অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাশ্বত স্বপন -
ঠিক ঠিক ঠিক

E:\Anupranan Antorjal 3nd Issue- To Shafik For editing- 3rd Oct 2022\Antorjal 3rd Issue_22.10.2022\12.Antorjal 3rd Issue- Anugolpo Bivag- 05\anu golpo shasoto.jpg

খুব ছোট বেলায়, যখন ডোবা-পুকুর-নদীতে গোসল করতে, কলাপাতায় ঘেরা বাঁশের তৈরি পায়খানায় যেতে প্যান্ট খুলতে হত, সেই বয়সে, আমাদের গ্রাম্য পাড়ায় কার্তিক মাসের কালীপূজার রাতের শেষে বিশাল দেহী স্বয়ং মা কালীর হাত-নাক-কান-গলা থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি হয়। চুরি হওয়ার চেয়ে বড় ঘটনা হল, মা কালী যে পা দিয়ে শিবের দেহ স্পর্শ করে নিজের জিহ্বা কামড়ে ধরে, সেই পায়ে ভর দিয়ে চোরে চুরি করেছে। ফলে পা-নাক-কান ভেঙ্গে গেছে। এই অবস্থায় পরদিন সকালে মা-বোন-বৌদিরা পুকুরে যাওয়া বন্ধ করে কলের জলে সব কাজ সারতে লাগল। দাদু-বাবা-কাকারা দোকানে যাওয়া বন্ধ করে ঘরে বসে দেশভাগ, দেশান্তর আর ধর্ম নিয়ে আবেগঘন পরিবেশে আলোচনা করতে লাগল। যাদের এক পা কোলকাতায়, আরেক পা এই গ্রামে তারা দেশান্তর হওয়ার জন্য মোক্ষম একটা ছুঁতা খুঁজে পেল।

বিকালে যারা মাঠে খেলতে যাবে, তারাও উঠোনে, ঘরের কোণে বসে ভাবতে লাগল, মাঠে-ঘাটে-বাজারে সবাই মুখ দেখাবে কেমনে! আমার মাকে জিজ্ঞাসা করলে, মা বলে, ‘হুন বাবা, এইসব গয়নাঘাটি পাপী বেটারা দিছে। মা কালী তাই চোরকে ডাইকা আইননা কয়, পাপের জিনিস নিয়া যা, নিয়া যা…।’ মা কালীর প্রতি মায়ের সাথে আমাদের ছোটদেরও বিশ্বাস অক্ষুণ্ন রইল। এই ঘটনার পর পাড়ার অতি প্রয়োজনীয় ছোট ছোট কাজগুলো করতে গিয়ে আমরা ছোটরা হাঁপিয়ে উঠেছি। দিনে বিশ-পঁচিশ বার পুকুর ঘাটে, বাজারে যাওয়া লাগে।

এদিকে মুসলমান পাড়ার মা-ঝিয়েরা পুকুর ঘাটে কোন কোন হিন্দু নববধূকে পেয়ে হেসে হেসে বলতে লাগল, ওগো বৌদি, মা কালীর নাকি ঠ্যাং নাই, নাকও নাকি চোরে নিয়ে গেছে, কথা সত্য? এদিকে খেলার মাঠে আমাদের মতো আধা নেংটোদের পেয়ে, পুরো নেংটো করে, মুসলমান ছেলেগুলো বলতে লাগল, কী রে হরি, তোদের মা কালীর ঠ্যাং-নাক-কান নাকি চোরে চুরি করেছে? হায় রে কালী, নিজের মানই রক্ষা করতে পারে না, তোদের কী উপকার করবে?

দু’একদিন এভাবেই চলল। খুব ঠেকায় না পড়লে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। দু’একদিন পর বাজারে দোকান খুললেও হিন্দুরা মুসলমানদের চোখের দিকে তাকায় না। প্রতিদিন রাতে চেয়ারম্যানের লালঘরে মিটিং বসে, আলোচনা হয়, কিন্তু চোরের কোনো কূল-কিনারা কেউ করতে পারে না। তবে সবাই নিশ্চিত, চোর এই গাঁয়ের নয়, অন্য গাঁয়ের বা চর এলাকার।

আবার তিনদিন পর কোনো এক মধ্যরাতে মসজিদের জায়নামাজ-বই-মাইক-স্পিকার সব চুরি হয়ে যায়। হিন্দুরা শুনে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদের কাছে যায়, পুকুর ঘাটে যায়, খেলার মাঠে যায়, মুসলমানপাড়ায় যায়, সবাইকে সান্ত্বনা দেয়, আর চোরের চৌদ্দ গোষ্ঠীরে উদ্ধার করে। এ রকম অস্বস্তিকর অবস্থায় কয়েকদিন মুসলমানরা ঘাটে, বাজারে, খেলার মাঠে যায় না। এদিকে আমাদের ছোটদের কাজ আবার বেড়ে যায়।

কাজ শেষে বিকালে খড়ের গাঁদায় বসে ছোটরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে, মা কালী বা খোদা, চুরকে কিছু কইল না কেন? আমি আমার মায়ের কথা বললাম, মা কালী নাকি নিজেই চুররে ডাইকা আইননা পাপীগো দেওয়া গয়না জিনিস-পত্র নিয়া যাইতে কইছে। সাথে সাথে নেংটো বন্ধু পটল বলল, মসজিদের চুরি যাওয়া জিনিসগুলান তো পাপী হালারা দিছে, আব্বা কইছিল, টিন চুর মেম্বর দিছিল ফ্যান, আর গম চুর চেরম্যান দিছিল অনেকগুলান কুরান শরীফ, হাফেজী বই। এই জন্য খোদা চুরকে দিয়ে সব সরাইয়া মসজিদ ফকফকা করছে।

স্বল্প মগজের চিন্তা করার শক্তিহীন মাথাগুলো এসব কথার সাথে একমত পোষণ করে বলতে লাগল, ঠিক ঠিক ঠিক।

 

Read Previous

অগ্নিবাসর

Read Next

নুশান : দ্য স্পেশাল চাইল্ড – প্রথম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *