অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রণিত ভৌমিক -
সমুদার অভিযান

প্রথম পর্ব

গোয়েন্দার হাতেখড়ি

জীবন সত্যি রোমাঞ্চকর! আমি ভাগ্যবান, জীবনে এরকম অনেক অনুভূতির সাক্ষি হতে পেরে। কারণ, আমি পাশে পেয়েছি সমুদাকে। হ্যাঁ, সমুদা আমার কাকা হলেও, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দাদার মতো। ছোটোবেলা থেকেই সে আমার সঙ্গে একজন বড়ো দাদার মতো মিশেছে। আমাকে একবারও বুঝতে দেয়নি যে সে আমার দাদা নয়, আমার কাকা। তাই আমার নিজের দাদা না থাকার আক্ষেপটা সমুদা একশো ভাগই মিটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। সমুদার পরিচয়, সে হলো গোয়েন্দা সমরেশ দত্ত। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, তার উচ্চতা ছয় ফুট হলেও সমুদা কিন্তু আমাদের বইয়ে পড়া আর পাঁচটা গোয়েন্দা চরিত্রর মতো একেবারেই নয়। তার ছোটোবেলা থেকেই খেলাধুলার উপর একটা ঝোঁক রয়েছে। ফলে, বলতে দ্বিধা নেই যে, তার শরীরের গঠন অনেকটাই ক্রীড়াবিদের মতো। প্রথমদিকে সমুদার এই গোয়েন্দাগিরি ছিল নিছকই শখের, কিন্তু পরবর্তী সময় সেই গোয়েন্দাগিরিই হয়ে উঠলো তার পেশা।

সমুদা সম্বন্ধে আরও বলতে গেলে, বলতেই হবে তার রয়েছে নানান বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান। অনেক ধৈর্য, দারুণ অবজারভেশন ক্ষমতা। অচেনা ব্যক্তিকে একবার সে দেখেই খুব সহজে তার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে দিতে পারতো। সমুদার কাছে সেই অর্থে কোনোদিনই পিস্তল জাতীয় কোনো অস্ত্র ছিল না। তার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ অর্থাৎ সমুদার কথায় ‘মগজাস্ত্র’ই হলো তার প্রধান অস্ত্র।

সময়ের সঙ্গে কবে যে সে এক নামী গোয়েন্দা হয়ে উঠলো, তা বাড়ির কেউই টের পেলো না। সেই বারো ক্লাস থেকে সমুদার সঙ্গে তার এই অদ্ভুত দুনিয়ায় পথ চলা শুরু। কিন্তু আজও আমি ভুলিনি তার প্রথম তদন্তের কথা। সমুদার বয়স তখন সবে আটাশ পেরিয়েছে আর আমার সতেরো। সেবার বাবা ঠিক করলো, আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জেলা মুর্শিদাবাদ দেখাবে। আমাদের বাড়ির প্রচলিত নিয়ম ভেঙে তাই বেরিয়ে পড়লাম ১০৭/সি, হরি ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা থেকে আমরা অর্থাৎ আমি, সঙ্গে বাবা আর অবশ্যই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ সমুদা।

ট্রেন ছিল বিকেল পৌনে পাঁচটায়। কিন্তু বাবা দেরি করায় আমরা স্টেশনে এসে পৌঁছালাম ঠিক দশ মিনিট আগে। সমুদা আর আমি ট্রেনে উঠেই সিটে বসে পড়লাম এবং আমাকে ব্যাগ থেকে নতুন মলাট দেওয়া Sherlock Holmes-এর গল্পসমগ্রটা বের করতে দেখে সমুদা বলে উঠল,”বঙ্কু, বইটা একবার দে দেখি”।

ও হ্যাঁ! আপনাদের তো বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। সমুদা ছোটোবেলা থেকেই ছিল গোয়েন্দা-গল্পের পোকা। এখনো সময় পেলেই সে বসে পড়ে Edgar Allan Poe-র C. Auguste Dupin-এর গল্প অথবা স্কটিশ লেখক Sir Arthur Conan Doyle-এর লেখা Sherlock Holmes-এর গল্পসমগ্র নিয়ে। বইয়ে পড়া সব নির্মিত গোয়েন্দা-চরিত্রগুলির মধ্যে Sherlock Holmes-ই হলেন সমুদার কাছে তার আদর্শ চরিত্র।

তবে, বাবার কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলবো, উনি বইটই পড়তে তেমন আগ্রহী নন। সুতরাং ট্রেনে ওঠা মাত্রই, উনি চললেন নতুন বন্ধু খুঁজতে। মি. বক্সীর সঙ্গে বাবার আলাপ হলো। ‘’কলকাতার ধর্মতলা চত্বরে আমার দোকান রয়েছে, তাই বহরমপুরের চেয়ে কলকাতাতেই বেশি থাকা হয়। এবার তো প্রায় মাসখানেক পর বাড়ি ফিরছি। তা মশাই, আপনারা কি মুর্শিদাবাদ ঘুরতে যাচ্ছন?”

মি. বক্সীর শেষ কথাটির উত্তরে বাবা বললো, “হ্যাঁ! ওই উচ্চ মাধ্যমিকের আগে ছেলেকে একটু ঘুরিয়ে আনা বলতে পারেন”। আমার আর সমুদার দিকে তাকিয়ে মি. বক্সী এবার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “ওদিকের জানালার ধারেরটা বুঝি আপনার ছেলে? আর অপরদিকের জন?”

“ও আমার ছোটো ভাই, সমরেশ”, বললো বাবা। সেই শুনে ঘাড় নাড়তে নাড়তে মি. বক্সী বললেন, “আচ্ছা! আচ্ছা!”

ওই অল্প সময়ের মধ্যে মি. বক্সি বাবার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছিলেন এবং সেই সূত্রে আমার কাছে ওনার মি. বক্সী থেকে বক্সীকাকু হতে বেশি সময় লাগলো না। আর এর মাঝেই ট্রেন চলতে লাগলো। শুরু হলো আমাদের নতুন যাত্রা, গন্তব্য স্থান মুর্শিদাবাদ।

ট্রেনে যেতে যেতে আমার উদ্দেশ্যে বক্সীকাকু বললেন, “জানো বঙ্কু, মুর্শিদাবাদ হলো আমাদের পশ্চিমবঙ্গের এমন একটি জেলা যা জুড়ে রয়েছে শুধু ইতিহাস আর ইতিহাস”। সেই শুনে আমি বলে উঠলাম, “ঠিক বলেছেন কাকু, মুর্শিদাবাদ নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই পলাশীর যুদ্ধের কথা। মুর্শিদাবাদ মানেই হলো নবাবিয়ানা”।

মুর্শিদাবাদের ইতিহাস নিয়ে আমাদের মধ্যে ওই যে আলোচনা শুরু হলো, তা থামলো বহরমপুর স্টেশন পৌঁছে। ঘড়িতে তখন বাজে রাত ন’টা। বক্সীকাকু স্টেশন থেকেই চলে গেলেন ওনার নিজের বাড়ি। তবে যাওয়ার আগে আমাদের উদ্দেশ্যে ওনাকে বলতে শুনলাম, “আগামীকাল সকালে আমি কিন্তু সময় মতো গেস্ট হাউসে পৌঁছে যাবো। তোমরা রেডি থেকো”।

হ্যাঁ! উনি আমাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এদিকে, আমরাও তারপর স্টেশন থেকে একটা ট্যাক্সি করে শিবুদাদুর গেস্ট হাউসে এসে পৌঁছলাম। দূর থেকে সেই গেস্ট হাউসটা দেখে মনে হচ্ছিলো, এ যেন এক জমিদারের পুরোনো বাংলো। এই বিষয় সমুদাকে বলতেই সে বললো, “এটা কোনো জমিদারের বাংলো নয়, এটাই হলো মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য”।

রাতে খাওয়া পর আমি আর বাবা যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, তখন সমুদাকে দেখলাম সদর দরজা খুলে সে কোথায় যেন বেরচ্ছে। সেই বিষয় বাবা তাকে জিজ্ঞেস করতেই সমুদা বললো, “খাওয়ার পর এতো তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসে না। তাই বাংলোর আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করতে যাচ্ছি”। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারলাম যে, সেদিন আমরা যাবো হাজারদুয়ারি প্যালেস দেখতে। এদিকে, বক্সীকাকুও ওনার কথামতো গেস্ট হাউসে এসে হাজির হলেন এবং বাবাকে নিয়ে উনি ওনার আনা গাড়িতে উঠে পড়লেন।

তবে, আমি আর সমুদা একটু আলাদা অনুভূতির স্বাদ পেতে গেলাম টাঙ্গা গাড়িতে। ঘোড়ার দ্বারা চালিত সেই টাঙ্গা গাড়ির ঝাঁকুনি খেতে খেতে যেতে বেশ মজাই লাগছিল। আর ওই অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ইতিহাস নিয়ে তখন চর্চা শুরু করে দিলাম। সমুদা আমায় বললো, “জানিস বঙ্কু, এই জেলায় এখনো এমন অনেক ইতিহাস রয়েছে যা মানুষের কাছে আজও অজানা।”

আমি বললাম, “তা সেই ইতিহাস তো নবাব সিরাজের আমলের।”

সমুদা মাথা নেড়ে বললো, “না রে, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস যে শুধু ওনাকে ঘিরেই রয়েছে সেটা ভাবলে ভুল হবে। এখানকার ইতিহাসকে দুভাগে দেখলে, প্রথমটা বলা যায় পলাশী যুদ্ধের আগে আর দ্বিতীয়টা পলাশী যুদ্ধের পর।” আমি ঘোড়া ছোটার শব্দকে উপেক্ষা করেই সমুদার কথা মন দিয়ে শুনতে লাগলাম। সে আরও বললো, “যেমন ধর, এই হাজারদুয়ারি প্যালেস। এটা কিন্তু অনেক পরেই তৈরি হয়েছে। নবাব নাজিম হুমায়ুন জাঁ-র আমলে প্যালেসটি তৈরি করেছিলেন Bengal Engineers Corporation-এর এক ইংরেজ আর্কিটেক্ট, নাম Colonel Duncan McLeod । এই হাজারদুয়ারি নামটা হয়েছে এই প্যালেসের আসল নকল মিলিয়ে মোট এক হাজারটি দরজা রয়েছে বলে। প্যালেসের পুরোটাই ইতালিয়ান ও গ্রিক কারুকার্যে ভরা।”

ইতিহাসের কথা শুনতে শুনতে আমরা এসে হাজির হলাম সেই বিশাল আকারের প্যালেসটার সামনে। আমরা টাঙ্গা থেকে নামতেই দেখি, বাবা আর বক্সীকাকু সেখানে অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন। কিন্তু আরও একজন ব্যক্তিকে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। সামনে যেতেই বাবা ওনার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিলেন, “মি. মিত্র, ও হলো আমার ছেলে বঙ্কু আর পাশের জন আমার ছোটো ভাই, সমরেশ”।

“নমস্কার, আমি বিভু মিত্র। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো”।

কিন্তু কে এই বিভু মিত্র? বক্সীকাকুকে ওনার বিষয় বলতে শুনলাম, “মি. মিত্র হলেন এখানকার এক বিশিষ্ট স্বনামধন্য ব্যক্তি। এই মুর্শিদাবাদ জেলায় ওনার নাম শোনেনি, এমন খুব কম লোকই আছে”।

তবে, ওনার নামটা শুনে আমার যেমন অদ্ভুত লাগলো ঠিক তেমনই লাগলো ওনাকে দেখে। সমুদাকে লক্ষ্য করলাম, সেও মি. মিত্রকে বেশ ভালোভাবেই মাপছিলেন। ওনার বিবরণ দিতে গেলে সবার আগে বলতে হবে ওনার পাকানো গোঁফের কথা। মাথায় অল্প চুল, প্রায় নেই বললেই চলে। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের একটা চশমা, পরনে সাদা কুচি দেওয়া ধুতি ও নীলচে রঙের পাঞ্জাবি, যার মধ্যে রয়েছে কেমন সাদা রঙের ডিজাইন আর হাতে ছিল একটি বহুদিনের পুরনো লাঠি।

মি. মিত্রর সঙ্গে আলাপ করতেই উনি আমাদের হাতে একটা করে মিষ্টি তুলে দিলেন। পথে আসতে আসতে আমার একটু খিদেই পেয়েছিল, সুতরাং আমি আর কিছু না ভেবেই টুপ করে মিষ্টিটা খেয়ে ফেললাম। কিন্তু সমুদা? সে ওই মিষ্টি খেলেও তার মাথায় তখন ওই সামান্য মিষ্টিকে কেন্দ্র করেও নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো।

হাজারদুয়ারিতে ঢুকেই বক্সীকাকু একজন গাইড ঠিক করে ফেললেন এবং সেই গাইড যথারীতি আমাদের বোঝাতে লাগলো এই হাজারদুয়ারির বিভিন্ন ইতিহাসের কথা, “বাবুরা, সবার আগে বলি, এই প্যালেসের আগের নাম ছিল ‘বড়কুঠি’। এটা কিন্তু নবাব সিরাজের তৈরি নয়। নবাব নাজিম হুমায়ুন জাঁ প্যালেসটি তৈরি করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে এই প্যালেসের দায়িত্ব নেয় Archaeological Survey of India…”।

আমরা ওই গাইডের কথা এতটাই মন দিয়ে শুনছিলাম যে সমুদার ব্যাপারে কোনো টের পাইনি। ফেরার পথে তাই দেখি, সমুদা ভাগীরথীর ধারে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তো দৌড়ে গিয়ে তাকে নতুন সব অজানা তথ্যের বিষয় জানাতে চাইলাম কিন্তু সমুদা ওই বিষয় কোনো পাত্তাই দিলো না। সে তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। পরে অবশ্য ওই বিষয় সমুদাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আমরা ওখানকার বেশ কিছু মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করলাম, যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে সেই বিখ্যাত ‘বাচ্চাওয়ালী তোপ’। হাজারদুয়ারি দেখার পর আমরা ইমামবাড়া, ঘড়িঘর ও মদিনা মসজিদ দেখে চললাম বক্সীকাকুর বাড়ি দুপুরের খাওয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। কিন্তু মি. মিত্র আমাদের সঙ্গে গেলেন না। উনি বললেন, “আজ আর আমার পক্ষে তোমার বাড়ি যাওয়া সম্ভব হবে না, বক্সী। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে, তাই এখান থেকে আমি সোজা বাড়ি ফিরে যাব”।

বক্সীকাকুর বাড়ি বহরমপুরে হলেও ওনার আদি বাড়ি ছিল ঐতিহাসিক পলাশীতে, যেখানে রবার্ট ক্লাইভ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে বাংলায় ইংরেজ শাসন এনেছিলেন। বক্সীকাকুর বহরমপুরের বাড়িটা বিশাল বড়ো। সে যেন এক প্রাসাদের সমান। সামনে পুকুর, পিছনে বাগান। দুজন চৌকিদার, একজন মালী এবং দুজন চাকর। সবকিছুতেই যেন সেখানে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। আমরা ওনার বাড়িতে ঢুকতেই দেখি চারিদিক নিস্তব্ধ। বক্সীকাকুর ছেলে আর বউমা দুজনেরই চোখে জল। আমরা সেই বিষয় জানতে চাওয়ায় বক্সীকাকুর ছেলে, অরুণবাবুকে বলতে শুনলাম, “আমাদের বাড়ির বহুদিনের পুরনো একটা ছবি আজ সকাল থেকেই নিখোঁজ”। কথাটা শোনা মাত্র বক্সীকাকুর যেনো আঁতকে উঠলেন, “কী প্রপিতামহের পাওয়া ছবিটা নিখোঁজ?”

“হ্যাঁ! বাবা, সকাল থেকেই ছবিটার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না”, কাঁপা গলায় বললো আরুণবাবু।   বিষয়টা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বক্সীকাকু। তবে, এর মাঝেই বাবা জিজ্ঞেস করে বসলো, “কীসের ছবি হারিয়েছে?”

উত্তরে অরুণবাবু বললো,” বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁর ছবি। ছোটো থেকে জেনে এসেছি ওই ছবি আমাদের বাড়ির ঐতিহ্য ও বংশের গর্ব”।

হ্যাঁ! নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহের ছবি, যেটি পেয়েছিলেন বক্সীকাকুর প্রপিতামহ। কিন্তু কথা হলো, এত বড়ো বাড়ি আর সাত-আটজন লোক বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ওই বহুমূল্য ছবি সকলের মধ্যে থেকে গেলো হারিয়ে?

আর এই রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির মধ্যে শুরু হলো সমুদার মগজাস্ত্রের খেল। পুরো ঘটনাটা সে শোনার পর বললো, “একবার কি ছবি রাখার জায়গাটা দেখা যাবে?”

“হ্যাঁ! হ্যাঁ! অবশ্যই। তোমরা আসো”, এই বলে বাড়ির দোতলার দক্ষিণদিকের একটা ঘরে আমাদের সকলকে বক্সীকাকু নিয়ে গেলেন। তবে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বক্সীকাকু আমাদের উদ্দেশ্যে বললো, “বৈশাখ মাসের অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এই ছবি দেখতে আমাদের বাড়িতে বহু লোকের সমাগম হয়। ওই দিন আমার প্রপিতামহ ও আমার দুজনেরই জন্মদিন”। এখানে বলে রাখা ভালো, সমুদার একটা প্রশ্ন শুনে বক্সীকাকু কেমন যেন ওই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। সেই প্রশ্ন ছিল, “আচ্ছা, আপনার প্রপিতামহ ঠিক কবে মারা গিয়েছিলেন? মারা যাওয়ার সময় ওনার বয়সই বা কত হয়েছিল?

ছবি রাখার জায়গাটা দেখে, আমরা দুপুরের খাওয়া সারতে নিচের ঘরে নেমে এলাম। বক্সীকাকুর ছেলে অরুণবাবু ও তার স্ত্রীর আপ্যায়নে আমরা তিনজন বড়োই আপ্লুত হলাম। কিন্তু বক্সীকাকুকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। উনি সত্যিই খুব ভেঙে পড়েছিলেন। আর পড়বেন নাই বা কেন? যখন অমন একটা ঐতিহাসিক জিনিস চুরি যায় তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ারই তো কথা।

খেতে খেতে বাবার মুখে সমুদার বুদ্ধির প্রশংসা শুনে বক্সীকাকু সমুদার কাছে একটা আবদার করে বসলেন, “ভাই, সমরেশ। তোমাকে একটা সাহায্য করতে হবে। আমার প্রপিতামহের চুরি যাওয়া ছবিটা তোমাকেই খুঁজে বার করার দায়িত্ব নিতে হবে”। আচমকা সেই প্রস্তাবটা শুনে সমুদা বলল, “না! মানে, পুলিশ থাকতে আমি?” “আরে সমু, উনি যখন বলছেন, তখন আর মানে মানে করিস না। গোয়েন্দাগিরি করার শখটা তো তোর অনেকদিনের। তাই সুযোগ যখন পাচ্চিস, সেটা হাতছাড়া করিস না”, খেতে খেতেই বাবা বললো।

আর বাবার এই কথার রেশ ধরেই বক্সীকাকুকে আবারও সমুদার উদ্দেশ্যে বলতে শুনলাম, “হ্যাঁ! সমরেশ, পুলিশকে বলে এই ব্যাপারটা আমি চারদিকে ছড়াতে চাই না। আর ছবিটা তুমি খুঁজে দিতে পারলে, তোমাকে আমি প্রাপ্য সাম্মানিকও দেবো। সুতরাং, তুমি আর না বলো না ভাই”।

সমুদা সবার কথায় শেষমেশ রাজি হয়ে হলো, “ঠিক আছে, মি. বক্সী, আপনাদের চুরি যাওয়া ছবি আমি খুঁজে বার করার যথাযথ চেষ্টা করবো। কথা দিলাম”।

হ্যাঁ! সমুদা রাজি হবে নাই বা কেনো? যখন ঘুরতে এসে কোনো রোমাঞ্চকর ঘটনা স্বয়ং নিজেই হাজির হয় বাড়ির দোরগোড়ায় আর সে যদি হয় সমুদার মতো একজন ব্যক্তিত্ব, যে কিনা এমন রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির জন্যই সর্বদা অপেক্ষায় থাকে। সুতরাং ওনাদের সকলকে ছবি খুঁজে বার করার আশ্বাস দিয়ে আমরা গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।

পরদিন সকালে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল আরও অনেক জায়গায়। যেমন ধরুন, মতিঝিল, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, ইত্যাদি। কিন্তু সমুদা বললো, “আজ আমরা খোশবাগ থেকে ঘুরে আসি চল”।

কবরস্থান! কথাটা শুনেই আমার কেমন গা ভারি হয়ে গেলো। বাবাকে যাওয়ার ব্যাপারে বলতেই সে বললো, “না! আজ আর কোথাও ঘুরতে যাওয়ার মন নেই। ভাবছি, মি. বক্সীর বাড়ি থেকে ঘুরে আসবো। ওনার পাশে থাকাটা এখন খুব প্রয়োজন”।

সেদিন তাই আমি আর সমুদা দুজন মিলেই খোশবাগের উদ্দেশে রওনা দিলাম। আর বাবা বক্সীকাকুর দুঃখ কিছুটা ভাগ করে নিতে ওনার বাড়ি গেলো। আমার মনে তখন নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, নৌকা করে ভাগীরথী নদী পেরোনোর সময় তাই আর চেপে রাখতে না পেরে সমুদাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আচ্ছা, আজ হঠাৎ মতিঝিল, কাশিমবাজার রাজবাড়ি ছেড়ে তোমার খোশবাগ আসার কারণটা কি?”

সমুদার উত্তর, “ধরে নে এটা আমার তদন্তের একটা অঙ্গ। কারণ ভুলে যাস না বঙ্কু, নবাব সিরাজের সমাধির পাশাপাশি নবাব আলিবর্দি খাঁর সমাধিও ওখানে রয়েছে। আর তাই এই তদন্ত শুরু করার আগে খোশবাগ আসাটা আমার খুব জরুরি ছিল”। ভাগীরথী নদী পেরিয়ে আমরা যখন খোশবাগ পৌঁছালাম, তখন প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। আমরা পৌঁছেই প্রথমে গেলাম আলিবর্দি খাঁর সমাধি দেখতে। সেই সমাধি দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, সেটি বেশ পুরনো। সমুদাকে লক্ষ্য করলাম বেশ অনেকক্ষণ ধরেই সে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভেবে চলেছে। আমি সামনে যেতেই একটা ফলকের দিকে তাকিয়ে সমুদাকে আমার উদ্দেশ্যে বলতে শুনলাম, “ভালো করে দেখে রাখ বঙ্কু, নবাব মারা গিয়েছিলেন ১০ই এপ্রিল, ১৭৫৬ সালে। সুতরাং, মৃত্যুর সময় ওনার বয়স দাঁড়ায় চুরাশি, অর্থাৎ…।” “অর্থাৎ কি সমুদা?” আমি প্রশ্নটা করতেই সমুদা মুচকি হেসে বললো, “অর্থাৎ যেটা বোঝার ছিল, তা বোঝা হয়ে গেছে, মি. বঙ্কু। এবার চলুন ফেরা যাক”।

সমুদার হাবভাব দেখে আমার মাথায় অনেক প্রশ্ন আসছিল কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি তাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইনি। আমরা ফেরার পথে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সমাধিও দেখলাম বটে। তবে, বলা যেতে পারে সমুদার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল নবাব আলিবর্দি খাঁর সমাধি। আমরা এরপর সেই ঐতিহাসিক স্থান থেকে বেরিয়ে আর গেস্ট হাউসে ফিরলাম না। সেখান থেকে সোজা গিয়ে হাজির হলাম বক্সীকাকুর বাড়ি।

ওনার বাড়ি ঢুকতেই দেখি বাবা আর বক্সীকাকুর সঙ্গে মি. মিত্রও ওখানে বসে রয়েছেন। বক্সীকাকু আমার থেকে তখন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বঙ্কুবাবু, আজ ঘোরাটা কেমন হলো? শুনলাম তোমরা নাকি খোশবাগের দিকে গিয়েছিলে”। আমি কিছু বলার আগেই সমুদা এগিয়ে এসেছে বক্সীকাকুকে প্রশ্ন করল, “মি. বক্সী, আপনার প্রপিতামহ এই ছবিটা কি সত্যিই পেয়েছিলেন? ঠিক কত সালে উনি মারা যান বলতে পারেন? কারণ ইতিহাস বলে ১৭৫৬ সালে আলিবর্দি খাঁ চুরাশি বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। অর্থাৎ পলাশী যুদ্ধের ঠিক একবছর আগে।”

সমুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই বক্সীকাকু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, “সত্যি ভাই সমরেশ, তোমার প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তুমি ঠিকই ধরেছো। আসলে গতকাল আমি ছবি হারানোর শোকে কী বলতে কী বলেছি সেটা ধরে বসো না।”

এরপর উনি আমাদের সবটা খুলে বললেন, “মি. জেকবস উইজে নামক এক ইংরেজ সৈনিক ওই ছবিটি পেয়েছিলেন। উনি পলাশী যুদ্ধের সময় রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যদের মধ্যে একজন ছিলেন। যুদ্ধের পর মীরজাফরের আদেশে প্রাসাদের বহু জিনিস ফেলে দেওয়া হয় আর সেই সকল জিনিসের মধ্যে এই ছবি ছিল অন্যতম। মি. জেকবস ছবিটি খুঁজে পাওয়ার পর, সেটিকে নিজের কাছেই রেখে দেন যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে”। কিন্তু কীভাবে সেই ছবি বক্সীকাকুর প্রপিতামহর হাতে এলো? সেটাই ছিল বড়ো প্রশ্ন।

বক্সীকাকুকে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আরও বলতে শুনলাম, “মি. জেকবস যুদ্ধের পর, East India Company থেকে অবসর নেন এবং তারপর উনি মুর্শিদাবাদেই পাকাপাকি ভাবে রয়ে যান। আমার প্রপিতামহ ছিলেন ওনারই বাড়ির এক সাধারণ কর্মী। উনি ভালো ছবি আঁকতে পারতেন বলে মি. জেকবস ওনাকে দিয়ে নানা সময় নানান ছবি আঁকাতেন। আর এরকমই একদিন ওনার একটি আঁকা ছবি দেখে মি. জেকবস মুগ্ধ হয়ে নবাবের সেই ঐতিহাসিক ছবি ওনার হাতে তুলে দেন। ব্যস, সেই থেকেই ওই ছবি হয়ে ওঠে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য এবং গর্ব।”

সব শুনে মনে হলো, বক্সীকাকুদের পরিবার সত্যি ঐতিহ্যশালী এবং এমন এক পরিবারের সম্মুখীন হতে পেরে তখন নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল। কিন্তু সমুদা? তাকে দেখে মনে হলো, রহস্য যেন তখনো ওই ঘরে মধ্যে রয়ে গেছে।

এবার আসা যাক মি. মিত্রর কথায়। উনি আজ আমাদের যেন কেমন এড়িয়ে চলছেন। কোথাও যেন আগের দিনের সঙ্গে ওনাকে একদমই মেলাতে পারছিলাম না। মি. মিত্রর সম্বন্ধে জানতে চাওয়ায় বক্সীকাকু বললেন, “মি. মিত্রর সঙ্গে আমার আলাপ বহুদিনের। আমাদের প্রথম দেখা একটি প্রদর্শনীতে আর সেখানেই প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন মি. মিত্র।” চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে রাখার মুহূর্তে মি. মিত্রর উদ্দেশ্যে সমুদা বললো, “তার মানে আপনার আর্ট অ্যান্ড পেইন্টিং সম্বন্ধে বেশ ভালোই দখল আছে দেখছি।” শুনেই মি. মিত্র বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, না মানে, ওই সামান্য আর কী।” মি. মিত্র লোকটিকে সমুদার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। ওনার কথা বলার ধরন দেখলে মনে হবে যেন মনে এক আর মুখে এক।

এদিকে, রাতে গেস্ট হাউসে ফেরার পর, বাবা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম এলো না আমাদের দুজনের চোখে। চারদিকের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝেই সমুদা মগ্ন গভীর চিন্তায়। আর আমি তখন ভাবছি শুধু পলাশী যুদ্ধের কথা, হ্যাঁ! যেই যুদ্ধে নির্মমভাবে মরতে হয়েছিল নবাব সিরাজকে শুধু কিছু বিশ্বাসঘাতকের জন্য। আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও, মীরজাফরের মতো কিছু মানুষ এখনো এই সমাজে রয়ে গেছে। ফলে, নবাব সিরাজের মতো অনেক মানুষকে আজও শিকার হতে হচ্ছে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার।

সকাল হতেই সমুদার সঙ্গে আমি সরকারি কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম এবং ওখানে পৌঁছানোর পর, অনেক দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে আমরা এক কর্মীকে এই তদন্তের স্বার্থে সাহায্য করতে রাজি করালাম। লোকের থেকে কাজ আদায় করতে সমুদা ভীষণ পটু। ওই ব্যক্তি আমাদের সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে গেলেন এবং একটা ঘরে বহু কাগজপত্র খুঁজে তিনি একটা রেজিস্টার বের করে এনে সমুদার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এই রেজিস্টারটা ঘেঁটে দেখুন, যদি কিছু পান”। রেজিস্টারের পাতাগুলো বেশ অনেকক্ষণ উলটেপালটে দেখার পর সমুদার মুখে এক মৃদু হাসি লক্ষ্য করলাম। সেই হাসিই বলে দিচ্ছিল যে তার এই কার্যালয়তে আসার সিদ্ধান্তটা একেবারেই সঠিক। আর তাই কার্যালয় থেকে বেড়িয়ে আসার মুহূর্তে আমি সমুদাকে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই সমুদা বললো, “বুঝলি বঙ্কু, বাস্তবে মি. জেকবস উইজে নামে কোনোদিনও কেউ ছিল না। কারণ, যদি থাকত তাহলে তার নিশ্চয়ই কোনো একটা প্রমাণ এখানে পাওয়া যেত।” তারপর সমুদা যেটা বললো, তা আমাকে আরও স্তম্ভিত করলো।

“রেজিস্টার ঘেঁটে যা দেখলাম, তাতে সাহেবি নাম বলতে, জেকবস স্টারলিং আর দাভিদ উইজে। এঁরা দুজনেই গোরাবাজারে থাকেন, কিন্তু সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই দুজনের সঙ্গে East India Company-র কোনো যোগাযোগ নেই। East India Company ছিল স্বাধীনতার আগে। সুতরাং, স্বাধীনতার পর কোনোভাবেই তাদের ব্যাপারে জানা সম্ভব নয়, যদি না তারা কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র হন।”

কথাগুলো শুনে আমার বেশ এক্সসাইটিং লাগলো। তবে, সমুদার মনে তখন এক নতুন সন্দেহ ডানা বাঁধলো। অনেকক্ষণ তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি বললাম, “তুমি কিছু কি বুঝতে পারছো?”

“হুম। বঙ্কু, এই ছবি হারানোর ঘটনাটা আমার মনে হচ্ছে পুরোটাই এক সাজানো ঘটনা। তবে, এর উদ্দেশ্য কি হতে পারে, সেটাই বুঝতে পারছি না”। আমরা কথার ফাঁকেই দুপুরের খাওয়া সারতে এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকলাম এবং ওখানেই সমুদার এক বন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। বিকাশদা ওরফে সমুদার বন্ধু, Archaeological Survey Of India-র এক কর্মী, দুবছর হলো তার এখানে বদলি হয়েছে। কথায় কথায় সমুদা তাকে একটা কাজের দায়িত্ব দিলো এবং সেটা যে খুবই গোপনীয়, তা জানাতে সে ভুললো না। সমুদাকে কথা দিয়ে বিকাশদা বললো, “সমরেশ, খুব শীঘ্রই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আমি তোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি”।

রাতে আমি আর সমুদা তখন বিছানায় শুয়ে। বেশ মনোরম পরিবেশ। কিন্তু হঠাৎ আমাদের ঘরের উত্তরের জানালার কাঁচ ভেঙে একটা কাগজমোড়া পাথর এসে ঢুকলো। আমি তো ভয় চমকে উঠলাম! কিন্তু সমুদাকে লক্ষ্য করলাম, বিছানা থেকে উঠে সে ওই কাগজমোড়া পাথরটা হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখলো এবং মোড়ানো কাগজটা খুলতেই চোখে পড়লো তাতে লেখা রয়েছে – ‘বেশি বাড় বেড়ো না, মৃত্যু হইতে সাবধান’।

ওই মুহূর্তে আমি সমুদার নিকট গিয়ে কাঁপা গলায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কে হতে পারে বলো তো?” উত্তরে সমুদা একটু গম্ভীর গলায় বললো, “কে হতে পারে, সেটা সকাল না হলে বলাটা একটু কঠিন বঙ্কু। তবে, এটা জেনে রাখ, আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি আর তাই আমাদের গতিবিধির উপর কেউ নিশ্চয়ই নজর রাখছে”। ওই কাগজটা সমুদা নিজের কাছেই রেখে দিলো এবং পরদিন ভোর হতেই সে গেস্ট হাউসের সেই উত্তরদিকে অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে পড়লো।

সমুদা ফিরে এসে আমায় আধা জ্বলা একটা সিগারেট দেখিয়ে বললো, “বঙ্কু, ওই জানালার নিচে এই আধা জ্বলা সিগারেটটা পেলাম।” কথা শেষ করেই সে আবারও আমায় ওই সিগারেটের নিচের অংশটা দেখিয়ে বললো, “এই দেখ, ফিল্টারে এখনো পানের কিছু ভাগ লেগে রয়েছে।” আমি কিছুই তেমন বুঝতে পারছি না দেখে সমুদা আমাকে বুঝিয়ে বললো, “আমার বিশ্বাস, এই কাজ যে করেছে তার মুখে ওই মুহূর্তে একই সঙ্গে পান আর সিগারেট দুটোই ছিল। এই কাজ যে বাইরের কোনো লোকই করেছে, তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কারণ একটু ভেবে দেখ, এই গেস্ট হাউসে যারা রয়েছে তারা কেউই এই দুটো জিনিস ব্যবহার করে না।” সবটা শুনে আমি তাকে বললাম, “আমি কি বাবাকে এই ব্যাপারে বলবো, সমুদা?” সমুদা আমার কথা শুনেই বলে উঠলো, “না! না! এখনই দাদাকে এই ব্যাপারে কিছু বলতে হবে না। তদন্তের কাজ আরেকটু এগতে দে, তারপর নয় বলা যাবে। কারণ এই মুহূর্তে আমরা স্রেফ অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছি, সুতরাং অনেক ভেবে চিনতে আমাদের এখন কথা বলতে হবে”।

সেদিন বাবার সঙ্গে আমরা আবার বক্সীকাকুর বাড়ি গেলাম। কিন্তু ওনাকে দেখামাত্রই আমার কেমন যেন ওনার প্রতি রাগ হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন বক্সীকাকু আবার আমাদের মিথ্যে বললো, তাও আবার এমন একজন ব্যক্তির নামে যার কিনা অস্তিত্ব কোনোদিন ছিল না। বক্সীকাকুর মুখেই শুনলাম, মি. মিত্রও নাকি কাজের স্বার্থে ওনার বাড়ি আসছেন এবং বলতে না বলতেই এসে হাজির হলেন মি. মিত্র। আমি সমুদার কথামতো ওনাকে দেখামাত্রই খুশি হওয়ার মিথ্যে অভিনয় করলাম।

আমরা সবাই একসঙ্গেই দুপুরে খেতে বসলাম এবং খেতে খেতে মি. মিত্র ওনার বাড়ি যাওয়ার জন্য বাবাকে বললেন, “চলুন, আজ বিকেলে আমার বাড়ি সবাই মিলে ঘুরে আসবেন। এখানে ঘুরতে এসে বক্সী আপনাদের বড়োই সমস্যার মধ্যে ফেলে দিলো দেখছি।” আমরা ওনার আমন্ত্রণে সাড়া দিলাম। কারণ, সমুদার কথায়, ‘When opportunity comes at your feet, you must grab it with your both arms wide open.’ তারপর বিকেলে আমরা সবাই মিলে মি. মিত্রর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। মি. মিত্র বহরমপুরেই থাকেন। ওনার বাড়ি আর পাঁচটা বাড়ির মতো একদমই নয়। রাস্তায় যেতে যেতে সেই বিষয় উনি আমাদের বললেন, “আমার ছোটো থেকেই পাখির খুব শখ। তাই বাড়ির একটা ঘর ওদের জন্যই ছেড়ে দিয়েছি।”

বাবা ওনাকে জিজ্ঞেস করল, “পাখি মানে, ক’টা পাখি রয়েছে, মি. মিত্র?” উত্তরে উনি বললেন, “বিভিন্ন জাতের অনেক পাখিই রয়েছে সেই ঘরে। তবে, তাদের দেখাশোনার জন্য একজন ছেলেও রয়েছে আমার বাড়িতে।” মি. মিত্র আরও জানালেন, “সেই ছোটোবেলা থেকেই সোমনাথ ওদের দেখাশোনার জন্য রয়েছে। বড়ো ভালো ছেলে সোমনাথ, খুব বিশ্বস্ত”।

কথা বলতে বলতে এসে পৌঁছোলাম মি. মিত্রর বাড়ি। উনি সোমনাথকে আগেই আমাদের আসার কথা বলে রেখেছিলেন। সুতরাং, বাড়িতে ঢোকামাত্রই আমাদের জন্য সে মিষ্টি আর সরবত নিয়ে এসে হাজির হলো। সোমনাথের সঙ্গে আলাপ করে সমুদার তাকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগলো। সোমনাথের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতেই হয় তার ছিপছিপে চেহারার কথা। তার গায়ের রঙ বেশ কালো, ঠোঁট ছিল টকটকে লাল। মনে হয় সর্বদা যেন পান অথবা খৈনিতে ডুবে থাকে। আর তার স্বভাব ছিল খুবই বিকট ধরনের। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তার ধূমপানেরও নেশা রয়েছে।

মি. মিত্র আমাদের খুবই খাতির করলেন। এর মাঝেই ওনার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা হলো বাবার, বিশেষ করে ওই দোতলার ঘরটা যেখানে রয়েছে বিভিন্ন পাখির বাস। মি. মিত্র আমাদের ওনার বাড়ি ঘুরে দেখাতে লাগলেন।  “নিচের এই দুটো ঘরের মধ্যে এটি আমার প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার হয় আর ওই ঘরটি অনেক দিন ধরেই বন্ধ”। সমুদা ওই বন্ধ ঘরের বিষয়ে জানতে চাইতেই উনি বললেন, “এটা আমার বাড়ির স্টোর রুম বলতে পারো”। ওনার কথায় দেখলাম সমুদার ঠিক বিশ্বাস হলো না। তার মনে জাগলো প্রশ্ন, “যদি ঘরটা অনেকদিন ধরে বন্ধই থাকে, তাহলে কীভাবে বন্ধ দরজার তালার মধ্যে দিয়ে রঙের গন্ধ ভাসছে? এই ঘর নিশ্চয়ই কিছুদিনের মধ্যে খোলা হয়েছিল”।

আমরা এবার গেলাম দোতলায়। সেখানে রয়েছে দুটি ঘর। একটি হল মি. মিত্রর এবং অপরটি ওনার সেই বিশেষ প্রাণীদের জন্য। হ্যাঁ, সেই ঘর জুড়েই রয়েছে বিভিন্ন জাতের নানান পাখি। লাল, নীল, হলুদ, আরও অনেক রঙের। সেখানে যেমন রয়েছে নানান ধরনের টিয়া, তেমনই রয়েছে কাকাতুয়া, ময়না আরও কতো কী। বাবা তো হকচকিয়ে গিয়েছিলেন এতো পাখি দেখে। তারপর ধীরে ধীরে সেই পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। কী সুন্দর মনোরম পরিবেশ সেখানে বলে বোঝানো যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। নানান পাখিদের ডাক একসঙ্গে একই ঘরের মধ্যে শুনে মনে হচ্ছিল এ যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছিলাম।

এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের আসল লক্ষ্যের কথা। কিন্তু সমুদা? না! সে কখনওই ভোলেনি। তাই ফিরে আসার সময় সে আমায় শুধু বললো, “বঙ্কু, খুব সজাগ থাকিস। বিপদ যেকোনো দিক থেকে আসতে পারে।” কথাটা শুনে আমার ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমি জানি সমুদা থাকতে আমার কিছু হবে না। সেই বিশ্বাসটা আমার সর্বদা ছিল তার উপর।

রাতেই সমুদার কাছে বিকাশদার ফোন এলো এবং আমার বুঝতে দেরি হয়নি যে সে সমুদার ওই কাজ সফলভাবে সম্পূর্ণ করেই তাকে ফোন করেছে। সমুদা ফোন রাখার পর তার মুখে শুনলাম, “বুঝলি বঙ্কু, বিকাশের দেওয়া খবর অনুযায়ী যে ইংরেজ সৈনিক পলাশী যুদ্ধের পর East India Company থেকে অবসর নিয়েছিলেন, তিনি হলেন দাভিদ স্টারলিং। স্টারলিং সাহেব অবসর নেওয়ার পর এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে গেলেও ওনার বংশের কারোরই আর কোনো খবর নেই”।

ওই রাতে তাই সমুদা ঠিক করলো পরদিন সকালের মধ্যেই স্টারলিং সাহেবের বাকি খবর সে যে করেই হোক বের করবে। ফলে, আমাদের আবারও ছুটতে হবে ওই সরকারি কার্যালয়ে এবং সেই কর্মীর সাহায্য নিতে হবে। কথামতোই আমরা সকালে উঠে সেই সরকারি কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম এবং সেখানে পৌঁছে ওই কর্মী মারফৎ রেজিস্টার ঘেঁটে জানতে পারলাম যে, স্টারলিং নামের আরও একজন ব্যক্তির ঠিকানা সেখানে উল্লেখ রয়েছে যার পরিবারের বসবাস সেই প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকেই। সমুদা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম ওই ঠিকানায় সেই অচেনা ব্যক্তির সন্ধানে।

স্টারলিং সাহেব থাকতেন মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে। জিয়াগঞ্জ পৌঁছে আমরা অনেকজনকেই ওনার কথা বললাম, কিন্তু কেউই ওঁকে ঠিকভাবে চিনে উঠতে পারলো না। শেষে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন, “আমার নাম সাভিও স্টারলিং। আপনারা যাঁর বিষয় জানতে ইন্টারেস্টেড, আমি তাকে চিনি”। কথা শেষ করে উনি আমাদের দুজনকে ওনার বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে যা জানতে পারলাম তা বেশ চমক দেওয়ার মতো। এমন চমক হয়তো সমুদাও কল্পনা করেনি। এই তদন্তে এলো এক নতুন মোড়। সাভিও সাহেব আমাদের জানালেন, “দাভিদ স্টারলিং রিটায়ার্ড হওয়ার পর এই জিয়াগঞ্জেই থেকে যান। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে নানান অসুস্থতার কারণে ওনার বড়োছেলে অর্থাৎ জোসেফ স্টারলিং ওঁকে ১৮২০ সালে ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে যায়”। সমুদা সেই বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে আপনি?” উত্তরে উনি বললেন, “হ্যাঁ, আমি হলাম দাভিদ স্টারলিং-এর ছোটোছেলে টমাস স্টারলিং-এর বংশধর। আমার গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার ছিলেন দাভিদ স্টারলিং।”

কথা বলতে বলতে ওনার বউমা মারিয়া এসে আমাদের চা ও বিস্কুট দিয়ে গেলেন। সমুদা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ামাত্রই ওনাকে সেই ছবির বিষয় জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, মি. সাভিও, আপনার কি এমন কোনো ছবির কথা মনে আছে যা ছিল এখানকার নবাব আলিবর্দি খাঁর?” প্রশ্ন শুনেই সাভিও সাহেব চটে গেলেন। উনি বললেন, “উফ্‌ মি. দত্ত, আপনারা সবাই এক। খালি ছবির কথাই ask করেন। No! নেই আমার কাছে, নেই সেই পেইন্টিং। ওটা জোসেফ স্টারলিং ইংল্যান্ডে নিয়ে চলে গেছে।” সমুদা সাভিও সাহেবের কথা শুনে জানতে চাইলেন যে আর কে বা কারা এই ছবির কারণে ওনাকে বিরক্ত করেছেন এবং এই প্রশ্নের উত্তর যে আমাকে এতটাই চমকে দেবে, সেটা আমি একদমই কল্পনা করিনি। “Yes,” উনি বলে উঠলেন, “Many years ago, one man came asking for that painting.  His name was some Bakshi.”

কথা শেষ হতে না হতেই সমুদার আর কোনো সন্দেহ রইলো না যে এই বক্সীই হলো আমাদের পরিচিত মি. বক্সী অর্থাৎ বক্সীকাকু। সাভিও সাহেবের কিছু সময় আমাদের দেওয়ার জন্য ওনাকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে দেখি সমুদা গেস্ট হাউসের টেলিফোনটার মাধ্যমে তার এক কলকাতার পরিচিতকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল এবং পরে তাকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই সে আমায় বললো, “কলকাতার একজনকে মি. বক্সীর ব্যবসার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে বলছিলাম।” আমি তাকে বললাম, “তার মানে বক্সী কাকু…”

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সমুদা আমাকে তামিয়ে বললো, “বঙ্কু, মুর্শিদাবাদের রাস্তাঘাট আর নিরাপদ রইল না রে।” সেই শুনে আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, “কেন সমুদা? তুমি কী দেখে বুঝলে?” উত্তরে সে আমায় বলল, “একটু চোখ কান খোলা রাখলে তুইও বুঝতে পারতিস যে আমরা যখন জিয়াগঞ্জে গিয়েছিলাম তখন আমাদের ওপর কেউ নজর রাখছিল। জিয়াগঞ্জে এর প্রমাণ আমি অনেকবার পেয়েছি। যার মধ্যে অন্যতম হলো ওই নীল রঙের গাড়ি, যেটা সবসময় আমাদের পিছনেই পড়ে ছিল। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই ওই গাড়িটা পৌঁছে যাচ্ছিল।”

সমুদার কথায় মনে হলো রহস্যের অনেকটাই সে সমাধান করে ফেলেছে। ফলে, শত্রুপক্ষ এখন তার উপর সর্বদাই নজর রাখছে। সমুদা যে এই রহস্যের সমাধান প্রায় করেই ফেলেছে সেই বিষয় আমাকে জানাতে সে দ্বিধাবোধ করলো না। সে বললো, “বঙ্কু, সেদিন মি. মিত্রর দেওয়া যে মিষ্টিটা খেলি, সেটায় কি কোনও গন্ধ পেয়েছিলিস?” আমি বললাম, “আমি তো অতশত না বুঝেই খেয়ে ফেলেছিলাম। তাই কোনও গন্ধ টের পাইনি সমুদা।”

সমুদা আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হয়ে বললো, “ওরে, তোকে কতবার বলেছি নিজের সিক্স সেন্স সবসময় সচল রাখবি! ওই মিষ্টির প্যাকেটের মধ্যে রঙের গন্ধ ভাসছিল, যেই রং সাধারণত কোনো ছবি আঁকার জন্যই ব্যবহার করা হয় বলে আমার ধারণা। আর তুই যে মি. মিত্রর পাঞ্জাবিতে সাদা ডিজাইন দেখেছিলিস সেটা আসলে কোনো ডিজাইন নয়, ওটা হলো রঙের দাগ। সম্ভবত ছবি নিয়ে নড়াচড়া করতে গিয়েই সেই রঙ লেগে যায় ওনার পাঞ্জাবিতে। সুতরাং এটা হতেই পারে যে ওই ছবি মি. মিত্রর বন্ধ তালা দেওয়া ঘরেই রয়েছে। হয়তো সেইজন্য মি. মিত্র ওই ঘরকে স্টোর রুমের আখ্যা দিলেন। উনি হয়তো ভাবেননি যে ওনার ওই বন্ধ ঘরের তালা বদলের খেলার মধ্যে দিয়ে কেউ এই রহস্যের সমাধান খুঁজে পাবে।”

আমি সমুদাকে প্রশ্ন করার আগেই সে ফের আমায় বললো, “আমি জানি তোর মনে প্রশ্ন উঠবে যে আমি কী করে এতসব ধরলাম, যেখানে আমি অন্য ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। কিন্তু তোর সেইসব প্রশ্নের উত্তরে আমি এখন শুধু এইটুকুই বলবো যে একজন গোয়েন্দা হতে গেলে চারদিকে কী হচ্ছে সবকিছুর উপরই সমানভাবে নজর রাখতে হয়, নাহলে কোনো তদন্তই সঠিকভাবে করা যায় না।”

সমুদা তারপর সেদিন রাতের ঘটনার সূত্র ধরে বললো, “আরেকটা কথা বলে রাখি তোকে, আমাদের উপর যে নজর রাখছে আর ওই রাতে আমাদের ঘরে যে কাগজ ছুঁড়েছিল সে একই লোক। সে আসলে সোমনাথ, মি. মিত্রর অনুচর। সোমনাথকে মি. মিত্রই পাঠিয়েছিলেন আমাদের সাবধান করে দেওয়ার জন্য। কারণ, উনি বুঝে গিয়েছিলেন সমরেশ ক্রমশই ওনার জন্য বিপদ হয়ে উঠছে।”

সমুদার কথা শেষ হতেই বুঝলাম, সেদিনের সিগারেটের ফিল্টারে পানের কিছু ভাগ লেগে থাকা থেকে শুরু করে ওইদিন মি. মিত্রর বাড়িতে সোমনাথের সঙ্গে আলাপ এবং তার বিভিন্ন স্বভাবের কথা জানার পর, সবকিছু মিলিয়ে সে সোমনাথকে ধরে ফেললো। সত্যি! সমুদার কোনো জবাব নেই। জবাব নেই তার দৃঢ় বুদ্ধির। রাত অনেক হলো তাই সমুদা আমাকে শুয়ে পড়তে বলে, সে গেলো ঘুমাতে।

পরদিন সকালে উঠে দেখি প্রবল বৃষ্টি, চারদিকে আকাশ একেবারে কালো হয়ে আছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন কোনো নতুন বিপদ এসে হাজির হবে আমাদের দোরগোড়ায়। সারাদিন ঘরবন্দি আমরা সবাই। সমুদা খবরের কাগজ নিয়ে বসে রইলো আর আমি গেলাম বাবার কাছে নানান দেশ সম্বন্ধে তথ্য সঞ্চয় করতে।

দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা সমুদার কাছে তার তদন্তের বিষয় জানতে চাইলো এবং সমুদার মুখে সবটা শুনে উনি অবাক হয়ে গিয়ে বললো, “আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে মি. মিত্রর মতো একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি এরকম একটা কাজ করতে পারেন। না! দেরি করে লাভ নেই। আমি এখনই মি. বক্সীকে ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানাচ্ছি”। কিন্তু ওই মুহূর্তে সমুদার আপত্তিতে বাবা নিজের মত পালটাতে বাধ্য হলো।

সন্ধ্যাবেলা সমুদার কাছে কলকাতা থেকে ফোন এলো এবং ফোনে কথা বলার পর সমুদার দ্বিতীয় রহস্যও যে সমাধান হয়ে গেলো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সমুদার কাছে সেই বিষয়ে জানার জন্য কৌতূহল দেখাতেই সে আমায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো, “এখনই আমি তোকে এই বিষয় কিছু বলতে পারছি না। সমস্তটাই জানতে পারবি আগামীকাল, এই গল্পের শেষদিনে।” আমি সমুদার কথামতো তাই অপেক্ষায় রইলাম আগামীকালের দিকে চেয়ে।

পরদিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল আর চোখ খুলতেই, দেখি মাথার কাছে একটা চিঠি রাখা এবং সেটা পড়ে বুঝলাম যে সমুদার আমার উদ্দেশেই চিঠিটা লিখে রেখে গেছে। তাতে স্পষ্ট লেখা ছিল, আমি যাতে বাবাকে নিয়ে বেলা বারোটার মধ্যে বক্সীকাকুর বাড়ি পৌঁছে যাই এবং সেখানেই সমুদা আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। তবে, যেটা না বললেই নয়, সেটা হল- অত ভোরে উঠে সমুদা কোথায় গেছে সেই বিষয় কোনও কিছুই সে চিঠিতে উল্লেখ করেনি। আমি চিঠির বিষয়টা বাবাকে জানালাম আর তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম বক্সীকাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কিন্তু যাওয়ার পথেই আমাদের বিপদের সম্মুখীন হতে হলো! মাঝপথে কিছু লোক হঠাৎ করে আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো এবং গাড়ি থামতেই, তারা প্রত্যেকে গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতর ঢুকে এলো, যা দেখে আমি আর বাবা তখন চেঁচিয়ে উঠলাম, “আরে, কি করছেন আপনারা? গাড়ির মধ্যে উঠে পড়লেন কেন?” আমাদের প্রশ্নের উত্তর তো তারা দিলই না, উল্টে আমাদের জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে এসে হাজির করল মি. মিত্রর বাড়ি।

আর ভিতরে ঢুকতেই, আমরা তো অবাক! দেখি আমাদের মতো ঠিক একইভাবে বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকেও বেঁধে আনা হয়েছে। আমাদের তিনজনকে এরপর চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে মাথার কাছে পিস্তল ঠেকিয়ে বহু জেরা করা হলো। ওই লোকগুলোকে তখন নেতৃত্ব দিচ্ছিল সোমনাথ এবং অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন মি. মিত্র।

বাবা তো ওনাকে দেখামাত্রই চিৎকার করে উঠলেন, “আপনি আর কত নিচে নামবেন মি. মিত্র, কেন ধরে আনলেন আমাদের?” কিন্তু লক্ষ্য করলাম মি. মিত্র তাতে মাথা না ঘামিয়ে বরং আমার দিকে এগিয়ে এলেন এবং সমুদার বিষয় প্রশ্ন করতে লাগলেন, “অনেক তো গোয়েন্দাগিরি হলো, এবার লক্ষ্মীছেলের মতো বলো তো বঙ্কু, তোমার কাকাটি কোথায়?” আমি তো কিছুই বলব না বলে ঠিক করে নিয়েছিলাম। সেইজন্য অবশ্য আমায় দু-তিন ঘুসিও খেতে হয়েছে সোমনাথের হাতে।

এদিকে, মি. মিত্র ক্রমশ ওনার ধৈর্য হারাচ্ছিলেন এবং যতো সময় এগোচ্ছে, ততই যেন উনি আগ্রাসী হয়ে উঠছেন, “বলো বঙ্কু, বলো। কোথায় গেছে সমরেশ, আমাকে না বললে এবার কিন্তু আমি অন্য ব্যবস্থা নেব”। এরপর আমার চোখের সামনে উনি বাবা আর বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকে বেশ কয়েকবার ইলেকট্রিক শক দিতেও ছাড়লেন না, যাতে তাদের সেই চিৎকার শুনে আমার মুখ থেকে সমুদার বিষয়ে কিছু বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আমিও যে নিজের জেদ বজায় রেখেছিলাম। তাই ওই দৃশ্য এবং সেই চিৎকার শুনেও, মুখ থেকে আমি একটা শব্দও বের করিনি। কারণ বিশ্বাসটা ছিল সমুদা উপর। হ্যাঁ! সে নিশ্চয়ই আসবে এবং এই শয়তানরা অবশ্যই তাদের উপযুক্ত সাজা পাবে। কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা গেল। সেই আওয়াজ শুনে মি. মিত্র সোমনাথকে বললেন, “যা তো, দেখ কে আবার এল। দরজা খোলার সময় সজাগ থাকবি”।

সোমনাথ ওনার কথামতো ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগোলো এবং মুহূর্তের মধ্যে ওই ঘরে পুলিশ এসে উপস্থিত হলো। আর অবশ্যই তাদের সঙ্গে ছিল সমুদা ও তার বন্ধু অর্থাৎ বিকাশদা। চোখের সামনে দেখলাম সোমনাথ সহ বাকি লোকগুলো নিমেষের মধ্যে পুলিশের হাতে বন্দি হয়ে গেল এবং সমুদা ও বিকাশদা মিলে আমাদের সব বাঁধন খুলে দিলো। মি. মিত্র সেই দৃশ্য দেখে তো একেবারে হকচকিয়ে গেলেন।

ওনার দিকে তাকিয়ে সমুদা গম্ভীর গলায় বললো, “মি. বিভু মিত্র, আপনার খেলা শেষ। আপনিই তো সেই ছবি সরিয়েছেন। তাই এবার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন, ছবিটা কোথায় রেখেছেন?” মি. মিত্রর আর তখন কিছুই করার নেই। সুতরাং উনি সমুদার কথামতো সেই স্টোর রুমের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, “ছবি ওই ঘরে আছে।”

সমুদা যে একদম সঠিক অনুমান করেছিল, সেটাই প্রমাণ হল এবং সোমনাথের হাত থেকে তখন আমি চাবিটা নিয়ে ওই ঘর খুলে সেই ছবি বের করে আনলাম। ছবিটা একবার নিজের চোখে দেখবার জন্য বাবার কৌতূহল হচ্ছিল এবং সেই ছবি হাতে পেয়ে বাবা যেন সবথেকে খুশি হলেন। কিন্তু কথা হলো, এটাই কি সেই আসল ছবি? না, একদমই নয়। কারণ, সাভিও সাহেব আবারও মনে করিয়ে দিলেন, “This is fake! আসল পেইন্টিং এখন ইংল্যান্ডে”। বাবা সেই শুনে বলে উঠলো, “কিন্তু বক্সী যে বললো, এটাই আসল? তাহলে কি ও আমাদের সঙ্গে ছলনা করলো?”

এর উত্তরে সমুদা বললো, “হ্যাঁ, দাদা। উনি শুধু আমাদের সঙ্গেই নয়, বছরের পর বছর গোটা মুর্শিদাবাদের মানুষের সঙ্গেই মি. বক্সী ছলনা করে আসছেন এবং ওনাকে এই কাজে মদত দিতো, এই মি. মিত্র।” সমুদার কথা শেষ হতেই মি. মিত্র সহ সোমনাথ ও বাকিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলো এবং আমরাও এরপর চললাম গল্পের শেষ স্থান অর্থাৎ বক্সীকাকুর বাড়ির দিকে।

রাস্তায় যেতে যেতে বাবা সমুদাকে জিজ্ঞেস করলো, “অতো ভোরে কোথায় গেছিলিস রে, সমু?” সমুদার হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর আমিই দিলাম, “বাবা, সমুদা কিছুদিন আগে আমায় যে বিপদের কথা বলেছিল, সেটা যে এটা, তা আমি এখন বুঝতে পারছি। সমুদা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিল এরকম বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সে সকাল হতেই সাহায্যের জন্য ছুটে গেছিল বিকাশদা ও পুলিশের কাছে, যাতে মি. মিত্র ও বক্সীকাকুর মতো দোষীরা খুব তাড়াতাড়ি আইনের হাতে ধরা পড়েন।”

আমার কথা শেষ হতেই বাবা বলে উঠলো, “সমু রে, তোর জন্য আজ গর্ব হচ্ছে।” সত্যি! সমুদার মতো লোক আছে বলেই এরকম দিনের পর দিন ঘটে চলা অপরাধ আইনের চোখে ধরা পড়ে।

এদিকে, কথার মাঝেই আমরা বক্সীকাকুর বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে উপস্থিত হলাম। আমাদের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে বক্সীকাকুর চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গেলো, বিশেষ করে সাভিও সাহেব ও সমুদার হাতে ওই ছবি দেখে। উনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, কী করলে উনি এই অবস্থা থেকে বেরোতে পারবেন।

সমুদা ওনার সম্মুখে গিয়ে বললো, “মি. বক্সী, দেখুন তো এটাই আপনার ওই ছবি কি না।” বক্সীকাকু তো হতবাক। ওনার গলা দিয়ে যেন তখন স্বর বের হচ্ছিল না। তবে, অরুণবাবু অদ্ভুতভাবে বলে উঠলেন, “না না! সমরেশবাবু, এটা আসল ছবি হতেই পারে না। বাবা গতকাল রাতেই আসল ছবিটা নিয়ে এসেছে। এখন সেই ছবি আগের জায়গাতেই রাখা রয়েছে।”

সমুদার কথামতো অরুণবাবু সেই ছবির প্রমাণ দিতে আমাদের সবাইকে ওই ঘরে নিয়ে গেলেন এবং ওই ঘরে গিয়ে দেখি ঠিক একই ধরনের আঁকা আরেকটি ছবি সেখানে রাখা রয়েছে। সমুদা বক্সীকাকুকে ওই ঘরে ডেকে পাঠাল। সেই সঙ্গে বললো, “আপনার এই ছবির গল্পটা এবার সবার সামনে আসার সময় হয়ে গেছে, মি. বক্সী। তাই সেই বিষয় এবার আপনি বলবেন নাকি আমি বলবো?” বক্সীকাকু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু অরুণবাবু তার বাবার অপমান হচ্ছে দেখে একটু রেগেই বললেন, “মি. দত্ত, আপনি আমার বাবাকে এইভাবে অপমান করছেন কেন জানতে পারি? কী করেছেন উনি যার জন্য ওনার মতো একজন ব্যক্তিকে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে অপমানিত হতে হচ্ছে?”

উত্তরে সমুদা বললো, “আপনি কিছুই জানেন না, অরুণবাবু। আপনার বাবা এই ছবিকে কেন্দ্র করে যে গল্প রটিয়েছেন সেটা আসলে একেবারেই মিথ্যে। তদন্ত করতে গিয়ে আমি জেনেছি, আপনার বাবার কথা অনুযায়ী যে ছবিটি ওনার প্রপিতামহ পেয়েছিলেন সেটি কখনোই নবাবের আসল ছবি ছিল না। কারণ একটাই, আমার হাতে যেই ছবিটি রয়েছে আর যেটা আপনি দেওয়ালে দেখছেন, দুটোর মধ্যে দিয়ে কেমন যেন একইরকম রঙের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝবেন, এই দুটো ছবিরই একই ভুল রয়েছে। আর সেটা হলো নবাবের দাড়ির কালো রঙ। ওটা কোনো প্রকারে ঘেঁটে গিয়েছিল বলেই, সেটা ঠিক করতে গিয়ে দাড়ির রঙ কিছুটা ভাগে বেশি গাঢ় হয়ে গেছে। এটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে দুটো ছবি একই ব্যক্তির দ্বারা আঁকা, না হলে একই ভুল দুজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর এই আঁকার কাজটি করেছেন আপনার বাবার পরম বন্ধু মি. মিত্র, যিনি এখন পুলিশের হেফাজতে।”

সমুদার কথা শুনে অরুণবাবু এবং তার স্ত্রী দুজনেই অবাক হয়ে গেলেন। তারপর সমুদা আরও জানালো, “আমার সন্দেহ হয় যখন মি. বক্সী ছবি হারানোকে কেন্দ্র করে প্রথমে এক গল্প বললেন, পরে সেটা ভুল প্রমাণ হতেই বানিয়ে ফেলেন আরেকটা গল্প। কিন্তু সেই গল্প ছিল খুবই আকর্ষণীয়। কারণ, উনি সুন্দরভাবে দুজন ব্যক্তির নাম মিলিয়ে এক ভুয়ো নাম তৈরি করে, ওনার পরিচয় দেন East India Company-র সেই সৈনিক হিসেবে। পরে ওই নাম দুটো থেকেই আমি আমার বন্ধুর সাহায্যে খুঁজে বার করলাম সেই আসল ব্যক্তিটির নাম, যিনি দাভিদ স্টারলিং। উনি সেই ছবি পেয়েছিলেন ঠিকই, তবে বর্তমান সময় সেটা ইংল্যান্ডে ওনার বড়ো ছেলে জোসেফ স্টারলিং-এর পরিবারের কাছেই রয়েছে। এই ছবির জন্য মিঃ বক্সী বৃদ্ধ সাভিও সাহেবকেও বহুবার বিরক্ত করেছেন। কারণ, উনি হলেন স্টারলিং সাহেবের বংশধর। সেই ছবির বিষয়ে ওনার থেকে কোনও খবর না পাওয়ায়, উনি মি. মিত্রকে দিয়ে আঁকিয়ে ফেললেন একইরকমের আরেকটি ছবি আর সেই থেকেই শুরু হলো ওনার এই লোক ঠকানোর ব্যবসা।”

এইসব শুনে অরুণবাবু খুবই ব্যথিত হলেন এবং তার মনে প্রশ্ন জাগলো। “আচ্ছা! ওই ছবি কি তাহলে একদিনের জন্যও আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য ছিল না?” না। সত্যিই ছিল না। বক্সীকাকু শুধু প্রতারকই ছিলেন না, উনি ছিলেন একজন অসফল বাবা যিনি নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলেকেও দিনের পর দিন ঠকিয়ে গেছেন।

অরুণবাবু নিজের দুঃখ চেপে রেখে সমুদার থেকে তার বাবার কুকীর্তির সম্বন্ধে আরও জানতে চাইলেন এবং সমুদাও তাকে বললো, “মি. বক্সী চেয়েছিলেন কলকাতায় কোনো বিদেশি পর্যটককে নবাবের একইরকমের ছবি মি. মিত্রকে দিয়ে আঁকিয়ে আসল বলে বিক্রি করবেন যাতে সেখান থেকে একটা মোটা অঙ্কের অর্থ লাভ করা যায় আর এটাই ছিল ওনার এবারের বহরমপুরে আসার অন্যতম এক কারণ। উনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে এই ছবি চুরি হওয়ার ঘটনাটা উনি ঘটাবেন যাতে মি. মিত্রকে সেই ছবি আঁকার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া যায়। আর সেই সঙ্গে উনি চেয়েছিলেন কোনও এক প্রাইভেট এজেন্সিকে এই ভুয়ো চুরির ঘটনার তদন্তের কাজে লাগিয়ে এই আসল ঘটনাটা সবার আড়ালেই রেখে দিতে। যার ফলে, নিজের স্বচ্ছতাও বজায় থাকবে আর ওনার কাজও হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু মি. বক্সী যখন দেখলেন আমি সব ঘটনাই প্রায় ধরে ফেলেছি, ঠিক তখনই মি. মিত্রর দ্বারা উনি তুলে নিয়ে গেলেন আমার দাদা, ভাইপো আর অবশ্যই সাভিও সাহেবকে। ওনারা ভেবেছিলেন বল প্রয়োগ করে বঙ্কুর থেকে আমার ব্যাপারে সব খবর পেয়ে যাবেন আর আমাকে শায়েস্তা করতে সফল হবেন। কিন্তু ওনাদের সেই পরিকল্পনা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হলো।”

সব শুনে অরুণবাবু নিজের বাবার ওপর খুবই রেগে গেলেন এবং ওই ছবি তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে এই দুষ্কর্মের কৈফিয়ত চাইলেন ওনার থেকে, “কেন এরকম করে আমাদের পরিবারের মাথা নিচু করলেন বাবা? কি লাভ হলো এতো মানুষকে ঠকিয়ে? এই কলঙ্ক নিয়ে আমরা বাঁচব কীভাবে বলতে পারো?” সব শুনেও বক্সীকাকুর মুখ থেকে কোনও কথাই বের হলো না। ওনাকে দেখে তখন সত্যি খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই ওনার এই কুকীর্তির কথা চিন্তা করলেই ওনার প্রতি রাগ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল।

এরই মধ্যে বক্সীকাকুর বাড়িতে পুলিশের ভ্যান এসে হাজির। অফিসার সমুদার থেকে পুরো বিষয়টা আগেই শুনেছিলেন। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে ওই ছবি সমেত বক্সীকাকুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলেন। ওনার ছেলে ও বউমা দুজনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। অরুণবাবু তো বলেই দিলেন, “আমি আর চাই না এরকম ব্যক্তি আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক। আজ থেকে তাই উনি আমাদের কাছে মৃত”।

হ্যাঁ, এটাই হয়তো সবচেয়ে বড়ো শাস্তি একজন বাবার কাছে যখন তার নিজের ছেলে সারাজীবনের জন্য তাকে পরিত্যাগ করে। আমার বাবা অরুণবাবুকে যেমন ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিলো, তেমনই তাদের পাশে থাকার আশ্বাসও দিলো।

এরপর সমুদা সাভিও সাহেব ও বিকাশদাকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের পাশে থাকার জন্য আবারও ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না। সবশেষে রয়ে যাওয়া ওই একটা ছবি সমুদা নিজের হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো, “এই ছবিটা ধর। তোর সাহসের পরিচয় দেওয়ার জন্য এটা আমার তরফ থেকে তোকে দেওয়া উপহার ভাবতে পারিস”। ছবিটা আসল না হওয়া সত্ত্বেও আমার কাছে এটার মূল্য ছিল অসীম। কারণ, এই ছবি হলো আমার সমুদার দেওয়া তার প্রথম কোনো বড়ো তদন্তের প্রধান এক অঙ্গ যেটাকে কেন্দ্র করে বিগত কিছুদিন ধরে গড়ে উঠেছিল নানান রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি এবং তা থেকে উঠে আসা প্রত্যেকটা বাধাকে উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে সফল হতে পেরেছিল গোয়েন্দা সমরেশ, আমার সমুদা।

আমরা অবশেষে গেস্ট হাউসে ফিরলাম এবং ঠিক করলাম পরদিনই কলকাতা ফিরব। কথামতোই পরের দিন দুপুরে খেয়ে আমরা স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রাস্তায় বাবা সমুদার কাছে তার এই রহস্যময় গল্পের শেষ ভাগটির বিষয়ে জানতে চাওয়ায় সমুদা বলল, “আমি আগেই বুঝে গেছিলাম, এই ছবিকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই লুকিয়ে রয়েছে। তবে, সাভিও সাহেবের সম্মুখীন হয়ে ওনার থেকে সব জানার পর ঠিক করি মি. বক্সীর ব্যবসার সম্বন্ধে জানতে হবে। সুতরাং ফোন করি কলকাতায় আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে যার দোকান ওই ধর্মতলাতেই এবং তার মাধ্যমেই জানতে পারলাম যে মি. বক্সীর দোকানে বিভিন্ন ছবি ও পুরনো ঐতিহাসিক জিনিসের বেচাকেনা হয়। সেখানে বিদেশি খরিদ্দারের সমাগমই বেশি। তারপর বাকিটা তোমাদের সবারই জানা। সেই প্রথমদিনের মি. মিত্রর ওই মিষ্টির প্যাকেট থেকে শুরু করে সোমনাথের চালচলন এবং মি. বক্সীর বানানো গল্প সবই ছিল আমার মাথায়। তাই সব তথ্যকে একসঙ্গে জুড়ে এই রহস্যের শেষ সমাধানটুকু আমি পেয়ে গেলাম।”

পুরো ঘটনা শুনে বাবা বলে উঠলো, “সমু, তুই সত্যি একজন গোয়েন্দা হয়ে উঠলি রে। তোর বুদ্ধির প্রশংসা না করে থাকতে পারলাম না। আমি কলকাতায় ফিরে তোর জন্য যথাযথ চেষ্টা করব যাতে তুই সরকারিভাবে একজন গোয়েন্দার স্বীকৃতি পাস।” কিন্তু সমুদা এতে নারাজ। সে চায় বইয়ে পড়া তার আদর্শ চরিত্রদের মতোই একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হয়ে থাকতে এবং সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এইরকম নানা অপরাধকে টেনে বের করে অপরাধীদের প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে, যাতে এই সমাজ হয়ে ওঠে বসবাসের পক্ষে এক সুস্থ স্থান।

আমরা স্টেশনে এসে পৌঁছালাম এবং তারপর ট্রেনে ফিরে এলাম আমাদের নিজেদের শহর কলকাতায়। বাড়ি ফিরে আমরা সকলেই নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার বারো ক্লাসের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল, বাবাও নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এখন সমুদার কথা বলতে গেলে বলতেই হবে তার নতুন পরিচয়ের কথা। তিনি এখন একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তার নামডাক সবে হতে শুরু করেছে।

এরপর বেশ কিছু মাস বাদে, একদিন হঠাৎ আমাদের বাড়ির ঠিকানায় সমুদার নামে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এসে হাজির। সমুদা ওই চিঠি খুলতেই অবাক হয়ে গেলো। সেই চিঠি এসেছিল পলাশীর বাসিন্দা ওরফে বক্সীকাকুর বাড়ির ঠিকানা থেকে। হ্যাঁ, চিঠিটা পাঠিয়েছিল অরুণবাবু, সমুদাকে ধন্যবাদ জানাতে। কারণ, তাদের চোখের সামনে যে মিথ্যের মায়াজাল তার বাবা দিনের পর দিন বুনে গিয়েছিলেন, সেটা সমুদাই একমাত্র পেরেছিল সরাতে। সেই চিঠি মারফত অরুণবাবু আরও জানায় যে তারা বহরমপুরের বাড়ি ও সেখানকার সব সম্পর্ক মিটিয়ে পলাশীর বাড়িতে ফিরে গিয়েছে। ওই চিঠির সঙ্গে সে বেশ কিছু টাকাও পাঠিয়েছিল সমুদার নামে। কারণ, তার বাবা অর্থাৎ বক্সীকাকু সমুদাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যদি সে ওই ছবি হারানোর তদন্তে সফল হয়, তাহলে সমুদাকে উনি কিছু টাকা পারিশ্রমিক হিসাবে দেবেন। সুতরাং ওই টাকা পাঠিয়ে নিজের বাবার দেওয়া সেই কথা অরুণবাবু রাখলো।

সমুদা পুরো টাকাটাই বাবার হাতে তুলে দিলো এবং সেই মুহূর্তে তার মুখে ছিল এক বহুমূল্য হাসি, যে হাসি বলে দিচ্ছিল টাকাটা পেয়ে সে কতটা খুশি। ওই টাকা হল সমুদার জীবনে তার প্রথম তদন্তের ফসল, যে তদন্ত দিয়ে শুরু হয়েছিল তার এই নতুন পথচলা একজন গোয়েন্দা হিসেবে। সুতরাং তার এই তদন্তকে খুব সহজেই বলা যায়, ‘সমু গোয়েন্দার হাতেখড়ি’।

(সমাপ্তি)

+ posts

Read Previous

কলঙ্কিনী রাধা – প্রথম পর্ব

Read Next

পাথুরে মাটির কিষাণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *