতনায় ফিরে বটে, কিন্তু শরীর জেগে উঠতে চায় না সহজে। গা ম্যাজম্যাজ ভাবটা থেকেই যায়। তবু উঠতেই হয়! না উঠলে সংসারের কাজ শুরু হবে কেমন করে? আর সুখী ছাড়া কাজগুলো কে করবে শুনি? কাজ করার জন্যেই তো মামা ওকে নিয়ে এসেছে গাঁ থেকে। কে জানে কত বছর আগে এসেছিল সে এ বাড়িতে, তখন হাফপ্যান্ট পরতো সুখী। একটু আলাভোলা গোছের। চট করে কিছু বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ্তায়ালা ওকে দেয়নি। দেয়নি বলেই তো পাগলি ও।

মামা নিয়ে এসেছিল, আর মামি সেই হাফপ্যান্ট পরা সুখীকে হাতে ধরে ধরে কতো কাজই না শেখালো! নিজের মেয়ের মতো করে বড়ো করে তুললো। করবে না, নিজের ছেলেপুলে নেই যে! সংসারের সব কাজে সুখী এখন খুব ওস্তাদ। হাফপ্যান্ট ছেড়ে কবেই সালোয়ার কামিজ পরা ধরেছে। গায়ে গতরে ডাঙর বেশ। ধীরে ধীরে যতো বেড়ে উঠেছে, শরীরের বাঁকগুলো যেন একসাথে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ধাঁই করে। গায়ের রঙটাও খোলতাই। চেহারাটাও মন্দ নয়। দোষের মধ্যে শুধু ওই মাথা। মাথাতে ঘিলু বলতে বুঝি কিচ্ছু নেই। বড়ো বড়ো দুইচোখ আর গালের একদিকে হেলে পড়া দুই ঠোঁট দেখলে ঘিলুহীনতার পরিচয় মেলে মুহূর্তেই। তবু সংসারের কাজগুলো যে ঠিকঠাক মনে রেখে করতে পারে এই অনেক! মাথায় ঘিলু না থাকায় অসুবিধে যেটুকু, তারচেয়ে বরং সুবিধেই বেশি। কোনো কাজে আপত্তি করে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা হাসিমুখে শ্রম দিয়ে যায় সংসারে। মামা বোধহয় এই সুবিধের কথাটা আগেই আন্দাজ করেছিল। যাই হোক, যা বুঝেই এনে থাকুক মামা, সুখেই তো আছে সুখী এখানে। প্রতিদিন পেট ভরে গরম ভাত, মাছ, মাংস এসব কোথায় পেতো গাঁয়ে থাকলে? আর ঘুমের মাঝে ওই স্বপন? ওটাও পেতো কিনা সন্দেহ।

গাঁয়ের দিনগুলোর কথা আবছা মনে পড়ে সুখীর। মনে পড়ে রাতের কথাও আবছাভাবেই। সেসব রাতে কি স্বপন ছিল না কোনো? ছিল তো! প্রায় রাতেই স্বপ্ন দেখতো সুখী, রোগা টিনটিনে এক বুড়ি ধাওয়া করছে ওকে। আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করতেও চাইতো ও, কিন্তু পারতো না। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হতো না। বের হলে তো মা যে অমন চেয়ে চেয়ে দেখতো, বাঁচাতো না সুখীকে? হয়তো বাঁচাতো, হয়তো না। পাগল-ছাগল সন্তানকে নিয়ে তো মা তার ফাঁপরেই ছিল। একে মেয়ে, তাই আবার আধা পাগল। এই মেয়েকে পার করবে সে কেমন করে? এমন চিন্তা থেকে মুক্তির স্বাদ যে এতো আচমকা পেয়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি সুখীর মা।

যেন অনেকখানিই স্বস্তি পেয়েছিল মা, যাক না, মেয়েটা তার যাক দূর সম্পর্কের মামার সাথে। দুমুঠো ভালো খাবার তো জুটবে কপালে। কিন্তু সারাজীবনই কি সুখী থেকে যাবে ওই মামার কাছে? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর বোধহয় খোদ খোদা তায়ালার কাছেও নেই। থাকলে তো এতোদিনে একটা কোনো সংবাদ অন্তত পাওয়া যেতো।
বছর গড়িয়ে মা-বাপ যখন দেখতে আসে সুখীকে একদিনের জন্য , সুখী তখন ভেবেই পায় না, কেমন করে তার মা-বাপের কালো কালো চুলগুলো প্রায় সাদা হয়ে গেছে। ওর ছোটো ছোটো ভাইবোনগুলোও আসে মাঝেসাঝে। কিন্তু তারাও যে আর ছোটো নেই! একেকজন বেশ ডাঙর। সুখীর পরনের ঝকঝকে জামা-কাপড়ে চোখ আটকে যায় তাদের। ওরা জানতে চায়,

-বু, তুই খুব সুখে আছোস, তাই না রে?

মা-বাপও নিজেদের বুকে হাত বোলায়, তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়ের সুখ দেখে কার না ভালো লাগে? ভালো লাগে তো সুখীরও। খুশিতে ঝলমলে মা বাপের মুখগুলো বড়ো ভালো লাগে ওর। মাঝে মাঝে ওর যে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘামের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমোতে ইচ্ছে করে, সেকথাটা বেমালুম চেপে যায় সে মনে বুঝেই। কে জানে, এ কথা শুনলে হয়তো ওর সুখ দেখে ঝলমল করতে থাকা মায়ের মুখটা দপ করে নিভে যাবে! হয়তো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না ভেবে মায়ের বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠবে! থাক না, যেভাবে জীবন চলছে চলুক! ঘুমে, স্বপনে কেটে যাক তার রাতগুলো!

মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে যেন কেউ। নাকি উকুন দৌড়ে বেড়াচ্ছে? বেশ বড় উকুন বোধহয়। এমনভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে মাথার ভেতর যেন একটা ধেড়ে ইঁদুর। উকুনটা বুঝি মাথা থেকে নেমে এসেছে ওর গলার কাছে। সুড়সুড়ি লাগছে গলায়। উকুনটা এক ধাক্কায় গলা থেকে নেমে যায় তলপেটের ওপর। সুখী শিউরে ওঠে। হঠাৎ ওর জামাটা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। জামাটা যখনই পেট পেরিয়ে বুকের কাছে আসে, একলাফে বেরিয়ে পড়ে ওর বুকের পদ্মদুটো। দেখা যায় না, ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর ঘনঘন নিঃশ্বাস টেনে ওর পদ্মদুটোর ঘ্রাণ নিচ্ছে উকুনটা। ঘ্রাণ টেনে নিতে নিতে আচমকা এক কামড় বসিয়ে দিলো। ওহ্ মা গো! সুখীর চিৎকারে হাত চাপা দিয়ে দিলো উকুনটা! নাহ্, যা ভেবেছিল সে তাই-ই ঠিক, উকুন নয়, ধেড়ে ইঁদুরই হবে ওটা। তা না হলে এতবড়ো হাতের থাবা সে পেলো কোথায়? সেই থাবায় এখন তো আবার পাজামার গিঁট খুলছে। খুলে সরসর করে নামিয়ে একটানে বের করে নিলো পা থেকে। ওর সারা শরীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে ধেড়ে ইঁদুরের হাত। আবেশে বুঁজে আসে সুখীর চোখ। কিন্তু ও চোখ মেলে থাকতে চায়। দেখতে চায় ইঁদুরের মুখটা। কেমন দেখতে সে? এ প্রশ্ন মনে জাগে বারবারই। প্রশ্নের উত্তর আসে না। তার বদলে ইঁদুরের গোঙানির শব্দ ভেসে আসে যেন কোনো খাদের ভেতর থেকে। গোঙানির সাথে কিছু শব্দ, ফিসফিস…

-তোর ভালো লাগে না সুখী! সুখ পাস না?

 এতক্ষণে সুখী যেন জেগে ওঠে পুরোপুরি ।

-ও আল্লাহ্, এ তো তার সেই স্বপন! এতক্ষণ বুঝবার পারে নাই ক্যান? লোকে কি আর সাধ কইরা তারে পাগলি কয়? সাধের স্বপনডারে এতক্ষণ ধইরা কী না কী ভাবছে! ঘুমে এমন অচেতন হইছে আইজ, নিজের স্বপনডারেও চিনবার পারে নাই!

স্বপন তার পায়ের ফাঁকে জায়গা খুঁজে নেয় । জমাট আঁধারে টেনে নেয় ওর শরীরের সমস্ত সুধা। ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে সুখীর পাশে। সারা শরীরে সুখ নিয়ে ঘুমিয়ে যায় সুখীও। কিন্তু এই সুখ আর স্বপনে নজর লাগলো বুঝি কারও। বেশ কদিন ধরেই সারাক্ষণের চনমনে ভাবটা নেই সুখীর। মনটা কেন যে উদাস উদাস। ভাতের থালায় মাছের টুকরোটা নীরবেই পড়ে থাকে। গপাগপ একথালা ভাত খেয়ে নিয়ে আবার নেয় যে মেয়ে, তার থালায় ভাত বোধহয় বাচ্চা পাড়ে। একটুও কমে না সেই ভাত। কেমন করে কমবে? ভাত মুখে দিতে গেলেই যে পেটের ভেতরটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় গলা দিয়ে। খাবারের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে।

ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে আকুল হয়ে কাঁদে সুখী। ও কি মরে যাবে? শুনেছে মরণের আগে মানুষের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে কাজ করা, কথা বলার শক্তিও চলে যায়। ওরও কি তাই হবে? ও তো খেয়াল করছে কদিন ধরেই, শুধু যে খাবার দেখলেই গা গুলায় তা তো নয়, ওর তো কোনো কাজ করতেও ইচ্ছে করে না! সারাক্ষণ বুকের ভেতর তোলপাড় হয়, থেকে থেকে চোখেও আন্ধার দেখে। একেক সময় তো মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যাবে সে! সেদিন মামির সামনেই তো এমন মাথা ঘুরে উঠলো, মামি যদি না ধরতো, পড়েই যেতো তো সে!

আজকাল রাতের বেলায় ঘুমের দেশের স্বপ্নটা যখন এসে ওর বুকের ওপর চেপে বসে তখন আগের মতো আবেশে জড়িয়ে আসে না দুচোখ। মনে হয় দম আটকে মরেই যাবে সে। একটুও ভালো লাগে না। স্বপ্নটার গা থেকে কেমন যেন একটা কটু গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দেয়। মনে হয় বড়ো চেনা সেই গন্ধ। কোথায় পেয়েছে… কোথায় পেয়েছে ওই গন্ধ? খুঁজতে খুঁজতে থেমে যায় স্বপ্ন। বাকি রাত আর ঘুমই আসে না ওর! গন্ধটার হদিস জানার জন্য মনের ভেতর ছটফটানি নিয়ে ভোর হয়। এমনই এক ভোরে মামি এসে চুপিচুপি বসে ওর পাশে। যতটা চুপিচুপি এসে বসেছে মামি, তারচেয়েও হাজার গুণ বেশি চুপিচুপি জানতে চায়,

-কেউ কি তোর শরীরে হাত দিয়েছে রে সুখী?

ফ্যালফাল করে তাকিয়ে মামির কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সুখী। শরীরে হাত? সে তো কতজনেই দিয়েছে। বাপ-মা, ভাই-বোন, মামি, এরা সক্কলেই তো কোনো না কোনো সময় গায়ে হাত দিয়েছেই, দেয়ও। সেই কথা এত চুপেচাপে জিজ্ঞেস করার কি আছে? মামির মাথা কি খারাপ হয়ে গেল?
মামির মাথা নিয়ে সংশয় চেপে রেখেই বলে সে,
-হ, দিছে তো! মা-বাপ, ভাই-বইন আর আপনে! ক্যান মামি, কি হইছে?

একটু যেন রাগই হয় মামি। বলে,

-ধুর পাগলি, এই হাত দেওয়া সেই হাত দেওয়া না। বাইরে যখন খাওয়ার পানি আনতে যাস, তখন কি কেউ তোকে ডাকে? ডেকে গায়ে হাত দেয়?

এবার বুঝি বুদ্ধি একটু খোলে সুখীর। চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বলে,

 নাহ্ মামি, পানি আনোনের সময় কেউই ডাইকা গায়ে হাত দেয় না। পাশের ফ্যালাটের শরীফার লগে কথা হয় মাজে মইধ্যে। কিন্তু তার কাঙ্খে তো কলসি থাকে আমার মতনই। সে আমার শরীলে হাত দিবার পারবো ক্যামনে? দুই-চাইরডা সুখ-দুঃখের কথা কই, ছেমড়িডা বড় ভালা।

মামি তার ধৈর্য্য হারিয়ে বলে,

 – আরে পাগলি, কেউ তোর পায়জামা খোলে কিনা বল! তোর বুকে হাত দেয় না?

এই কথা শুনে বুদ্ধির ঢেউ খেলে যায় সুখীর মাথায়। মামি কি অর স্বপ্ননের কথাডা জাইনা গেল? কিন্তু ও তো কয় নাই কিছু! স্বপনের সাবধান বাণী অক্ষরে অক্ষরে মাইনা চলছে! তয়?

ওকে চুপ থাকতে দেখে মামী আবার বলে,

-কী রে, কথা বলিস না কেন?

মামির এত বুদ্ধি দেখে তাজ্জব যায় সুখী। এত জ্ঞান ওর মামির! না কইলেও মাইনষের স্বপনের কথা টের পাইয়া যায়! নিজের ঘিলুহীন মাথার জন্যে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। বলে,

-একটা স্বপন আসে রোজ রাইতে আমার ঘুমে। আমারে খুব আদর করে গো মামি! গায়ের জামাডা খুইলা ফ্যালায়, পায়জামাও। কিন্তু মামি, সে কইছে কাউরে না কইতে। কইলে বলে আমার কাছে আর আসবো না। আপনেরে যে কইছি, এইডা য্যান তারে কইয়া দিয়েন না!

আচমকা এক থাপ্পড়ে চমকে যায় সুখী। বনবন করে ঘুরে ওঠে মাথা। মামি ওকে মারলো কেন? এমন কী অন্যায় সে করেছে? শুধু স্বপনের কথা বলাতেই এত রাগ? কিন্তু মামি তো আগে থেকেই জানতো! মামি বলাতেই না ও বলে দিলো সব, তাহলে? এতো বছরে একবারও মারেনি যে, সেই মামিই কিনা এতো জোরে একটা থাপ্পড় মারলো! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সুখী। এই কান্না দেখেও কেনো যেনো একফোঁটা মায়া হয় না মামির। চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে,
-বল, কে আসে রোজ তোর কাছে? কার সাথে শুয়ে থাকিস তুই রাতে?

ন্যাও ঠ্যালা, সেটা কি সুখীও ঠাওর করতে পারে ঠিকঠাক? স্বপন আসে… স্বপন! সুখী তো স্বপনটাকেই দেখে! তবে কয়েকদিন থেকে স্বপনটার গা থেকে একটা খুব চেনা গন্ধ পাচ্ছে যেন। মামিকে বলবে কি সেকথা? বলবে কি, অনেক চেষ্টা করে সে উদ্ধার করেছে, ঠিক ওই গন্ধটাই মামার গায়েও আছে ?
কিন্তু বলে না। আবার যদি মারে মামি!

সকাল পেরিয়ে যায়, পেরিয়ে যায় দুপুর- বিকেল -সন্ধ্যা -রাত, তারপর দিন। তারপর দিনের পর দিন। মামি একটাও কথা বলেনি সুখীর সাথে আর। স্বপনটাও আসেনি সুখীর কাছে। কথা তো ঠিকই। কেউ জানতে পারলেই আসবে না সে আর, এমন বিপদের কথা তো সুখী জানতোই। না আসুক, সুখীরও তো ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে গায়ের ওই গন্ধটা। কিন্তু মামি যে কেনো এত রেগে গেলো ওর ওপর? এমন স্বপন দেখা বোধহয় উচিতই না। সেকথা তো সুখীকে বুঝিয়ে বললেই হয়। এত অবুঝ তো সুখী না। তাছাড়া মামিকে সে কত ভালোবাসে! মামিও তো খুব ভালোবাসে ওকে। বেশিদিন রাগ করে থাকতেই পারবে না। আবার আগের মতোই ভালোবাসবে, নিশ্চয়ই বাসবে।

বড়ো সুন্দর ঘরটা। ঝকঝকে পরিষ্কার সবকিছু। মোটা কাঁচ দেয়া টেবিলটাও ঝকঝক করছে আয়নার মতো। সে কাঁচটেবিলে নিজের চেহারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সুখী৷ টেবিলের একপ্রান্তে গদিআঁটা পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে সে আর মামি। অপর প্রান্তে খুব সুন্দরী কিন্তু গোমড়ামুখো এক মহিলা বসে। সে নাকি ডাক্তার। মামি বলেছে। ডাক্তার হোক আর যেই হোক, এতো সুন্দর এক মহিলার মুখ এমন গোমড়া থাকবে ক্যান? হাসি নাই মুখে একটুও। মামিও কঠিনমুখে কথা বলছে তার সাথে। ওদের কথা একবিন্দুও বুঝতে পারছে না সুখী। কী সব বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কথা। তাও আবার পেটে। কার পেটে বাচ্চা কে জানে! যার হয় হোক, সুখীর তাতে কী! তবে মামির পেটে যদি বাচ্চা থাকে, তাহলে সুখীর কিছু যায় আসে বটে। একটা বাচ্চা হয়নি দেখে মামির সে কী কষ্ট! এতদিন পরে যদি খোদাতায়ালা মুখ তুলে চায়, মামি তো মামি, সুখীরও কি কম আনন্দ হবে নাকি! ওকেই তো মানুষ করতে হবে সেই বাচ্চা! মনে মনে এমন প্রস্তুতি যখন নিচ্ছে সে, তখনই গোমড়ামুখো সুন্দরী ডাক্তারনি ডাকে ওকে।

 -আমার সাথে এদিকে একটু এসো তো!

 বলে তার চেয়ারের পেছনে যে পর্দা ঢাকা জায়গা আছে, সেদিকে দেখায়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সুখী। বুঝতে পেরে ডাক্তার সাহেবা আবার বলে,

-এসো, একটু দেখবো তোমাকে।

ভেবে পায় না সুখী, তাকে দেখবে কেন ডাক্তার! কী অসুখ তার? খেতে পারে না, কিন্তু এই না খেতে পারার জন্যেই কি মামি নিয়ে এসেছে ওকে ডাক্তারের কাছে? কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে ওঠে ওর। কতো ভালো তার মামি! নিশ্চয় চিন্তা হয়েছে তার, বেশিদিন খাওয়ায় অরুচি থাকলে বাঁচবে না সুখী। আর সুখীকে যে মামি ভালোবাসে খুব। মরতে দিতে পারে কি? পারে না… পারে না।

ডাক্তারের সাথে পর্দার আড়ালে চলে যায় সে। আড়াল থেকে ফিরে মামির সাথে নিচু গলায় ডাক্তারের কথাগুলো মন দিয়ে শোনে। শুনে যেটুকু বোঝে, তাতে ওর ভেতরের সব কথা চুপ মেরে যায় হঠাৎ করেই। চিন্তাগুলোও বোধহয়। শুধু কানে বাজে মামির একটা কথা,

 -যে ভাবেই হোক, নষ্ট করে দিতে হবে বাচ্চা।
ডাক্তার কঠিনমুখে মামিকে মেলা কথাই বলে। কিন্তু মামির ওই এক কথা, নষ্ট করে দিতে হবে।

ডাক্তার বলে,

-আজ বাড়ি যান, ভাবুন, সময় নিন। একটা প্রাণ, তাকে হত্যা করা ঠিক না ৷ মেয়েটারও প্রাণসংশয় হতে পারে। পরের মেয়ে, যদি মরে যায়, তখন কি করবেন?”

-কিন্তু এই বাচ্চা যে দুনিয়াতে আনা যায় না!
এমন হাহাকার করে সুখীকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে মামি। সুখীর পাগল মন তখন তোলপাড়৷ ঘিলুহীন মাথাটা ওলোটপালোট। এতক্ষণ থম মেরে থেকে যেটুকু বোঝার বুঝে গেছে সে। বাচ্চাটা তারই, তার পেটের ভেতরেই বেড়ে উঠতে শুরু করেছে একটি প্রাণ। কিন্তু কিভাবে? আর তাকে দুনিয়াতে আনা যাবে নাই বা কেন? সেই তখনকার থেমে যাওয়া চিন্তাগুলো আবার নতুন করে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে মাথার ভেতর। কোনো তল পায় না সেগুলো । তল না পেয়ে উড়ে বেড়ায় মাথার চারপাশ ঘিরে। উড়ে উড়ে চলে যায় বহুদূরে। তারপর আবার ফেরে। একে একে ভিড় করতে থাকে মাথার চারপাশে আবার। কিন্তু স্থির হয়ে বসে না এক জায়গায়। উড়তেই থাকে। একসময় রিক্সা থামে। বাড়ি পৌঁছয় ওরা। থম ধরা সুখীর চিন্তাগুলো তখনও ওড়ে। উড়তে উড়তে রাত নামে। পোঁ পোঁ আওয়াজে মশা ওড়ে চিন্তার সঙ্গী হয়ে। সিমেন্টের শক্ত মেঝেয় পাটি, পাটির ওপর কাঁথা, সিথানে বালিশ আরাম দেয় না সুখীকে। শরীরের খিলগুলো আলগা হতে চায় না। ঘুম আসে না ওর।

যে বাচ্চার জন্য কষ্টের সীমা নেই মামির, সেই বাচ্চা মামির পেটে না এসে ভুল করে তার পেটে আসতে গেল কেন? আল্লাহর ইচ্ছা? কিন্তু সুখী যে শুনেছে বিয়ে হলে তবেই বাচ্চা আসে পেটে! তাহলে? বাচ্চা না হওয়া কষ্টের, খুব কষ্টের। মামিকে দেখে জেনেছে সুখী। এও জেনেছে, বাচ্চা-কাচ্চা বড়ো মায়ার জিনিস। সেই মায়া এমনই, মা না হলে কারও সাধ্য নেই তা বোঝার। কতবার বলতে শুনেছে মামিকে,

 -খোদা, সন্তানের সুখ কি আমার কপালে লেখো নাই তুমি! শুনতে পাবো না কি কোনোদিন মা ডাক? কথাটার এমনই হাহাকার, যেন দুনিয়ার সব সুখ ওই সন্তানের মধ্যেই। সেই সুখ এখন সুখীর পেটে! তার মানে সুখীর চাইতে সুখী কেউ নেই দুনিয়ায়? ঘোর আঁধারে একটা হাত তার চলে যায় পেটের ওপর। ওখানে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সন্তানের অস্তিত্ব। কিছু যেন টের পায় সুখী। যেন স্পর্শ পায় একটা প্রাণের। সেই প্রাণ ডাকবে তাকে মা বলে।

 কিন্তু দুনিয়াতে আনা যায় না যে তাকে! আনা না গেলে কেমন করে শুনবে সুখী সেই ডাক? মাথাটা আবারও এলোমেলো হয়ে যায়। চিন্তাগুলো উড়ে বেড়াতে শুরু করে বিক্ষিপ্তভাবে। সেগুলোকে জড়ো করা দরকার। উড়ে বেড়ানো ভাবনাগুলোকে ধরে বসাতে হবে এক জায়গায়। সে জায়গাটা হলো সুখীর বাচ্চা… বাচ্চার মুখে মা ডাক… সুখীর সুখ। পারবে সুখী, পারতেই যে হবে! কিন্তু কেমন করে? উপায়ই বা কী? পালাবে কি সুখী এ বাড়ি থেকে? মনে মনে সিদ্ধান্ত পোক্ত করে সে । দরকার হলে পালাবে। চিনে চিনে ঠিক চলে যেতে পারবে গাঁয়ে।

এ বাড়ির পেছনে যে রেললাইন, সেটা ধরে এগিয়ে যাবে স্টেশনে। তারপর ট্রেনে চেপে চলে যাবে নিজের গায়ে। কচুরিপানা ভর্তি পুকুর, পুকুরের পাশ দিয়ে মেঠোপথ, বাবলা গাছে হলুদ ফুল আর স্বর্ণলতা, কলমিঝোপ, এসব তো সব মনে আছে সুখীর। মাটির দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে দাঁড়িয়ে আছে ওদের দুখানা ছনের ঘর। কতদিন দেখেনি সে! গিয়ে দেখবে প্রাণভরে। মা নিশ্চয় ওকে দেখে খুশিতে কেঁদেই ফেলবে হাউমাউ করে। বাপ আর ভাই-বোনগুলো ভিজে যাওয়া চোখ মুছতে মুছতে জড়িয়ে ধরবে ওকে। তারপর সবাই যখন জানতে পারবে ওর পেটে একটা বাচ্চা আছে , কী খুশিই না হবে সবাই! আসন্ন আনন্দের কথা চিন্তা করতে করতে একসময় হালকা তন্দ্রা আসে দুচোখে। সেই তন্দ্রায় ভেসে আসে কান্না। আকুলি বিকুলি কান্না, সাথে বিলাপ। কেঁদে কেঁদে বিলাপ করছে মা,

-আল্লাহ্ গো, এ কী সর্বনাশ হইলো আমার। এই পোড়ামুখী আবার প্যাটে বাচ্চা লইয়া বাড়ি ফিরছে! এখন আমি কই যাই, কী করি! বাড়ি না ফিইরা গলায় দড়ি দিয়া মরবার পারলি না তুই! মরণ হয় না ক্যান তোর? খোদা, তুইলা ন্যাও এই পোড়ামুখিরে! মর, তুই মর! আচমকা তন্দ্রা কেটে যায় সুখীর। এ সে কী দেখলো! মা তারে মরতে কয়? কিন্তু মরবো ক্যান সে? বাঁচবো সে, বাঁচবো তার সন্তানও । কেউ তাগোরে মারতে পারবো না।

ভোরের আলো ফোটার আগেই উঠে পড়েছে সুখী। রাতের বেলায় কখন হালকা বৃষ্টি হয়েছে বোঝা যায়নি। শহরে বোঝা যায় না। দরজা জানালা সব এঁটে বন্ধ থাকে যে। মুখ ধুয়ে বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা খুলতেই ভেজা অথচ মিষ্টি হাওয়ারা এসে ছুঁয়ে গেল চোখমুখ। বড়ো আরাম লাগলো সুখীর। নির্ঘুম রাতের ক্লান্তিরা সব উড়ে গেল কোথায়! নিজেকে যেন হালকা মনে হলো অনেক। রাতের আঁধারে ওর উড়ে বেড়ানো চিন্তাগুলোকে বসাতে পেরেছে এক নির্দিষ্ট জায়গায়। এখনও বসে আছে স্থির হয়ে। জানে ও, আর উড়বে না ওগুলো।

খুট শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে দেখলো, মামি দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে। তারও বোধহয় ঘুম হয়নি সারারাত। ভেতরে তার ওলোট পালোট হয়েছে কী কিছু? নাকি দ্বিধায় আছে ভীষণ? নাহ্, মনে তো হয় সেও স্থির। একটি ঝড়ের ঝাপটা সামলে নেয়ার জন্য প্রস্তুত সে-ও। নিঃসন্তান এই রমণী পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো…সুখী!

স্থির দৃষ্টিতে ঘুরে দাঁড়ালো সুখী। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো মামি কিছুক্ষণের জন্য। এই সুখীকে চেনে কি সে? এ যেন ভীষণ অচেনা কেউ!

+ posts

Read Previous

যে যার বৃত্তে

Read Next

হারকিউলিস মাদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *