অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাতুনে জান্নাত -
নুশান : দ্যা স্পেশাল চাইল্ড— তৃতীয় পর্ব

৭.

অঘটন মানুষের জীবনকে ওলটপালট করে দেয়, মায়ের বিলেতে চলে আসা অঘটন ছাড়া কিছু নয়। তার মামাতো ভাই ফুয়াদ লন্ডনে যেতে চেয়েছিল। তাকে নেওয়ার জন্য বিয়ানীবাজারের একজনের সাথে আলাপে সে একটি নম্বর দিল দালালের। বিয়ানিবাজার নয়নার শ্বশুরবাড়ির এলাকার। সেখানেই থাকত নয়না। এনজিওতে প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরিরত ছিল ঢাকায়। সে চাকরি ছেড়ে নিজে সমাজকল্যাণ সমিতি রেজিস্টার্ড করে। ঢাকার রামপুরা ও মিরপুরে দু’দুটো প্রজেক্ট, ও বিয়ানীবাজার ও লক্ষ্মীপুরে একটি করে প্রজেক্ট করে। পিতার জমি বেচে মাইক্রো ক্রেডিট, নিজের শ্রম বেচে দক্ষতা প্রশিক্ষণ। এনজিও ফোরামের ‘পানি ও সেনিটেশন প্রকল্প’ থেকে ফান্ডের আশ্বাস পেয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে বিয়ানীবাজার চলে যায়। তাড়াহুড়ো করে অফিস নেয়। দুবাগ এলাকায় সমিতিও গঠন করে। কিন্তু অফিসে কাজের ফাঁক ধরা পড়ে। নতুন অফিস ঠিকমতো কিছু নাই। সিলেট আঞ্চলিক অফিসের এনজিও ফোরামের ভিজিটরস আগামী বছরের কথা বলে। জীবন নির্বাহের জন্য প্রথমে কিন্ডারগার্টেন তারপর হাইস্কুলে এমপিওভুক্তি হয়েও ছেড়ে দেয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি নেয় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে। বিকেলে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ। সেসবকিছুর পরও তাকে ছাড়তে হয় বেকার ও অনভিজ্ঞ স্বামীর অর্বাচীনতার শিকার হয়ে। জীবন ঝুরঝুরে। এখন মায়ের বাড়ি, ভাই ও ভাবির উন্নাসিকতা সইছে তিলে তিলে, পলে পলে।

দালাল আখলাক ঢাকার ফকিরাপুলের একটি হোটেলে সিটিংয়ের আয়োজন করে। সিটিংয়ে দশ লাখ টাকা ধরা হয় স্টুডেন্ট ভিসার জন্য। ফুয়াদ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব। প্রথম বউ অতি সুন্দর, সাবলীল, গুণী হওয়া সত্ত্বেও সে প্রেমে পড়ে যায় বিধবা জয়নব আরার। জয়নবের ভালোবাসায় টালমাটাল হয়ে বিয়ে করে ফেলে। এবার যায় কোথায়? সংসারে আগুন। প্রথম বউয়ের কান্না আকাশ বাতাস ছোঁয়। বকে না, চিৎকার চেঁচামেচি না শুধু কান্না। বাড়ির লোকের সমীরণ মেয়েটির জন্য দরদে ভরা। সবাই সবসময় প্রথম বউটিকে ভালো চোখে দেখে। তবুও পুরুষ বিয়ে করে বারবার। দ্বিতীয় বউটি সমাজের নাক সিঁটকানোর উপর চলে। সবার ভয়ে নতুন বউকে এ বাড়িতে তোলে না ফুয়াদ। তার উপর সে এ বাড়ির পালকপুত্র। দুই বছর বয়সে নিঃসন্তান জহুরা নিয়ে এসেছিল এক দরিদ্র পরিবার থেকে। বেতের আঁকশিতে নয়— অতি মায়ার বেষ্টনীতে সে আবদ্ধ। কিছু জমি তার নামে রেজিস্ট্রিও করে দিয়েছে রহমত মিয়া। কিন্তু পালকপুত্রের ঘা তার মন থেকে সরানো যায় না। নিজের মা-বাবাকে চেনে। এক হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে তাকে। তাদের বাড়ি গিয়েও মনে বিবমিষা নিয়ে আসে। এক হাজার টাকার সন্তান। তার পরিচয় পালক সন্তান। না সে কারও নয়! পারস্পরিক স্বার্থ বিজড়িত তার জীবন। কারও পুত্র চাই; কারও চাই টাকা। তার কী চাই? পরিচয় চাই। সে কারও পুত্র নয়। কারও করুণার পাত্র নয়। বিয়ের আগে এক ফুপাতো বোনকে ভালোবাসে। না, তার মতো পালক্কার কাছে অভিজাত ফুপু মেয়ে বিয়ে দেয়নি। অথচ একমাত্র সে ফুপুই তাকে আপন করে নিয়েছিল। বিয়ের সাথে জড়িয়ে থাকে অন্য হিসাব।

সে ফুয়াদ শুধুই ফুয়াদ। সব ডিঙিয়ে সে চলে যেতে চাচ্ছে। এ সমাজের ভ্রূকুটি থেকে। বাল্যকালের খেলার সাথীদের পালক্কা ছেলের খোঁচা থেকে। বেড়াতে আসা আত্মীয়দের উপেক্ষার চোখ থেকে। কিন্তু না, এত টাকা সে কোথায় পাবে? তার ব্যাংকে এত টাকা নাই। তাকে থাকতে হবে সমাজের চোখে উল্লামুড়া। মানে শেকড়হীন। কেন এমন? জন্মের সাথে কেন পরিচয় মানুষের? অথচ বইয়ে শেখায় জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো। ভুল শিক্ষা আর ভুল সমাজের ভুল প্রজনন!

ফুয়াদকে ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখে ফাঁকে নয়না বলেছিল, আমি কি যেতে পারব?

নয়নার শ্বশুরপক্ষের এলাকার লোক আখলাক। হেসে বলল— ভাবি, আফনি যাইবার চান? আফনের ভিসা অইব? লেখিয়া দিতাম ফারমু।

—লন্ডন যেতে কে না চায়! তবে আমার হাতে টাকা নাই। হাসতে হাসতে বলে নয়না।

—ভিসা অইলে দিয়েন নয়! আপনার আত্মীয়স্বজন সব তো মাশাল্লাহ টাকাপয়সার আড়ৎ। আপনার ভিজিটিং ভিসায় টাকা অর্ধেক।

—ভিসা হলে কীভাবে দেব? বিদেশে গিয়ে দেব। যদি পারেন নেন। আখলাকের কথার পিঠে নয়না বলে।

—খতা কইয়া জানাইমু নায়।

আখলাকের সাথে কথার পরদিন তাকে নিয়ে একটা স্টুডিওতে পাসপোর্ট ছবি তোলে। শাড়ি পরিয়ে মেকাপের মাধ্যমে একটু বয়সী বানায়। তারপর আর কোনো কথা হয় না। নয়নার চাকরি হয়ে যায় সেই আগের এনজিওর জামালপুর এসডিএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পাইলট প্রজেক্টে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিন এক বছরের প্রজেক্ট। বেতন পঁচিশ হাজার টাকা। ফিল্ড ভিজিটে তিন হাজার (টিএ)। একজনকে লক্ষ্মীপুরে কাজ দেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিল। অফিস প্রধান নরমেন সাহেব কিছুক্ষণ পর ফোন ঘুরিয়ে বললেন, তুমি এখানে কেন? তোমার তো সিলেটে থাকার কথা?

—আমি অসুস্থ। ছোট বাচ্চা আছে। কাজ করতে পারি না।

—লুকোচুরির দরকার নেই; একটা সুবিধাজনক প্রজেক্ট আছে। গ্রাম সমিতি গঠনবিষয়ক পাইলট প্রজেক্ট। তুমি তো এমন কাজই পছন্দ কর? নাকি বলো! তোমরা আমাদের মূল পর্বের মানুষ। এ অফিসকে তোমরাই গঠন করেছ। আর এসব কাজে তুমি যে দক্ষ তা আমরা জানি। ঢাকায় এসে ইন্টারভিউ দাও। অফিস কিন্তু আগের মতো নাই। আমি চাইলেই নিতে পারব না! তবে চেষ্টা করবো কমিটি যেন নেয়।

নয়নার চোখে জল ভরে আসে। ফিল্ড, প্রশিক্ষণ ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ির ব্যস্ততম সময় পার হত। বিদেশি ডোনারদের সাথে প্রকল্প অফিস ভ্রমণ। গল্প, হাসি, আড্ডা, সারসের ডানায় উড়া প্রশিক্ষণের চতুরঙ্গ সময়। তারপর প্রশিক্ষণার্থীদের চিঠির স্তূপ। ‘স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সটিতে পড়েছি কিন্তু দশদিনের এমন উপভোগ্য সময়… মায়াময় ছায়াময় দিনগুলোর হারিয়ে যাবার বেদনা করারও সময় হয়নি। মানব উন্নয়নের কর্মকাণ্ড শেখাতে শেখাতে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ থমকে যায় বুঝি। কত মুখ, কত সুখের সঞ্চয়! লঞ্চ, ট্রেন, বাস ছোটাছুটি। প্রজেক্ট সেটিং, ইমপ্লিমেন্টেশন, মনিটরিং। কাজ যেন প্রার্থনা, কাজ যেন নিরবধি জীবন সংগ্রাম। তারপর সংসার সন্তানের ভারবাহী জীবন তার উপরই পড়েছে। সন্তানের জন্য চাকরি ছেড়েছে অথবা উচ্চাশার পথে পিছলে পড়েছে আশার চাকা। নিজে সংগঠন করেছিল— হয়নি। সংগঠন করতে টাকা লাগে। পরিবার থেকে পাওয়া বাবার জমির মালিক হয়ে বিক্রি করেছিল। সমিতি গঠন করেছিল। সঞ্চয় ও মাইক্রো ক্রেডিটের কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কর্মী নিয়োগও করেছিল। কিন্তু টাকা তোলা যায়নি। সমিতি সদস্যদের পাকা চোখ বুঝেছিল এ সংগঠনের ভিত্তি তত মজবুত নয়। ঋণের টাকা তোলা যায়নি ছয় মাসের পর। যেটুকু তুলেছিল তা সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিয়ে গুটিয়ে নিতে হলো তাড়াতাড়ি, আরও ঋণী হয়ে থাকলো কতজনের কাছে। স্কুলের চাকরি ছাড়তে হলো। স্বামী আয় করতে পারে না তাই যেন থেকেও নেই। তবে আদর ছিল, মান-অভিমানের এক ঋদ্ধ সমুন্নত জীবন বয়ে চলেছিল। সবকিছু ভেঙে গেল ভুল পরিকল্পনা ও চাপে। ভাইদের সাথে লাগালাগি করতে গিয়ে নিজেই ধরা খেল বেকার প্রেমিক স্বামী লুতফ নাহিয়ান। এক প্রেমময় সংসার জীবনের ছায়া ছিল নয়না আর লুতফ আখ্যান। কতদিন রাত্রি তারা বাইরে আসেনি। কতদিন আকাশ দেখেনি, দেখেনি মানুষের কোলাহল। আয়না হয়ে থেকেছে একজন আরেক জনের। স্বামী ‘এখন কোথাও নেই’-এর মতো! তার ফোন কখনো বাজে কখনো বাজে না। তারা পড়ে আছে মায়ের বাড়ি। যার দখল বড় ভাই আর বৌয়ের হাতে। মায়ের হাতে নিজের বিষয় সম্পত্তি কয়েক বিঘে জমি আর বাগান বাড়ি। যা একসময় নয়না এনে দিয়েছিল। বর্গাদারের সাথে মিটিং করে। নয়নার সেসব কর্মকাণ্ডের জন্যই মায়ের মমতা ও আশকারা তার দিকে। মা মেয়ের জীবনের কষ্টে গোপনে কাঁদে। তবুও মেয়ে ও নাতি নাতনির জন্য রাঁধতে বসে।

—কী খাবে গো নানা ভাই, নানু বইন?

—চিকেন। চিকেন।

—কই পামু?

—বাজারে।

—ওরে বুদ্ধিমান নানাভাই আমার।

নানু হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়। নানুর পছন্দের কাজ করে চমকে দেয় সাত বছরের পাপ্পু। বন থেকে কুড়িয়ে আনে শুকনো ডাল,পাতা। পুকুর, গড়, নিচু খেত থেকে মাছ।

ভাবির চোখ টাটানো গল্প শুনেও জবাব দেয় প্রশান্ত মাথায়। পাগল হয়েও প্রশ্ন করে বুদ্ধিমানের মতো!

—জামাই কইরে তোর?

—কেমনে কমু? আছে কোথাও… নদীর ধারে, বনের কুঞ্জে নয় শহরের রঙমহলে!

—তো তুই এমনিই থাকবি? কি লাভ হইলো এত কিসসা করি।

এসব প্র্রশ্নের জবাব থেকে বাঁচা আপাতত জামালপুরের চাকরি। একদিন ভোরে ছোট আপার ঘরে পাপ্পু পরীকে রেখে চলে যায় জামালপুরের ইসলামপুরে। যমুনা ব্রহ্মপুত্রের কোলের ভেতর চুপ করে থাকা প্রকৃতি আবাহন। শীতকাল কোনোমতে কাটলেও বর্ষা সেখানে বাঁধনহারা, দুই কূল ছাপানো জলরাশি, উত্তাল, উন্মাতাল। কমোট ট্রেনে যেতে যেতে হাসলো নয়না, অফিসের বানানো বায়োডাটা নিয়ে ইন্টারভিউতে কেমন কৌশলে জনাব নরম্যান চাকরিটা পাইয়ে দিলেন।

ইন্টারভিউর মাঝখানে এসে বললেন, ‘জানেন এ অফিসকে আজকের এ জায়গায় আনার অবদান ওদের। একজন কতগুলো প্রজেক্টে যে ওরা কাজ করত। টেলেন্ট ও আন্তরিকতা। আহা, বেতন দিতে পারত না অফিস! কত জানি বেতন পেতে, নয়না?

—তেরশ’ টাকা।

—দেখছেন? ওরা হলো আসল সমাজকর্মী! নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আরকি!

অফিসপ্রধানের এমন কথার পর চাকরি কনফার্ম করতে দেরি হয় না সাবেক সচিব শফিকুল ভূঁইয়ার। এ অফিসে যিনি কো-অর্ডিনেটরের কাজ করছেন। তার ঠোঁটে লেগে থাকে পার্থিব হাসি।

চাকরির নিয়োগপত্র সাথে নিয়ে নয়না জামালপুরের কমোট ট্রেনে ইসলামপুর পৌঁছায়। সাধারণ এনজিওদের সমিতি সমিতি খেলা এ নয়। সঞ্চয় তোলো তিন হাজার টাকা, গ্রুপ সঞ্চয় হলো তো এক লাখ মাইক্রো ক্রেডিট দিয়ে দাও। তারপর টাকা তোলার জন্য সপ্তাহে সপ্তাহে ধর্ণা দাও সমিতি পাড়ায় পাড়ায়। এখানে গ্রামের লোকজনই প্রথমে পাড়ায় পাড়ায় গ্রুপ করবে তারপর পাড়ার গ্রুপ একত্রিত হয়ে গ্রাম সমিতি। অফিসের লোক শুধু সহায়তা করবে। খাতাপত্র পরিচালনা, তারপর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা। নতুন এ প্রোগ্রাম গ্রামের মানুষের মধ্যে অফুরান উৎসাহ এনে দেয়। নিজেদের ভেতর থেকে লেখাপড়া জানা মেয়েদের জোগাড় করে সমিতিভুক্ত করে। প্রজেক্ট এক্সটেনশন হয়েছে। সবার মনে আনন্দ উপচে পড়ছে যমুনার স্রোতের মতো। বিকেলের অবসরে গান ধরছে আড্ডায়। পরদিন নদী দেখতে বেরিয়ে পড়ে তারা। অফিস সুপারভাইজার মনোয়ার আপা আপা করে আগে-পিছে ঘোরে। এই যে নদী বইছে দূরে। উথালপাথাল ঢেউ পাড় পেরিয়ে কোনো বৃষ্টি ছাড়াই জোয়ারের সময় ডুবিয়ে দেবে সব বাড়িঘর।

পুরোনো স্কুলটা ভাঁজকরা বইয়ের পৃষ্ঠার মতো চেপে থাকে। নুশান ‘কে রো’ স্কুলটাকে আপন করে নিতেই পারে না। তার পা আটকে আসে, মন অন্যমুখী। একহাতে ব্যাগ ও আরেক হাতে তাকে টেনে টেনে আনে। আগের স্কুলে ঢুকেই উজ্জ্বল খলবল হাসিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত শিক্ষকদের কোলে কোলে। এখানে সে কুঁচকে থাকে গুটানো কাঁকড়ার খোলসে। জ্যাকেট খুলে দেয়ালের রিঙয়ে আটকে রাখেন মা। নুশান মায়ের হাতে সেলাই করা কমলা ফতুয়ার ফটোর কার্ডটি ক্লাস টিচারের হাতে দিলে তিনি সবুজ মার্কার কলমে একটি টিক চিহ্ন আঁকেন খাতার নামের পাশে। নুশানের সাথে হেসে হেসে কথা বলেন। হাসিকে উপেক্ষা করে নুশান তার চোখের নীচে একটি চিমটি কেটে বিশাল গার্ডেনে ঢুকে পড়ে। এ টিচার জানবেই না আগের স্কুলের মায়া, কলতান। কখনো বালি, কখনো পানি, কখনো বাগি, কখনো বনের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি। প্রথম দুদিনের পর মাকে গার্ডিয়ানরুমে বসতে হয়। কিন্ত যে টিচারকে ওর জন্য ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতিতে দিয়েছে তিনি ব্রিটিশ বাঙালি গৃহিণী। তাঁর শরীরে বিস্তর আলসেমি, চোখে উদাসীনতা। ইংরেজির চেয়ে সিলেটি বাংলায় কথা বলেন বেশি। মাকে পেলেই গল্প করতে বসে যান। কথায় কথায় ‘এ ধরনের বাচ্চা’ বলে নানা অভিজ্ঞতা ফলান। এ ধরনের বাচ্চা মানে অসুস্থতা, এ ধরনের বাচ্চা মানে সুরের ঘরে অসুরের বন্ধন। কথায় কথায় ধর্মের কী কীও বলতে চান। যা একেবারে নিষিদ্ধ ছিল আগের স্কুলে। কোনো গার্ডিয়ানকেও বলতে দেওয়া হতো না। আগের স্কুলে শুধু নয় এগুলো কর্তমান সভ্যতায় পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ব্রিটেনে তো অবশ্যই। লাইফ ইন দ্য ইউকে কোর্স করতে গিয়ে মা শিখেছে অনেককিছু। মানুষকে ছোট করা যাবে না। ধর্মের কারণে, রঙের কারণে, দেশের কারণে। প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে সম্মানিতজন। মায়ের চোখে তুষ পড়ার মতো খচখচানি। মনে পালিয়ে যাওয়া কাঠবিড়ালি। গার্ডিয়ান রুমে ছটফট করেন। একটা কমপ্লেইন বক্স রাখা আছে মূল গেট পেরিয়ে এলেই। শিক্ষকগণ বারবার বলেছেন কোনো অসুবিধা বা ইচ্ছে যেন জানান। লাগো এবার নিজের বিরুদ্ধে নিজে— নয়তো মরমে মরতে থাকো কুঞ্জি হারিয়ে।

একসময় নুশানকে শান্ত করে নিয়ে আসা হয় সেন্সরি রুমে। সে ‘আন্টি আন্টি’ করে, ‘মা মা’ করে। মাকে নিয়ে যায় সেন্সরি রুমে। লাল, নীল, বেগুনি হরেক রঙের মেলা। একটা দেয়াল সমান উঁচু কাচের বক্স। বড় বড় বাবল উপরে উঠছে নীচে নামছে। সাথে পাখি, মাছ, সাগরের প্রাণী। ওগুলোর সাথে লাফাচ্ছে সে। মাকে দেখেই বলল, ‘আন্টি আন্টি’। অর্থাৎ আগের মেডামকে। চোখ ছলছল মা চোখ মুছে দেয়। সেন্সরি রুমেই গানের ক্লাস চলছে। ইংরেজি রাইম সুর করে করে গায়। গোল হয়ে বসে সবাই গান করছে। গানে আনন্দে সবাই মাতোয়ারা হয়ে একসময় বাসায় ফিরে আসে। দুটো স্কুল দেখছে মা কোথাও ওর মতো বাচ্চা নেই। অর্থাৎ এ এলাকায় সে একা। বিভিন্ন ট্রেইনিংয়ে দেখা যায় ওর থেকেও বেশি সমস্যা আক্রান্ত বাচ্চা। একটা বাচ্চা বল ছুড়ে ট্রেইনারের জলের গ্লাস ভেঙে ফেলেছিল। একটুকরো কাচ কেটে দিয়েছিল হাতের পিঠ। কখনো কামড়ে, খামচে দেয়।

নুশানদের বাসাটা স্কুলের উল্টা দিকে। প্রায় মুখোমুখি বাড়ি। ঘনঝোপ লতা কেটে চতুর্ভুজ করা। একপাশে গন্ধরাজ ও গোলাপ গাছ। বর্ষা মৌসুমে বেশ রাজকীয় ফুল ফোটায়। ঝোপের গাছেও ছোট নাকফুলের মতো সাদা ফুল উঁকি মারে। ছোট ছোট পাখি বাসা বেঁধেছে। তাদের কিচিরমিচির দোতলার বারান্দা থেকে মা ছেলে মজা করে দেখত। রাস্তা পার হয়ে বাসায় পৌঁছে বাগির বেল্ট আলগা করতেই নুশান বের হয়ে ফুটপাত ধরে দৌড়। তার পেছনে দৌড়ে যাওয়ার মতো মায়ের শক্তি থাকে না। বাগি নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সে পৌঁছে যায় ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার’ স্কুলের গেইটে। দুটো রাস্তা সাঁই সাঁই গাড়ি, মানুষের ‘স্টপ স্টপ’ চিৎকার কোনো কিছুই থামাতে পারেনি তাকে। বন্ধ দরোজায় ধাম ধাম করে দুই হাতে মারে। নিজেকে উজাড় করে ল্যাপ্টে থাকে প্রিয় পরিচিত কাচের দরোজার সাথে। ইন্ডিয়ান টিচার ফ্লোরা এসে দরোজা খুললে দৌড়ে স্কুল প্রধান তুশারির কোলে ঢুকে পড়ে। গালে আদর নেওয়ার জন্য গাল পেতে দেয়। নিজেও ‘ওন্ওন্ শব্দ করে দুটো চুমু দেয়। মা পেছনে এসে তাকিয়ে থাকে ভাষাহীন। নতুন স্কুলের এত জাঁকজমক, ঠমক। এত শিক্ষণ ম্যাটেরিয়ালস। এত আয়োজন। শিক্ষকদের বিলেতি স্টাইলে হাসি, কথা, নাম ধরে ডাকা। তার তুলনায় এটি হতদরিদ্র। একটাই ঘর, একটু বড় ধরনের। দরিদ্র বলেই কি এদের প্রাণে এত মায়া! এমন তো সবার হওয়ার কথা ছিল! তাদের প্রশিক্ষণ প্রতিমাসে চার পাঁচ দিন। প্রতিদিনও ননফর্মাল প্রশিক্ষণ! অথবা প্রাইভেট বলে। চ্যারিটির প্রতিষ্ঠান। সবসময়ই প্রাইভেট আর পাবলিকের ব্যবধান প্রকট হতে হয় বুঝি!

ঘরে ফিরতে অনেক কসরত করতে হয় মাকে। আগের মতো ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি অফিসে অফিসে, টেবিলে টেবিলে। ঘরে এসে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। ইচ্ছে করে চিৎকার দিয়ে কাঁদে। কারও গলায় জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কার গলায় জানে না মা। ‘মা মাগো’। মাকে তো বলাই হয়নি নুশানের অসুস্থতার কথা! বিশাল মহাসাগরের ঐ পাড়ে টুনটুনি আর হরিয়ালের দেশে, সবুজ লতাগুল্মের আবেশে পুকুরপাড়ে বড়শিতে মাছ ধরতে ধরতে ফাৎনার কাঁপুনি ছাড়া মা কি কেঁপে উঠে সন্তানের প্রগাঢ় বেদনা টের পেয়ে! অথবা ভাতিজা বউ, জা’দের সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ আনমনা হয়ে যায় কিনা বাম চোখের পাতা কাঁপছে বলে। এসব বাচ্চার প্রতি সদয় নয় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, তাদের খেলার সাথী। ভয়াবহ অপরাধী জ্ঞান করে। নুশান নিজেও এদের পছন্দ করে না। সেই যে স্পেশাল স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। পঙ্গু, অসুস্থ বাচ্চাদের দেখে কী ভয়ই না পেয়েছিল সে। সেন্সরি রুমেও অসুস্থ একটি মেয়ে শুয়েছিল তা দেখে সে এ রুমেও থাকতে চায়নি। পঙ্গুদের দেখে কেঁপে কেঁদে উঠেছে। যেন ঝড়ে পড়ে যাওয়া পাখি এমনই ভয়ার্ত ছিল চোখ মুখ। মা শুধু মনে মনে কেঁদেছে। এত অসুস্থ সন্তান! তবু তাদের প্যারেন্টসদের স্বস্তি বাচ্চাগুলো প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বেঁচে থাকছে। তুশারি খুব মন খারাপ করেছিল। ‘হোয়াই স্পেশাল স্কুল?’ মনে ঘুরছে তুশারি শিক্ষকের কথা, ‘হি ইজ নট সিক। হি নিডস হেল্প।’

মাকে উঠতে হলো। নুশানের খাবার দিতে হবে। এদিকে বাবার ফোন। ফোন কানে নিয়েই রান্নাঘরে ঢোকে। বাবা দায়িত্ববান। খোঁজ নিচ্ছেন— ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে কিনা! ঘটনাটুকু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় মা। দোষটা তার ঘাড়েই আসবে। মনের পাড় ঢেউয়ের ধাক্কা খেতে খেতে অসাড় হয়ে পড়ছে। কোথাও ঠাঁই নেই গোছের নিঃশ্বাস আলগা করে বুকের বাঁধন। একটি শিশু মাকেও প্রশিক্ষণে যেতে হবে সামনের সপ্তাহে। সিডিউল, মডিউলসহ চিঠি এসেছে কাউন্সিল থেকে অটিজম মায়েদের সাথে।’কিন্ত বাচ্চাও সাথে রাখতে হবে। কী প্রশিক্ষণ রে বাবা! দুটো দিন অন্তত বাচ্চা আর উৎপাত থেকে মুক্তি মিলত। তারাও জানে মাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। সে যে অপরাধী! অসুস্থ শিশু জন্ম দিয়ে পৃথিবীকে হেলে রেখেছে। ফাইলের চিঠি নাড়াচাড়া করছে। নাড়াচাড়া করছে চাইল্ড হেল্প সেন্টার থেকে পাওয়া নুশানের রিপোর্ট।

বিশেষায়িত শিশুদের নিয়ে আর কত দৌড়তে হবে? জলে ডুবে যাওয়া স্থল ভাগের মধ্যে ডোবাডুবি মুখে শিশু নিয়ে ভাসতে থাকা ও বুকে হামাগুড়ি দিয়ে কারও বাড়ির পৈঠায় আশ্রয়ের আশা নেয়া সরিসৃপ মনে হয় নিজেকে। ভাবনার মাঝে উঠে চার বার্নারের চুলায় ভাত চড়িয়ে দিয়ে আসে। আজ তরকারি লাগবে না। যদি নুশানের বাবা এসে তার প্রিয় আলু-মার্জারিন, ডাল-মাস্টার্ড কিংবা বেগুন ভাজি করে সেই অনেক। কাচের বন্ধ জানালা দিয়ে তাকিয়ে নুশান দেখছে গাড়ির আসা যাওয়া। এটা তার খুব প্রিয় একটা কাজ। আরও প্রিয় ওয়াশিং মেশিন চালু হলে তার সামনে বসে মাথা দোলানো বা মাইক্রোওভেনের লাইট অফ হওয়া পর্যন্ত। তারপর নিজে অফ করবে হাসিখুশির ঝর্ণা ছড়িয়ে কেনো প্রিয় গান গাইতে গাইতে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় বাবার আগমন। হাতে বাজারের ব্যাগ। নুশানের সাথে মা-ও দৌড়ে যায় নিচে। ব্যাগ ধরতে হবে। নয়তো চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হবে। বাইরে ছড়িয়ে পড়বে না ভেতরে ধরিয়ে দেবে আগুন। সংসার এক আগুন আগুন খেলা। কাজহীন অকর্মা, আলসে আরও কত বাক্যবান! পুরো কাপ গরুর দুধে চায়ের প্যাক নিয়ে চা ও কৃষ্ণ চানাচুরের স্বাদ শেষ করে তারপর হাসিখুশি, গল্প আসর। সারাদিনের অভিজ্ঞতা ও ঘটনার হৃদ্য বিন্যাস। সিংকের হাড়িপাতিল ধুতেও লেগে যাবে কখনো কখনো। জোয়ারভাটা মনের মতো জোয়ারভাটা সংসার।

 

+ posts
কবি ও সাহিত্যিক খাতুনে জান্নাত ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতি; দুর্বলের প্রতি সহিংসতা ও অভিন্নতার মুক্তি চান তিনি। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদমুক্তির ও উজ্জীবন মূলক। কবির জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার, ঘিলাছড়া ইউনিয়নে। তবে তাঁর পৈতৃক ও মাতৃক ঠিকানা: লক্ষ্মীপুর জেলাধীন লক্ষ্মীপুর থানার গোপীনাথপুর গ্রামে।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬), নিসর্গে নিমগ্ন নামতা(২০২২),
উপন্যাস গ্রন্থ:শিউলির কথা (২০১৯), বিলেতের বাউরি বাতাস(২০২২)।
নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩, অনুবাদ ব্রজেন চৌধুরী।
লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাদেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ,যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জাতীয় দৈনিক, ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায় বাংলা ও ইংরেজি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।তিনি গান, শিশুতোষ ছড়া, সাহিত্য ও নারী বিষয়ক প্রবন্ধ , নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করছেন।

Read Previous

কলঙ্কিনী রাধা – চতুর্থ পর্ব

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৫ম সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *