অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাহিদ সিরাজ -
কলঙ্কিনী রাধা – প্রথম পর্ব

কলঙ্কিনী রাধা
জাহিদ সিরাজ

সম্পূর্ণ গ্রন্থের সুচীপত্র-

অধ্যায়-১
পটভূমি
– যেখানে জীবনের যাত্রা
– গল্প সংকলন থেকে গবেষণা
– অধ্যায়গুলোর আগের কথা
– একটি অর্থহীন উত্থান হবেনাতো (!)

অধ্যায়-২
“জন্মই আমার আজন্ম পাপ”
– ভূমিকা
– পেছনের কথা
– নীরবতা
– প্রসারিত হলো না কারো দু’ হাত
– পছন্দের সীমাবদ্ধতা
– নির্যাতন
– সংস্কৃতিক সামাজিক বিষয়াদি
– পেশাজীবিদের অভিজ্ঞতা
– অপর্যাপ্ত পরামর্শ বা কাউন্সিলিং
– বিশেষ প্রক্রিয়াটি
– গর্ভপাত পরবর্তী সময়
-ফিরে দেখা সমাজ আবার

অধ্যায় -৩
-গল্পের মরালিটি ও গবেষণায় নৈতিকতা
-পেছনের কথা
-গর্ভপাত সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্নগুলো
-নৈতিকতার সীমানা নারীবাদী মতামত ও বাংলাদেশ
-প্রাচীন দর্শন এবং গর্ভপাত প্রাচীন দর্শন এবং গর্ভপাত নৈতিকতা কি ধর্মীয় রীতি ভিত্তিক: খ্রীস্টান, ইসলাম, হিন্দু
-সুতরাং এথিকস কি সাবজেক্টিভ, বৈশ্বিক নাকি আপেক্ষিক?

-গবেষণায় নৈতিকতা ফোকাস এবং উদ্দেশ্য
-ফলাফল এবং প্রয়োজনীয়তা
-গল্পগুলো সংগ্রহের কথা এবং সেগুলোর ব্যবস্থপনা: এথিককসের আলোকে
-গল্প সংগ্রহে ঝুঁকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা
-নৃবৈজ্ঞানিক নৈতিক নির্দেশনা তথ্য উন্মচনে, বলায়
-গল্প সংগ্রাহকদের ঝুঁকি এবং ব্যবস্থাপনা
-তথ্য মালিকানা ্ও প্রকাশ এবং ঈউঅ ’র নির্দেশনা

-উপসংহার: ঈউঅ ’র বিড়ালটা বেড়ায় বসে থাকে

অধ্যায়-৪
কলঙ্কিনী রাধা
-চিরস্থির দৃশ্যপট (?)
-কলঙ্কের সুত্রগুলো কে বানালো
-গর্ভপাত এবং চারপাশের দেশ
-গর্ভপাত এবং নারীদের ধারণা
-গর্ভপাত কলক আর সামাজিক ভাষা
-তিসকোর্য চিন্তাভাবনা সমাজ তেমুখের মডেল
-কাজ এবং টেক্সট ভিত্তিক মডেল; সামাজিক ইন্টারএকশনের মাঝে টেক্সট বা মায়েদের গল্পগুলো
দেখার পদ্ধতি
-একটি তুলনামূলক আলোকপাত
-প্রতিবাদ হিসাবে লিখা
-ক্যাথারসিস, অভিজ্ঞাতার সম্মিলন
-কলঙ্কিনী রাধা: মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার

অধ্যায় ৫

-মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহের গর্ভপাত আইন ঃ একটি ইসলামীক ডিসকোর্স বিশ্লেষণ এবং নীতিপ্রনয়ণ সম্ভাবনা

-আলোচনার সূত্রপাত
-মৌলিক উৎস কোরআন এবং সুন্নাহ সম্পর্কীত ব্যাখ্যা
-বিবেচ্য অন্যান্য বিষয়সমূহ
-সুফিবাদ এবং বৃহত্তর ইসলামী নীতি
-সুবিধাভোগী মহল এবং আবারো নারীবাদ
-বহুজাতিক ইসলামী সংস্থা/ডোনার
-মুসলিম প্রধান দেশসমূহে গর্ভপাত আইনের বহুমাত্রিকতা
-নীতি প্রনয়ণের জন্য সুপারিশ
-উপসংহার নয় মোটেই

অধ্যায় ৬
-আমি কুল হারা কলঙ্কিনী
-যাদের কথা এই বইয়ের রসদ
-মাহজাবিন : তুই তো বিপদজনক এক উত্তরাধিকারী শুধু
-জেনিফার : আমার আত্মার আত্মীয়টা কই
-চামেলী : কোথায় লুকালো নাছোড় যন্ত্রণা
-দাসিরা : আমি আর কত বড় হলে
-রায়না : আমার পালিত যন্ত্রণার খাঁচা

অধ্যায়-৭
-অদৃশ্য পালকের সম্ভার
-ব্যাখ্যার বদলে রাজপথের সোগান
– গবেষণার আয়নার আমার মুখচ্ছবি
-উন্মেচিত হোক শোকের মোড়ক
– ঈউঅ’র বিড়ালটা আর আমাদের দেখার জমিন
-আনওয়ান্টেড ‘গর্ভ’ বনাম আনওয়ান্টেড ‘গর্ভপাত’
– সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চাপের স্বীকৃতি
-বিস্রস্ত বর্ণে অজ্ঞাত বিষয়
– প্রদোষের আলোয় কিছু দ্রষ্টব্য
– পরিশিষ্ট

 

নোট- ৭টি অধ্যায়ে লিখিত প্রবন্ধ গ্রন্থটির প্রথম দু’টি অধ্যায়,

অর্থাৎ, অধ্যায়-১ ও অধ্যায়-২, ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে সঙ্কলিত করা হয়েছে।

কলঙ্কিনী রাধা, পর্ব-১ :-

অধ্যায়-১

– যেখানে জীবনের যাত্রা
– গল্প সংকলন থেকে গবেষণা
– অধ্যায়গুলোর আগের কথা
– একটি অর্থহীন উত্থান হবে না তো (!)

“আমার একমাত্র সম্পদ যন্ত্রণা
কাকে উৎসর্গ করতে পারি এই সম্পদ”
-কাইফ আজমী

যেখানে জীবনের যাত্রা-

কতোগুলো প্রশ্নের মাধ্যমেই বলা শুরু করি:
– এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখায় আগ্রহ হলো কেন?
– বিষয়টা কী আদৌ বাংলাদেশের সামাজিক কোনো সমস্যা বা ইস্যু?
– গর্ভপাত নিয়ে এর আগে আদৌ কি কোনো লেখা হয়েছে?
– কোনো প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কোনো গল্প বা উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি গর্ভপাত ছিল?
– যে শহরে আমার বেড়ে ওঠা, সেই শহরের অনেক ক্লিনিক, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, ডাক্তার, নার্স জড়িত আছেন, কেউ কি কোনোদিন এ বিষয় নিয়ে লেখার চিন্তা করছেন?
– নৃবিজ্ঞানের পড়াশুনা এ দেশে প্রায় তিরিশ বছর। আমার জ্ঞানমতে কেউ বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, কিংবা কেউ কি কোনো গবেষণা করেছেন?
– তাত্ত্বিকভাবে কিছু লেখা আছে; বাংলাদেশের বাইরে; সেগুলো এখনো গ্রাফিক, কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলাদেশ নয় কেন?

পৃথিবীর সব দেশেই গর্ভপাত একটি দৃশ্যমান সামাজিক বিষয়। মিশরীয়রা এর প্রথম আবিষ্কার করেন। পৃথিবীর অধিকাংশ নারীই নাকি গর্ভপাতের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু স্থান, কাল, সমাজ এবং সংস্কৃতির ভিন্নতায় গর্ভপাতের ফলাফল হয় ভিন্ন। গর্ভপাতের প্রভাব পড়ে পরিবারে, পরিবারের সদস্যদের উপর। এমনকি সেই মায়ের ভবিষ্যত জীবনের চলার পথেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিরাপদ গর্ভপাতের পরও মহিলাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়। প্রায় ২০ মিলিয়ন মায়েদের জীবনযাত্রা অনিরাপদ হয়ে পড়ে গর্ভপাতের ফলশ্রুতিতে। প্রায় ৭০ হাজার মা মারা যান এবং তাদের অধিকাংশই হলেন অনুন্নত বিশ্বের। এই ৭০ হাজারের অর্ধেক মারা যান বয়স ২৫-এর নিচে। মজার তথ্য হলো, বিশ্বের প্রায় ২৬ ভাগ মানুষ বাস করেন যেখানে গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ [বাংলাদেশ সহ], ৪২টি দেশের ডেটাবেস দেখে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি যে, গর্ভপাত স্টিগমা একটি বৈশ্বিক সামাজিক বিষয়।

বলাই বাহুল্য, এসব প্রশ্নের পেছনে অভিযোগী আমিও। এবং একই সাথে অভিযুক্ত। দেশের বাইরে প্রায় অর্ধযুগ। মাস্টারিতেও নেই। পেটের দায়ে লক্ষ্মীর সেবায় নিয়োজিত। তবুও অভ্যাসের দায় বা দোষে সরস্বতীর সেবা করি কালে-ভদ্রে। প্রথম যখন শাহজালালের অধ্যাপক সঞ্জয় বিশ্বাসের সাথে কথা বলি যে, গর্ভপাত নিয়ে কিছু কথা বা কেইস স্টাডি শুনতে চাই। সংগত কারণেই আসে বাজেটের কথা।

মেলবোর্নের একটা সংস্থা বললো তারা কিছুটা দিবে। যেটা দিয়ে বড়োজোর এক মাসের ফিল্ড ওয়ার্ক বা মায়েদের ইন্টারভিউ নেওয়া সম্ভব। কি আর করা, সঞ্জয় ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি খুবই অনুদার। সেই অনুদারের সুবাদেই বললো, ‘চিন্তা কইরেন না, দেখা যাক, আমিতো আছি।’ সঞ্জয়কে বললাম, ‘তাইলে চালাইয়া যা।‘ গবেষণার জন্যে তিনি তিনজন স্টুডেন্ট, সেই জোগাড় করলো। শুধু জানালো, ‘আপনার ‘র’ ডাটা আমি দিচ্ছি। বাদবাকি পরে হবে নে।‘ এই তো শুরু। কিন্তু সিলেট থেকে দুটো সংস্থা আমাদেরকে তথ্য দেয়নি। অন্য আরেকটি সংস্থা সাহায্য করে। এবং ঢাকা থেকে আরও একটি সংস্থাও।

প্রথাগত গবেষণা নয় বলে আমি প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তিন শিক্ষার্থী ঢাকা থেকে, আরও পাঁচজন শা.বি. থেকে, নৈতিক সমর্থন পেয়েছি সবারই। বিশেষত, Australian Development Dialogue -ADD-এর প্রতি। যেখানে আমি নিজেও গভীরভাবে যুক্ত। ইন্টারনেট থেকে সাড়া পাওয়া মায়েদের দেওয়া বিভিন্ন কবিতার লাইনগুলোই সংকলিত হয়েছে অধ্যায়ের প্রথমে। হয়তো কেউ আপন অনুভূতি জানিয়েছেন, বা নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিল পেয়েছেন বলেই কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। বিচিত্র, বিস্তৃত, হৃদয়ছোঁয়া সকল শব্দে বিম্বিত করেছেন মায়েরা তাঁদের গল্প। ফাহমিদা, সিলেট থেকে লিখেন। তাঁর কথা শেষ হলো কাইফ আজমীর সমস্বরে-

“আমার একমাত্র সম্পদ যন্ত্রণা।
কাকে উৎসর্গ করতে পারি এই সম্পত্তি?
আমি কোন জল্লাদকে দেখতে পাচ্ছি না
ফাঁসিমঞ্চের কাছে”

ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। খুব করুণভাবে এইসব মায়েদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নৃবিজ্ঞানে, নৃবিজ্ঞানের বাইরের লেখাতে, সাহিত্যে, গবেষণাপত্রে। ওসব গবেষণা পড়তে মনে হয় যেন, কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং সেটার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে গবেষণার দাতাদের জটিল সকল শর্তাবলি। যেহেতু আমাদের কাজে সেরকম কোনো দাতা নেই কিংবা শর্তাবলি নেই; সেহেতু আমরা স্বাধীনভাবেই কাজ করতে পেরেছি।

গল্প সংকলন থেকে গবেষণা-

প্রথমে আমাদের মূল প্ল্যান ছিল কেবল যেসব মায়েদের লাইফ হিসট্রি নিচ্ছি কেবল তাঁদের কথাগুলো সংকলিত করে প্রকাশ করা। কিন্তু গর্ভপাত নিয়ে পড়তে মূল আইডিয়া থেকে অনেক সরে আসতে হয়। বিস্তৃতিও বাড়ে। যেমন, গল্পগুলো লেখার, জানানোর এবং প্রকাশ করার নৈতিক দায় কেন আমি নিচ্ছি? বর্তমান দুনিয়ার নৈতিকতা বিষয় পণ্ডিত এবং ভাবুকেরা কী ভাবেন? এবং সর্বোপরি, গর্ভপাত বিষয়কে আমরা কি তথাকথিত ‘নৈতিক’ বা ‘এথিক্যাল’ বলছি? নৈতিকতা কী সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ভিত্তিতে বিচার করি বা করা হয়? এসব চিন্তা নিয়ে কথা বলছিলাম অধ্যাপক পিটার সিঙ্গারের এর সাথে। বর্তমান জমানায় ‘নৈতিকতা’ বিষয়ে যিনি প্রবাদতুল্য মানুষ। বললেন, ‘বাপু, শুধু যদি গল্পগুলো লিখে ছেড়ে দাও, তাহলে তো এটা কেবল একজন ইয়ার ইলেভেনের ছাত্রের কাজ হয়ে গেলো। এটার সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক অনেক বেশি। কয়েকটা বই হাতে ধরিয়ে বললেন, পরে কথা হবে।’ সপ্তাহখানেক পর ই-মেইলের বার্তা, ‘আসো, কফি খেতে খেতে কথা বলি।’

এবার বললেন, ‘নৈতিকতার প্রশ্নে তোমাকে আলাদা একটা চ্যাপ্টার করো’। ধরিয়ে দিলেন George Devereux এর বিখ্যাত বইটা ’আদিম সমাজে গর্ভপাত (A Study of Abortion in Primitive Societies)’. আদেশের সুরেই বললেন, ‘নৃবিজ্ঞানের চোখটাকে কাজে লাগাও।’ সুতরাং তৃতীয় আর চতুর্থ অধ্যায় মূলত পিটার সিঙ্গারের আদেশেই। অধ্যাপক পিটার সিঙ্গারের সাথে দেখা, তাঁরই এক সেমিনারে। এবার বললেন, ‘বাংলাতে লিখো, দেশের মানুষ আগে জানুক। সচেতনতা বাড়াবার জন্যে এর চেয়ে ভালো পথ নেই।’

পিটার সিঙ্গার সম্পর্কে একটু বলে নেই। প্রিন্সটন এবং মেলবোর্নে যিনি ‘লরেট’ অধ্যাপক। চল্লিশটা বইয়ের জনক, যেগুলো এথিক্স এবং দর্শনের পাঠ্য সারা পৃথিবীতে। টাইম ম্যাগাজিনে ২০০৫ সালে যাকে বলা হয়েছিল ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। ভীষণ বিনম্র এবং হাস্যময় মানুষটির সান্নিধ্য না পেলে হয়তো বইটা কেবল গল্প সংকলনই হতে পারতো। আমার কাজ এগুচ্ছে শুনে ই-মেইলে বললেন, ‘তোমার বইটা মীডের “কামিং এজ অফ সামোয়ার” মতো হোক। সাহিত্য এবং নৃতত্ত্বের এক যুগপৎ যাত্রা। ক্লাসে এবং ক্যাফেতে।’ আমি মুগ্ধ। বিমোহিত।

পিটার সিঙ্গার, আপনি দীর্ঘজীবী হোন।

অধ্যায়গুলোর আগের কথা-

সুতরাং অধ্যায়গুলো সাজাতে হলো একটা ধারাবাহিকতা মেনে। ভূমিকায় দ্বিতীয় অধ্যায়। পুরো বইয়ের একটা ধারণা পাওয়া যায়। এখানে রিফ্লেক্ট করেছে সেইসব মায়েদের কথা যারা অনলাইনে আর ইন্টারভিউতে রেসপন্স করেছেন। এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো এসেছে কিছুটা। স্থানাভাব এবং গল্পের পুনরাবৃত্তির জন্যে অনলাইনে দেওয়া গল্পের সবগুলো কিংবা কোনোটাই পুরোপুরি তুলে দিলাম না।

তৃতীয় ভাগে ‘গল্পের মোরালিটি এবং গবেষণার নৈতিকতা।’ আমার বিচারে এটিই এই বইয়ের মূল অংশ হতে পারতো যদি এথিক্সের বিষয়টা একমাত্র বিষয় হতো। নৈতিকতার আলোচনায় আমরা সকলেই পূর্ণ দায়বধ্যতা রেখেছি লেখায়, বলায়। এমনকি তাঁদের কাছে যাবার প্রক্রিয়াতেও থেকেছি স্বচ্ছ এবং মেনেছি প্রতিষ্ঠিত নিয়মনীতি। এথিকস-এর সর্বশেষ সংযোজন হলো, কোনো গবেষণা বা লেখার মূল উত্তরদাতাদের কাছে চুড়ান্ত লেখা বা সংকলনের একটা কপি পড়তে দেওয়া। যাঁরা পড়তে অক্ষম তাঁদেরকে পড়ে শোনানো, তাদেরই মাতৃভাষায়, প্রয়োজনে অনুবাদ করে হলেও। নৈতিকতার এই চুড়ান্ত নীতি আমরা যত্ন নিয়েই পালন করেছি। তাঁদের মতামতও আমরা গ্রহণ করছি গুরুত্ব দিয়ে। তাঁদের অংশগ্রহণটাও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

চতুর্থ অংশে আলোচিত হচ্ছে, বাংলাদেশের সমাজ কিভাবে গর্ভপাত করানো মায়েদের দেখে, কেনোইবা মায়েরা বলছেন কলঙ্কিনী বা স্টিগমাটাইজড। মনস্তাত্তিক ট্রমা বা আঘাত থেকে জন্ম হচ্ছে স্টিগমার। আর এই স্টিগমার শিকড় পুঁতে রাখা আছে আমাদের মাঝে। আমরা মানে আপনিও। মায়েরা। ডাক্তার, নার্স, ম্যানেজার, আয়া, বুয়া, বাবা, মা, স্বামী, সঙ্গী, আমরা প্রত্যেকেই হয়ে যাই এই সামাজিক সিস্টেম বা নিয়মের কর্মঠ এজেন্ট। যেমনটি বলছেন, মিশেল ফুঁকো। ব্যক্তিক চরিত্রটি নির্ধারিত হয়ে যায় বড়ো চালিকাশক্তি দ্বারা। যেমন, মেডিকেল সিস্টেম, অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো। অন্যদিকে, এইসব বাধা উপেক্ষা করেও মায়েরা গর্ভপাত করাচ্ছেন।

এখানে দুটো বিপরীত ধারা উঠে আসে। যেমন, বাংলাদেশে গর্ভপাত করানো আইনত নিষিদ্ধ। তবু গর্ভপাত করানো হচ্ছে, কলঙ্কিনী হবার ভয়ে। সমাজের ও স্বজনের । মাঝে একটু ফাঁকা জায়গা আছে। আবার, গর্ভপাত করানোর প্রক্রিয়ায় কিংবা একজন মাকে রাজি করানো থেকে পুরো প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত একজন মায়ের সিদ্ধান্ত নেবার জায়গাটা খুব বেশি নেই। এবং শারীরিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবার পরও থেকে যায় কলঙ্কের তিলক চিহ্ন। যেখানে আমরা দেখি, তাদের স্টিগমাটা থেকেই যায়। গর্ভপাত করানোর আগে, বিশেষত, অবিবাহিতদের বেলাতে যে স্টিগমা, গর্ভপাতের পর সে একই স্টিগমা আসে সমাজ থেকে। যদিও এটা অদৃশ্যমান। এবং এখানেই আমরা আরভিং গফম্যানকে স্মরণ করি, যাকে মাস্টার অব কনটেক্সুয়ালাইজেশন বলা হয়। কিভাবে একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটের জন্য মায়েদের উপর কলঙ্ক চিহ্ন সমাজ থেকে আরোপিত হয়। একই সাথে আমরা দেখার চেষ্টা করবো ডিসকোর্স এনালাইসিস-এর মাধ্যমে। কিভাবে শক্তিশালী শব্দসমূহ থেকে অবদমন তৈরি হয়। এই বইয়ে আমরা দেখবো, মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে ইসলাম কী বলছে। একই সমান্তরালে হিন্দু ধর্মমতও দেখার চেষ্টা করেছি।

“আমি কুল হারা কলঙ্কিনী”- অমরত্ব পাওয়া শাহ আব্দুল করিমের এ চরণ উল্লেখ করেছেন ১৩১জন মা। শব্দান্তে, বাক্যে, কথায়, কোনো না কোনোভাবে উঠে এসেছে মায়েদের নিজেদের মুখে তাঁরা (স্টিগমাটাইজ) কলঙ্কিনী । তাঁদের গল্পগুলো এই অধ্যায়েই সংকলিত। এবং এই শিরোনামে। একজন মা উল্লেখ করেছেন খাজা ফরিদকে। মুলতানি ভাষার এ গীতল কবির কাছেই আশ্রয় পেয়েছেন একজন মা। সিলেট অঞ্চলের অনেক মা-ই সান্ত্বনা খুঁজেছিলেন বাংলাদেশের গীতল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের মাঝে।

পঞ্চম অধ্যায়টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে। আমাদের কাজে যেসব মায়েরা অংশগ্রহণ করেন, তারা সবাই বাংলাদেশের। প্রায় সবাই মুসলমান। সুতরাং, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার এইসব মায়েদের গল্পে, অভিজ্ঞতায় আমরা দেখছি একটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ধর্ম। এমনকি Critical Discourse Analysis-CDA যারা আমরা ফলো করি, সেখানে মায়েদের একশন, কাজ, আচার-আচরণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এবং এগুলো নিয়ে ভাবতে আমরা ইসলামিক ডিসকোর্সগুলো খুঁজতে থাকি। কেবলই পবিত্র কোরান বা মহানবী (স.) এর হাদিস নয়, বিশেষজ্ঞরাও অনেক মতামত দিয়েছেন। যা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনার সূত্রপাত করে থেমে যাই। মনে হলো, আলাদা একটি অধ্যায় আমাদেরকে লিখতেই হবে। কারণ, এতো বেশি সেকেন্ডারি ডেটা যে, ওখান থেকে এক অনুচ্ছেদে বা পৃষ্ঠায় লিখে পরিষ্কার কোনো ধারণা দেওয়া যাবে না। গর্ভপাত সংক্রান্ত ইসলামিক ডিসকোর্স নিয়ে আমাদের পঞ্চম অধ্যায় সঞ্চারণশীল হয়, আরও সংবেদনশীল। গর্ভপাত নিয়ে বিতর্ক বর্তমান মুসলিম দুনিয়াতে দ্রষ্টাব্য।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে যে সব মায়েদের কথা উঠে এসেছে তাঁরা প্রত্যেকেই সরাসরি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সময় দিয়েছেন। এবং তাঁদেরকে এই বইয়ের মূল পান্ডুলিপির কপি পড়তে দেওয়া হয়। তাঁদের মতামত গুরত্ব সহকারে মূল্যায়িত হয়েছে। আমাদের সযত্ন চেষ্টা ছিল গল্পগুলো অবিকৃত রাখার। এবং আমরা পেরেছি। মায়েরা যখন এই অধ্যায় পড়েছেন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, আবেগে কেঁদেছেন কেউ কেউ। এবং আমরা মনে করছি আমরা স্বার্থক লেখাতে, বলাতে। তাঁদের না শোনা, না বলা কথাগুলো সবাইকে জানাতে। অন্যকথায়, এ অধ্যায় হলো এই বইয়ের মূল স্তম্ভ। বাদবাকি অধ্যায়গুলো সাজানো হয়েছে এ অধ্যায়কে কেন্দ্র করে।

‘অদৃশ্য পালকের সম্ভার’- আমাদের সমাপ্তি অধ্যায়। পরবর্তী অনুসন্ধানী মন খুঁজে নেবেন অদৃশ্য পালকগুলো। কোনো নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, উন্নয়নকর্মী বা সমাজকর্মী কিংবা কোনো সাহিত্যিক, সাংবাদিক। আমাদের সীমিত সময়, টাকা-পয়সা, শ্রম দিয়ে এই পর্যন্ত রেখে গেলাম। হয়তো কোনো নতুন জানালা। পর্দার ও পাশে আরও কিছু কেউ না কেউ খুঁজতে আগ্রহী হবেন। নিকট বা দূর ভবিষ্যতে।

আমরা এখানে একই সমান্তরালে শ্রোতা এবং বক্তা। কোনো সক্রিয় কথকের পক্ষে স্থির হয়ে থাকা সম্ভব নয় মনে করেই আমরা ভাবছি আরও কেউ আসবেন আমাদের কথাকে এগিয়ে নিতে।

একটি অর্থহীন উত্থান হবে না তো!

তর্ক-বিতর্ক যা আসবে তা আমরা এড়িয়ে যাবো না। নৈতিকতার মানদণ্ড আমাদের হাতে নেই বিধায় আমরা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের কাজ জানালার খিড়কিগুলো খুলে দেওয়া এবং আমরা তাই করছি। এবং আবারও আমরা সবিনয়ে জানাই যে, অনুরুদ্ধ বা আদিষ্ট হয়ে নয়, স্বতঃসিদ্ধ অনুপ্রেরণা থেকেই কাজটাতে হাত দেওয়া, এবং শেষ করা। বইটি আত্ম-উন্মোচনের, মায়েদের আর্তির, মায়েদের অব্যক্ত মনাবিষ্কারের।

গবেষণার সহকারিদের বিদগ্ধ মনের পরিচয় পেয়েছি। সহজ-সরল ভাষায়, গুঢ় দৃষ্টি, আলাদা আলাদা উপাখ্যানের বর্ণনা, মনের মতো করে কানে কানে বলার মতো নরম আর স্পষ্ট শব্দ চয়ন, এবং আত্মপ্রত্যয়ী, বিজ্ঞতার পরিপূর্ণ প্রকাশ আমি দেখেছি। সকলের, বিশেষ করে অধ্যাপক সঞ্জয়ের আন্তরিক উচ্চারণ, মূল্যায়ন এবং বান্ধব ইমেজের প্রতিফলন ছিল বলেই এতোটা নিয়ে আসতে পারা। বইটি কোনো সৌখিন সৌন্দর্যতত্ত্ব প্রয়াসী নয়। বরং দুঃখ বেদনাকে পরিপূর্ণভাবে দেখার চেষ্টা। অনন্ত দুঃখের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদেরকে লিখে যেতে হচ্ছে। বইটার পাতায় উঠে আসে দুঃখধ্বনি। বইটার দশদিক আন্দোলিত হয় প্রাণের লুকায়িত মানবতার আকুল আততি।

গল্পগুলো দেশজ। আঞ্চলিক। ভৌগলিকতার হিসাবে ছোট্ট একটি অঞ্চলের। কিন্তু, পরতে পরতে প্রতিধ্বনিত হয় নির্দয় বিচ্ছেদের। বাংলার মা-সন্তানের নাড়ি ছেঁড়ার কথা হয়তোবা হিমালয়, আল্পস পেরিয়ে একাকার হয়ে যাবে অন্য মায়েদের সাথে। স্থানীয় বাংলার গল্পগুলো হয়ে যাবে মরুচ্চারী, যাযাবর, নিশাচর। প্যাস্টোরাল, পৃথিবীর পথে পথে। সহজ-সরল গল্পগুলোর গতরে তীব্র শোক মাখানো। সহজিয়া বাংলা বর্ণগুলো যেন একেকটা গ্রানাইটে খোদাই করা যন্ত্রণার ভাস্কর্য। বিষাক্ত নীল। সমাজ আর সংস্কৃতির পরিহাসপূর্ণ চোখ লেগে আছে অক্ষরগুলোর সর্বাঙ্গে। সাহিত্য আর নৃতত্ত্বে ও ঐতিহ্যে প্রসারিত সংকলনটিতে তাই আমরা তথাকথিত ডেটা বা মূল তথ্যকে তত্ত্বের সাথে একাকার হয়ে যেতে দিচ্ছি না। ফলেই স্পষ্ট হয়ে উঠে গভীর মমতার গল্প। বিদ্যালয়ী ছোঁয়া থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মায়েদের আর্তের মধ্যে আমি ‘আত্মারর’ এনিগমা শুনেছি, গর্ভপাতের মাধ্যমে ডাক্তার সাহেবরা আসলেই কি কিছু কোষপিন্ড সরাচ্ছেন, নাকি একটি স্বাধীন, সরব, স্বতন্ত্র জীবনটাকেই মুছে দিচ্ছেন আজীবনের জন্যে?

পরবর্তী কেউ লিখবেন; রাজনৈতিক ভোটের হিসাবের বাইরে যেয়ে কথা বলবেন; পুঁজিপতিরা তাদের ব্যবসার লাভালাভকে একপাশে রেখে মানবিক আর নৈতিক হয়ে উঠবেন- এমন আশা আমরা করি। মনে করি, এটার জন্যে কেবল নৃবিজ্ঞান নয় অন্যান্য ডিসিপ্লিন থেকেও আসবেন বিজ্ঞ অধ্যপকেরা; কথা বলবেন প্রাণ খুলে, দাতাদের শর্তাবলির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে । কিন্তু, নীতিমালা তৈরির আগে যে প্রশ্নটির সমাধান হওয়া উচিত ফার্টিলাইজেশনের ১৪ দিনের বা ৭ দিনের মধ্যেই ভ্রুণটিকে আমরা একজন মানব শিশু বলবো নাকি আরও পরে; ৪০ দিন কিংবা ১২০ দিন? একটি মানবসত্তা হিসেবে কোন সময় থেকে হিসাব করবো?

এ প্রশ্নের উত্তরেই আমরা সমাধান পাবো; একটি পলিসি তৈরি করার কিংবা একটি জাতীয় নীতিমালার। তবুও উপসংহারে, ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে রেখেছি যেটার ‘সম্পূর্ণ’ দায় আমার। আপনারা আরও লিখুন, জানান, গবেষণা করুন, আমি কেবলই পালকটাকে দেখিয়ে দিলাম বা আলতো ছুঁয়ে দিলাম। আমার বিশ্বাস, আপনারাও এগিয়ে আসলে এটি একটি অর্থহীন উত্থান হবে না।

শাহ মো. এমরান হোসেন জুমন, মো. রাজেদ আহমদ, প্রুফ দেখার চরম বিরক্তিপূর্ণ কাজটি করেছে। ছাত্র সালাউদ্দিন মল্লিক, এফ.আই. ভি.ডি.বি ব্যস্ততার মধ্যদিয়েও তাঁর সময় দিয়েছে, কম্পিউটার দিয়েছে। এবং বিশেষত, ৫ম অধ্যায় ছিল মূলত ইংরেজিতে, সে রাত জেগে মাতৃভাষায় তর্জমা করেছে। লম্বা এই মানুষটিকে ধন্যবাদ আমার মতো বাইট্টা করলাম না। ধন্যবাদের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এই নামগুলোর ঋণ শোধবার নয়। শোধ করতাম সামর্থ থাকলে। হা হা, ভগ্নিপতি পারভেজ মাছের সাপ্লাই আর ভেনু দিয়ে বেহুফাই কৃতজ্ঞ করে রাখলো।

অধ্যায়-২

– ভূমিকা
– পেছনের কথা
– নীরবতা
– প্রসারিত হলো না কারো দুহাত
– পছন্দের সীমাবদ্ধতা
– নির্যাতন
– সংস্কৃতিক-সামাজিক বিষয়াদি
– পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা
– অপর্যাপ্ত পরামর্শ বা কাউন্সিলিং
– বিশেষ প্রক্রিয়াটি
– গর্ভপাত পরবর্তী সময়
ফিরে দেখা সমাজ আবার

“Painful events need pain reliving expression” – Collected

  “সব দুঃখমাখা শব্দগুলো আরেকবার জন্ম নেয়, যদি তুমি শব্দগুলো গল্পে রূপদান
    করো কিংবা এ দুঃখমাখা শব্দগুলো নিয়ে গল্প লেখো।”

                                                                                         –আইজ্যাক ড্যানিসন

ভূমিকা-

গল্পগুলো সত্যি। বাস্তব। ধ্রুব। রুঢ় এবং হৃদয়ছোঁয়া। গল্পগুলো শোকগাথার মতো শানানো । শাশ্বত প্রত্যেক মায়েদের কাছে। বইটি তাঁদের সম্পর্কে যারা জন্ম মুহুর্তের আগেই নিয়েছিল মৃত্যুর স্বাদ। পৃথিবীর আলো যাদের চোখে লাগার আগেই মৃত্যুর কালো হাত ঢেকে দিয়েছিল দুই চোখ। যাদের কবর রচিত হয়েছে মায়েদের উদরেই। যাদের শোকগাথা লেখা আছে মায়েদের অন্তরে। এই গল্প তাদের নিয়েই। সামাজিক এবং পারিবারিক কারণেই কেবলই নামগুলো পালটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের মৌখিক এবং লিখিত বিবরণ হুবহু তুলে ধরেছি। বিস্তৃত এবং ব্যাখ্যাত। নৃবিজ্ঞানের চোখে গল্পগুলোকে, কথামালাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু চোখ ছিল যাতে মৌলিক গল্প এবং বিষয়টি তত্ত্বের জার্গনে মিলিয়ে না যায়। সাধারণের পড়ার লক্ষ্যটা অবিচ্যুত রাখার যত্ন ছিল সর্বোপরি। শব্দ চয়নে কিছু ইংরেজি শব্দ বাংলা হরফে লিখার কারণ দুটো- প্রতিদিনকার ব্যবহারে আমরা এগুলোতে অভ্যস্থ আর ভাষার ব্যাপ্তি। গর্ভপাত বিষয়টি যেমন স্পর্শকাতর তেমনি এটিকে সামাজিকভাবে একটু ‘অন্যভাবে’ দেখা হয়। যারা কাজ করেছেন তারা মায়েদের প্রাইভেসি বিষয়টা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সময় সর্তক থাকতে হয়েছে যাতে মূল বক্তব্য যেন কোনো অবস্থাতেই বিচ্যুত না হয়।

যদিও একদল নৃবিজ্ঞানীর পরিশ্রমের ফসল, তথাপি এই সংকলনে সাহিত্যের দুইটি ধারা আমরা গ্রহণ করেছি। প্রথমটা হলো- “Writing as Resistance”১০ এই ধারাতে আমাদের লেখাতে তাঁদের কণ্ঠস্বর ধারণ করা হয়, যাদের বক্তব্য এর আগে কোথাও আসেনি। এবং এই গল্পগুলো কেউ লেখেনি বা বলেনি। কিংবা এই গল্পগাথাগুলো সচেতন বা অচেতনভাবে সাপ্রেসড ছিল। বায়ো-এথিক্স নিয়ে যেসব সাহিত্যিক বা নারীবাদী বা নৃবিজ্ঞনীরা কাজ করেন তারা এই সাহিত্যের ধারাকে অনুসরণ করেন। দ্বিতীয় ধারাটি এরিস্টটল যুগ থেকেই সাহিত্যে অনুকরণীয়, এবং বহুল ব্যবহৃত। যিনি লিখেন “Catharsis of emotions expressed in tragedy” (Poetics, 6). উল্লেখ্য, Catharsis মানে হলো- Purifications of emotions by vicarious experiences. মানে এখানে গল্পগুলো, কষ্টগুলো বলার মধ্য দিয়ে মায়েরা কষ্টের নিস্কৃতি পান। সামান্যতম হলেও এক ধরনের ক্লিনজিং কাজ করে তাদের অভিজ্ঞতার, কষ্ট এবং বেদনার। না বলা বক্তব্যের, না শোনা স্বপ্নের।

আবার সাহিত্যেও এই ধারায় দেখা যায়, Cathrsis-এর আলোকে মায়েরা বুঝতে পারেন তিনি একা নন। তাঁর কষ্টের সারথি আছেন আর অনেক মায়েরা। তাই সাহিত্যের এই দু-ধারার বিবেচনায় গল্পগুলো হয়ে উঠে এক ধরনের প্রতিবাদ। সমাজ, সামাজিকতা, কালচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একদল মায়ের লেখার এবং বলার প্রতিবাদ। একই সাথে গল্পগুলো এখানে ক্যাথারিক- যেসব মায়েরা বলেছেন তাদের জন্যে। আবার তাদের জন্যে যারা গর্ভপাতের পরে বা আগে কোনো না কোনোভাবে কষ্ট পেয়েছেন। নৃবিজ্ঞানের চোখে বিষয়টিকে আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, এখানে কিভাবে একজন মা তাঁর জীবনের এই পর্যায়কে ড্রামাটারজিকালি দেখেন। কিভাবে একজন মা অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করে, এই প্রেক্ষিত বিবেচনায় আমরা ভেবেছি কনটেক্সচুয়ালাইজেশনের গুরু আরভিং গফম্যানকে।

গর্ভপাতের পরে বা আগে একজন মায়ের নিজস্ব পরিসরে, পরিবারে, পরিবারের বাইরে, রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, কর্মস্থলে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। তাঁর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেছি বিশেষ যত্ন সহকারে। আবার এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল ‘পাবলিক’ এবং ‘প্রাইভেট’ ডাইকোটমির বিবেচনা, দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত। অবশ্যই ১৯৬০ সালের দেওয়া পাবলিক-প্রাইভেট এবং ধারণা ২০১৬ সালে এসে খুবই সংগত নয়। তবু বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখানে বিবেচ্য। অন্তত, একজন মায়ের মানসিক গড়ন বিকাশে। মায়ের বাল্যবেলা থেকে কৈশোর পেরিয়ে মা হয়ে ওঠার সময়কালের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, পরিবার এবং সমাজ থেকে নেওয়া ‘বোধ’ কোনোক্রমেই বাদ দেওয়ার বিষয় নয়। আমরা এখানে দেখেছি মায়ের সমাজ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবেচনা। একজন মা হয়ে ওঠার পরও সমাজ এবং আশেপাশের চিন্তা কিভাবে তাঁকে ভাবিয়েছে। কেমন করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- যা কেবলই তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নয় বরং এই সমাজের মূল্যবোধ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও এখানে আমরা দেখার চেষ্টা করেছি।

সামাজিক নিরাপত্তার মানেই আর্থিক নির্ভরশীলতা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের বন্দোবস্ত একটা জরুরি বিষয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এরকম একটা স্পর্শকাতর বিষয়কে নিয়ে আগ্রহ দেখালাম। বাংলাদেশে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে খোঁজ করে দেখলাম এখন অব্দি কোনো শিক্ষক বা গবেষক এ বিষয়ে কোনো গবেষণা করেননি। আমি নিজেও যে শাহজালালে মাস্টারি করতাম, সেখানেও হয়নি। অন্তত, ২০১৫ সাল অব্দি। সরকারি পর্যায়ে কোনো পলিসি আছে কিনা নজরে পড়েনি। সাংবাদিক, সাহিত্যিকেরা বিষয়টিকে আমার ধারণা অপাঙ্ত্তেয় মনে করেই রেখে দিয়েছেন। ‘পরিবারের লজ্জা’ ‘নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা’ ‘পাড়ার প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানো’ ইত্যাদি ভাবনায় তারা কথা বলেননি কারও কাছে। নিজের ভিতরেই গল্পের কথাগুলো কেঁদেছে নীরবে।

আপন সন্তান হারানোয় বিনিদ্র রাত পার করেছেন এইসব মায়েরা। প্রতীক্ষার রাতগুলো হয়েছে কেবলই দীর্ঘতর। কষ্ট লাঘবের জন্যে তাঁরা কোনো মনস্তাত্তিকের কাছেও যাননি, যদি কেউ গিয়েও থাকেন, ‘মানসিক রোগী’ আখ্যা পেয়েছেন। এন্টি ডিপ্রেসিভ কোনো ঔষধও নেননি বেশি কেউ। কেউ বা মনে করেন এ গল্প আর কষ্টগুলো তো একান্তই নিজের। কাকেই-বা বলবেন। কিভাবেই বা বলবেন। কোনো কোনো আখ্যানে কষ্ট ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে লজ্জার। কোথাও বা লজ্জা ছাড়িয়েও পরিবারের প্রতি আনুগত্যের আশ্বাস। তবু এগুলো যেন লাল নীল কষ্টের বিষাদ মাখা বাক্যের সমন্বয়। কেবলই বিষাদ সিন্ধু। এখানে আমরা কজন মায়ের গল্পের মালা গেঁথেছি। আমাদের সরাসরি সাক্ষাতকারে যাদেরকে পেয়েছি। কিন্তু অনলাইনে এসেছে দুইশত মায়ের কথা। বয়স, ধর্ম, পেশা ছাড়িয়ে বলা গল্পগুলো প্রত্যেকটি হতে পারতো এই বইয়ের একেকটি অধ্যায়। স্থান আর অর্থের অভাবে এটা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না।

নাম আমরা কাল্পনিক ব্যবহার করেছি। কিন্তু, বাদবাকি সবই থেকেছে একই রকম। ব্যাখ্যার অংশটুকু আলাদা করিনি। এবং আগেই বলেছি এটা ‘প্রথাগত’ কোনো গবেষণা নয়।

বাংলাদেশের মায়েরা জানুক। মানুষেরা জানুক। সমাজ বিশে-ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা জানুক। তাবৎ নীতি নির্ধারকেরা জানুক। এবং উন্নয়ন কর্মীরাও। আর আমরা ভেবেছি এই লেখাই আমাদের প্রতিবাদ। এই গল্প বলাই আমাদের ক্যাথারিক প্লাটফর্ম। অনলাইনে যাঁরা আমাকে লিখেছেন তাঁদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কোনো দুঃখ প্রকাশ নয়- বরং আমি রীতিমতো সমব্যাথি। আমি প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করলেও আমি সবার আগে মানুষ । এবং মানুষ হিসেবেই আপনাদের মতো বিশজনের গল্প এখানে দিয়েছি। অনলাইনে যারাই লিখেছেন আমি সবার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। এখানে কিছু বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে দিলাম-

কল্যাণী: অনেক অনুভূতি, অনেক কষ্ট। বুকের ভিতরে সব যেন সিলগালা দিয়ে রাখা। আজ জানলাম এবং বুঝলাম আমি একা নই। এই কষ্টের প্লাটফর্মে আমার মতো আরও অনেকেই। এই গল্প বলার মধ্য দিয়ে একটু হলেও আমি মুক্ত হতে পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ আমার মতো মেয়ের কথা আপনি শুনলেন। আমি সেই মহিলা, যে মনে করেছিল আমিই একা। এই পৃথিবী আমার কষ্ট শুনবে না, বুঝবে না আমার ব্যক্তিগত হতাশা- যা রচিত হয়েছিল আমার সর্বনাশা গর্ভপাতের পর।

আনিতা: আপনারা বই লিখুন, এবং দয়া করে সত্য কথা লিখুন, লিখুন কষ্ট আর বেদনা সম্পর্কে। ছিন্ন ভিন্ন জীবন সম্পর্কে। গর্ভপাত হলো মনের গহীনে এক খোলা গর্হিত রক্তাক্ত ক্ষত।

ঝিনুক: আমি চাই আপনি জানুন, এবং সবাইকে জানান যে আমি এতোটাই অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন ছিলাম যে, দুই দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি। আমি নিজেকেই ঘৃণা করতে শিখেছিলাম গর্ভপাতের পর। কিন্তু, বিয়ের পর আমার স্বামীকে বলেছিলাম এবং তিনিই আমাকে মানসিক আশ্রয় আর সান্ত্বনা দিয়ে দ্বিতীয়বার জীবন দিলেন।

আইরিন: গর্ভপাত করানোর পর আজ অবধি আমার মনে হতো আমি বুঝি কোনোদিন কাউকে আমার মনের কথাগুলো বলতে পারতাম না।

জেনি: আমার আজকের জটিল মনস্তত্ত বলার সুযোগ দেওয়ায় তোমাকে ধন্যবাদ। আমার পঞ্চাশ বছর বয়সের জীবনে আমি আর কোনো পুরুষ মানুষের সাথে ঘর করতে পারিনি। গত পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম কেউ একজন আমার গল্প, বেদনা শুনতে চাইলো, বুঝতে চাইলো। যে আমার ‘একদা’ স্বামীর মতো। বললো না, ‘যাও হাসপাতালে গিয়ে পরিষ্কার করে আসো’। মনে হলো নাক থেকে সর্দি ঝাড়ার মতো ব্যাপার।

লিয়ন: আমার মনে হয়েছে এটাই আমার থেরাপি, যে আমি এতোদিন কষ্ট পাচ্ছিলাম কাউকে না বলতে পারার জন্যে; আজ মনে হলো আমি মুক্তভাবে কথা বলতে যাচ্ছি। সতের বছর একা একাই কষ্ট পাচ্ছিলাম।

এই ছয়টি বাক্যসকল ২২০ আখ্যানকে প্রতিনিধিত্ব করছে না সত্য। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একটি উল্লেখযোগ্য দিককে রিফ্লেক্ট করছে। আর তা হলো, না বলা কষ্টের আখ্যান। বইটি সেইসব শিশুদের যারা পৃথিবীতে নাই। বইটি তাদের মায়ের কষ্ট-গাথা। বুকের ভিতরে লেখা এক একটি এপিটাফ। গর্ভপাতের পূর্বাপর কষ্ট নিয়েই রচিত এই উপাখ্যান। যে কষ্টের এবং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা গেছেন সেটি প্রায় প্রত্যেকের জীবনে প্রথমবারের মতোন। কষ্টগুলো শুধুই থেকে গেছে। না জানা, না শুনা এবং না বলা। গর্ভপাতের পর তাদের আবেগের উপর যে আঘাত বা ট্রমা এসেছিল; সেটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতোন থেকে গেছে। গর্ভপাতের ঘটনা তাদের কাছে হয়ে আছে এক গহীন রক্তক্ষয়ী ক্ষতের মতো। স্মৃতি সেই ক্ষতের উপর শুধুই আঁচড় দিয়ে যায় রাত-দিন-সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। কেউ আগ্রহ নিয়ে শুনতে আসেননি। এবং তাঁরাও স্বেচ্ছায় বলতে যাননি। আমাদের উন্নয়নকর্মীরাও চিন্তা করেননি এই সব মায়েদের মানসিক যন্ত্রণাকে উপশম করার জন্যে কাজ করা যেতে পারে। সরকারি নীতিমালাতেও এটা নেই। একাডেমিক পরিবেশে হয়তো কাজ করার জায়গা ছিল। কিন্তু যেহেতু বাজারে এটার চাহিদা নেই সেহেতু মনে হয় কেউ আর পণ্ডশ্রম করতে প্রয়াসী নন।১১ পটভূমিতে আমি লিখেছি কোন আলোকে গল্পগুলোকে কেবলই গল্প না রেখে আমরা সাহিত্যের এবং নৃবিজ্ঞানের ছায়ায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। হয়তো ভবিষ্যতে বড়ো ডিগ্রিধারী কেউ এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন ।

অনলাইনে পাওয়া গল্পগুলোতে একটা আপ্ত বাক্য উঠে এসেছে যে, মায়েদের সঙ্গীরা মনে করেন গর্ভপাত মোটামুটি একটা ঝামেলা-মুক্তিদায়ী বিষয়। এটা করালেই যেন সব ঝামেলার শুভ সমাপ্তি। হয়তো সত্যি। তবে তা ছেলেদের বেলায়। মায়েদের কেবলই শুরু। মায়েদের শুরু ছেলেদের সারা। এবং গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে ছেলেরা একেবারেই অদৃশ্যমান। অনেক মায়েরা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেননি। অনেকেই আর স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। অদ্ভুত আঁধার এক কেড়ে নিয়েছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। যেমন, একজন মা বলেছেন- “আমি নীল টেডিবেয়ার জড়িয়ে রাতে ঘুমাই; তাও সে দশ বছর।” টেডিবেয়ারটাই যেন তাঁর হারানো সন্তান।

একজন ছেলে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ‘আপনার সঙ্গীর কোনো কষ্ট হচ্ছে কিনা, খোঁজ নিয়েছেন?’ সাবলীল উত্তর ছিল- ‘কষ্ট হবার তো কোনোই কারণ দেখি না। বরং এ বাচ্চা রাখলেই তার কষ্ট হতো।’ আরেকজন ছেলে সঙ্গীর নির্বিকার জবাব- ‘এটা কষ্টের কোনো বিষয়ই নয়।’ মায়েদের প্রতি এই মনোভাব কেবলই ছেলে সঙ্গীর নয়। এটা সমাজের সংস্কৃতি, মূল্যবোধের শাশ্বত প্রতিফলন। নিষ্ঠুর মনোভাব হয়তো পালটাবে না সহজেই। কিন্তু এ লেখা বা সংকলন তাদেরকে জানান দিবে অন্তত যে- তাদের ধারণা মিথ্যে। কাল্পনিক।

আরেকটা বিষয় জানা যায় যে, যেহেতু কোনো প্রণীত নীতিমালা নেই গর্ভপাতের উপর সেহেতু আমাদের পুরুষ শাসিত [পুরুষতন্ত্র পড়ুন] সমাজে এই সব মায়েদের কন্ঠস্বর চাপা পড়েই আছে। কথা বলেছিলাম কিছু নৃবিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী এবং সাইকোলোজিস্টদের সাথে। ইচ্ছা করেই পুরুষ পেশাজীবীদের বেছে নিয়েছিলাম যাতে জানতে পারি তাদের মনোভাব। সম্মিলিতভাবে উত্তরগুলো ছিল এরকম-

‘এটা দি. রাইট্স্ আব প্যাজেসের অংশ।’ ‘ব্যক্তি স্বাধীনতার একটা বহিঃপ্রকাশমাত্র।’ ‘একটা ইতিবাচক নৈতিক কাজ। মা হিসেবে পূর্ণতার একটা ধাপ।’ ‘আজকাল ক্যাম্পাসে নাকি খোটা দেওয়া হয়, ‘এই তোকে…ক্লিনিকে দেখেছি’, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।

আমি গালে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এভাবে যদি গর্ভপাতকে দেখা হয় তাহলে এই দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতরানো মায়েরা কোথায় যাবেন। আর কিইবা শেয়ার করবেন তাঁর যন্ত্রণার কথা। একজন মায়ের গর্ভপাত পরবর্তী যাতনাকে মিনিমাইজ করে ফেলা হয় তখনই, যখন মনোভাবটাই থাকে যে, এটা কোনো ‘বিগ ডিল’ নয়। কেবলই একটি মাংসপিণ্ড কেটে ফেলে মাসিকটাকে রেগুলার করে দেওয়া। তাহলে আর কিসের কষ্ট-আর কিসের যন্ত্রণা। আমার এক ফেইসবুক বন্ধু লিখেছে ‘বিষফোঁড়া কেটে ফেলতে নাকি এর চেয়ে বেশি কষ্ট হয়।’ বন্ধুটি নারী উন্নয়নে উচ্চতর শিক্ষায় নিয়োজিত! অস্ট্রেলিয়ার একটা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লেখার পর যে প্রতিক্রিয়া হলো তা আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়। ‘এটা গবেষণার কোনো বিষয়ই হতে পারে না।’

গর্ভপাত পরবর্তী মায়েদের কষ্ট লাঘবে সমাজের কোনো উদ্যোগ না থাকার অন্যতম কারণ মনে হচ্ছে বিষয়টার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং নির্বিকার ভাবনা। বিপরীতে, মায়েরা মন খোলাভাব নিয়ে তাঁদের কথা কাউকে বলতে পারেন না; কিংবা বলার কোনো পরিবেশ পান না। এমনকি অনুমতিও। অস্ট্রেলিয়ার একজন সাংবাদিক গবেষকের মনোভাব এরকম যে, গর্ভপাত একটি আবেগের বিষয় হতে পারে এবং কষ্টেরও। বিশেষ করে তাদের জন্যে যারা স্বেচ্ছায় গর্ভপাতকেই বেঁছে নিয়েছেন। আর যা আমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি তার জন্যে দুঃখ বোধ করতে পারি না।

আবার সাধারণ মানুষের ধারণা, এইসব মায়েরা ‘মেলোড্রামাটিক’ ‘অতি স্পর্শকাতর’ ‘মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে আগ্রহী।’ অপরদিকে পঠিত গল্পগুলোতে দেখেছি একেবারেই বিপরীত চিত্র। ‘নিজেকে হারানোর এক ব্যাকুল অনুভূতি’ ‘নিজের সাথে প্রতারণা করার এক গিল্ট-ফিলিংস।’ এমনকি অনেকেই বলছেন, তারা নিজেদেরকে আপন সন্তানের খুনি মনে করেন, (২০০ জনের মধ্যে ১৩৭ জন) তেমনি একজনের একটা বাক্য- ‘আমি মনে করি গর্ভপাত কেবলই একগুচ্ছ কোষ শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা নয় বরং অবধারিতভাবে এটা সত্যিকার মানবশিশু।’ মার্গারেট নিকল১২ নামে একজন গবেষক দেখিয়েছেন যে, এটা একটা সাধারণ মিথ যে, বাচ্চার জন্মের পরেই মায়ের সাথে ‘বন্ড’ তৈরি হয়। কিন্তু একজন মা তার গর্ভধারণ [এবং তা যখন প্রথম গর্ভধারণ হয়] কখনোই ভুলতে পারেন না। যে বাচ্চার পৃথিবীর মুখ দেখা ছিল কেবলই সময়ের ব্যাপার। আর বাচ্চাটাই যখন হারিয়ে গেলো, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গর্ভপাত করালেন, তখন তা হয়ে যায় আরও বেশি বেদনার। শূন্যতার অনুভূতি। কিছুই না থাকার অনুভূতি। মূল গল্পগুলোতে যাবার আগে আমরা গল্পগুলোর কিছু কমন ইস্যু পর্যালোচনা করবো, যেখানে এই ২২০ গল্পের বক্তব্যগুলো একটি সাধারণ প্লাটফর্মে উঠে আসবে।

পেছনের কথা-

এইসব মায়েদের খুব তাচ্ছিল্যের সাথে দেখা হচ্ছে। গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে তাদেরকে মনে করা হচ্ছে যে তারা সঙ্গী বা পরিবারের বাড়তি মনোযোগ পাবার জন্যেই কেবল চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যেমন, একজন মাকে ডাক্তার বলছেন- ‘কেঁদো না, এটা কান্নার কোনো ব্যাপার না। এটা মা হবার এবং মা না হবার একটি অংশ মাত্র। বাচ্চাদের মতো কান্না করে কোনো লাভ নেই।’

বহুদিন আগে `The Age১৩‘ পত্রিকায় এক হৃদয় বিদারক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। যেখানে দেখা যায়, একজন মা পুরো সাতচল্লিশ বছর তার হারানো সন্তানের কবরের খোঁজ করতে করতে জানতে পারেন যে, কোথায় সমাহিত করা হয়েছে। সেই সমাধিগুলো আর মাটি শুঁকে নিয়ে তাঁর সন্তানের শরীরের গন্ধ নিচ্ছেন। একজন মা প্রায় পঞ্চাশটি বছর কেবলই খুঁজে ফিরেছেন আপন সন্তানের সমাধি! একমুঠো মাটিই হয়ে উঠে তাঁর কাছে আপন সন্তানের প্রতিচ্ছবি! কিংবা আপন সন্তান! এই মা সাক্ষাতকারে বলেছিলেন যে, তিনি কাউকেই বলেননি; কারো সাথে কোথাও দেখা করেননি। বিয়ে করে সংসারী হননি। প্রতি বছর নিজেই তাঁর হারানো সন্তানের জন্মদিন পালন করতেন কেক কেটে, আর এতিমখানায় খাবার দিয়ে। গর্ভপাতে হারানো বাচ্চার জন্যে দুঃখ আর কষ্ট পাওয়াটাও যেন সমাজে নিষিদ্ধ। চিরস্থায়ী ট্যাবুর মতোন! জন্মই ছিল যাদের আজন্ম পাপ!

নীরবতা-

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের মেয়ে মাইশা। শহরে ব্যাচেলর পড়তে এসে সঙ্গীর সান্নিধ্যে কনসিভ করে ফেলেন। নয় সপ্তাহের সময় সিদ্ধান্ত নেন গর্ভপাতের। তাঁর মুখেই শুনি- আমার কষ্ট কখনোই লাঘব হবার নয়। কারণ, আপনি আমার দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। আমার ছেলেবন্ধু যাকে আমি পরে বিয়েও করেছি আমরা কখনোই এ বিষয়ে কথা বলিনি। ভুল করেও একটিবার আমরা হারানো বাচ্চাকে নিয়ে আলোচনা করিনি। এটা একটা ট্যাবুর মতোই আছে আমদের জীবনে।

কাবেরী, সুনামগঞ্জ শহরের মানুষ, লিখেছেন আমার আপন বোনের দুই মেয়েই জন্মের পরপর মারা যায়। তাদেরকে ধর্মীয় রীতিতে সামাহিত করা হয়। সবাই তার এবং তার স্বামীর প্রতি যথেষ্ঠ সহানুভূতিশীল। কিন্তু, আমার গর্ভপাতে হারানো বাচ্চাটার প্রতি যেন সবার এক নীরব ঘৃণা। এমনকি আমার প্রতিও। আমি পাপী এবং খুনি। তাদের ধারণা এটাই। এবং আমার স্বামী, মা, বোন কেউ গত দশ বছর এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি।

দুই সন্তানের মা রেবতী বর্মন। নাম, ঠিকানাসহ তাঁর কথাগুলো লেখার অনুরোধ করেছিলেন ২০০৭ সালে গর্ভপাত করান স্বামীর চাপেই। পর্যাপ্ত আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় তাঁকে গর্ভপাত করানোর চাপ দেন। নতুবা বিচ্ছেদ। বাবার এবং মায়ের উপর বাড়তি চাপ দিতে চাননি। আবার সংসার ভাঙুক, তাও না। শুনি তাঁর কথা-

আমি বোধহয় চুড়ান্ত মূল্য দিয়েছি এবং আজও দিচ্ছি। দুই সন্তান অবধি স্বামীর সাথেই ছিলাম। কিন্তু আর পারলাম না। এলএলবি পাশ করে আইনি পেশায় আছি। বাচ্চা দুটোকে নিজের মনে করেই বড়ো করছি। আমার ডিভোর্সের কারণ আমি ছাড়া কেউ জানে না। আমার নিজেকে আজও আমি ক্ষমা করতে পারছি না। আর পারছি না বলেই আমি আর ‘সংসারী’ নই।

একজন সাইক্রিয়াটিক১৪ লিখেন এ রকম- ‘ভালোবাসার কেউ মারা গেলে সবাই কষ্ট পাবে এটা সার্বজনীন। এবং মৃত্যুর কিছুদিন পর্যন্ত সবাই তার কথা বলবে, আলোচনা করবে এটা প্রতিটি সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান। কিন্তু কষ্টের কথা কাউকে না বলে নিজের কাছে আগলে রাখার কিংবা মুখ খুলে প্রাণভরে বলার উপর বিধি-নিষেধ, সেটার ফলাফল হয় ভয়াবহ। সুতরাং, গর্ভপাতে হারানো সন্তনের কষ্ট আরও একটু গভীর। কারণ এখানে একজন মা একা। একেবারেই একা। কেউ তাঁকে জড়িয়ে ধরেনি। মাথায় স্নেহমাখা হাত বুলায়নি। তাঁর এলো চুলগুলো কেউ যত্ন করে আঁচড়িয়ে দেয়নি। তাঁর অবিন্যস্ত পোশাকগুলো কেউ তাঁকে বদলাতে বলেনি। একই সমান্তরালে হারানো বাচ্চাটার কোনোই স্মৃতি নেই। এ্যালবামে নেই কোনো ছবি। কোনো পুরাতন জামা-কাপড়। কোনো ধর্মীয় আচার। জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী। কোনো গোরস্থান। কোনো এপিটাফ। এমন কিছুই নেই যাকে মায়ের কাছে বাচ্চার উপস্থিতি বা স্বীকৃতি জানান দেয়। কেবলই দুঃসহ কিছু স্মৃতিকথা। হাসপাতাল। সাদা চাদর। ফিনাইলের অবিরাম গন্ধ। অপারেশন থিয়েটার। এবং অবশেষে চেতনানাশক ইনজেকশন।‘

প্রিয়া সরকার, টাঙ্গাইল থেকে লিখেছেনআমার কাছে একটি কাগজই আমার বাচ্চা। যেখানে আমি ডাক্তার এবং হাসপাতালকে অনুমতি বা কনসেন্ট দিয়েছিলাম। আমার কাছে আর কোনোই স্মৃতি নেই।

মাধবী চৌধুরী, সাভার থেকে লিখেছেন‘আমি নীরবেই আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। আমি প্রতিদিন নামাজ শেষে আমার হারানো বাচ্চার জন্যে প্রার্থনা করি। এবং আমার নিজের জন্যেও। আমার অন্তরেই তার কবরস্থান। এবং এই জায়গাতেই সে শায়িত। এটাই আমার বাচ্চার একমাত্র স্বীকৃতি।

বিলকিস আহমদ, খুলনা থেকে লিখেছেনআজ দুবছর আমার গর্ভপাতের। আমার ছেলে বা মেয়ে যাই ছিল না কেন, আমি জন্মদিন পালন করছি। আমার স্বামী কথাও বলেন না। প্রতিদিন দুঃস্বপ্নে আমার ঘুম ভাঙে। আর রাতদিন মনে হয় আমার সন্তান আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। আমি আর বাচ্চা নেবো না। এবং বাচ্চা না নেওয়ার প্রাপ্যটাই তবে আমার প্রায়শ্চিত্য। সাইকোলোজির কিতাবে লেখা হয় সময়ই সবচেয়ে বড়ো দাওয়াই। আদৌ কি?

মায়মুনা হক, বয়স ৭০। বড়ো চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসরপ্রাপ্ত। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে তাঁর গর্ভপাতের সন্তান হারান। তিনি ছিলেন তখন অবিবাহিত। বিয়ে করেন। কিন্তু আর কনসিভ করেননি। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি আর নিজেও বিয়ে করেননি। তিনি জানতেন আর কোনো সন্তান হবে না। আজো তিনি সেই হারানো বাচ্চার জন্যে কেনা কাপড়গুলোর গন্ধ শুকেন। ওগুলোই তাঁর সম্বল। তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন তাঁর ছেলেসঙ্গীর কাছ থেকে যে, যদি তিনি কনসিভ করেন তাহলে তারা বিয়ে করবেন। বিয়ে হলো না। সংসারও হলো না। চাকরির শেষ পর্যন্ত থাকতে পারলেন না। মায়মুনার মুখেই শুনি- ‘আমার মা জানতেন। বলেছিলেন সংসারী হলে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ই সব শুধরে নিবে। সময় আজো আমাকে শুধরাতে পারেনি। একবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার চেষ্টাও করি। স্বামীর সতর্কতায় বেঁচে যাই। বেচারা স্বামীকে আমি ঠকিয়েই গেছি। উনার অকালমৃত্যু আমাকে সেই দায়মুক্তি দিয়েছে। একটা সন্তানের জন্যে ভদ্রলোক হাহাকার করতেন। অথচ আমি জানতাম, আমার কোনো সন্তান হবে না। গর্ভপাতের সময়ই এটা আমার মনে হয়েছিল যে, এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। আমার সন্তানকে আমি ভালোবেসেছি। আমি তার জন্যে কাপড়ও কিনেছি। তাকে নিয়ে রাতের পর রাত আমি নির্ঘুম চোখে গেঁথেছি স্বপ্নের ঢালি। এমনকি, আমার ছেলেবন্ধু চলে যাবার পরও প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি সন্তানটাকে রাখতে। সমাজ আর মায়ের চাপে নত হয়েছি। আজো নতজানু হয়ে আমার সন্তানের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আজ আমার একমাত্র সান্ত্বনা, মৃত্যুর পর আমাদের আত্মা আবার একত্রিত হবেই’।

শাকিলা জাহান, মানিকগঞ্জ থেকে বলছেন‘তিনি হাসপাতাল থেকে সেই হারানো বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন। এবং সবার অগোচরেই চাইছিলেন যে বাড়ির পেছনের আঙিনায় সমাহিত করবেন। তিনি এবং তার বান্ধবী মিলে সমাহিত করেন। দুটো বকুল ফুলের ছায়ার তাঁর সন্তান সমাহিত। স্বামী বিষয়টি জানেন। কিন্তু গত সাত বছরে স্বামী এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। একটিবারও না। বুকের মাঝে সমাহিত আপন সন্তানের শরীর। বুকের মাঝেই স্তব্দ করে রাখা কষ্টের কথাগুলো তাঁরা আজই বলতে পারলেন।

প্রসারিত হলোনা কারো দুহাত-

বাংলাদেশের এই গল্পগুলো এতোটা কষ্টকর হয়তো হতো না, অন্তত, কেউ যদি একটু সাহায্য করতো এইসব হতভাগ্য মায়েদের। সমাজ, পরিবার, বন্ধু, স্বামী। এমনকি যেসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সংশ্লিষ্ট মায়েরা গর্ভপাত করান সেখান থেকেও কোনোরকম ফলোআপ করা হয়নি। একজন মা-ও লিখেননি বা বলেননি যে, হাসপাতাল, নার্স, ডাক্তার তাঁদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। যে দু-চারজন মা শারীরিক সমস্যায় পড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন কেবলই তারাই জিজ্ঞাসিত হয়েছেন। তাও কেবল শারীরিক সমস্যার কথা ডাক্তাররা শুনেছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে।

রুশনারা হক, এখন প্রবাসী। তিনি একটি সাইকোলোজিক্যাল ফোরামে তাঁর গর্ভপাত পরবর্তী কষ্টের গল্প বলেছিলেন। অনলাইনে। উত্তর ছিল- ‘গেট লস্ট।’

সুহানা শারমিন, নেত্রকোনা থেকে লিখেছেন- ‘চব্বিশ বছর পর আমি একটি নারী কর্মস্থান ক্ষেত্রে আমার গল্পটি বলেছিলাম। এবং আশা করেছিলাম যে, যেহেতু সংস্থাটি নারীদের নিয়ে কাজ করে সেহেতু আমার গল্প আগ্রহভরে শুনবে। কিন্তু প্রধান মহিলা কর্মকর্তা আমার প্রতি এমন আচরণ করলেন যে, আমি কোনো মানুষ নই। মহিলা কর্তার ভাষায় আমার মতো মেয়েদের জন্যেই নাকি সমাজের এত সর্বনাশ! এবং কেনই বা আমাকে তিনি শাসিয়ে দিলেন যে, এসব আজেবাজে গল্প বলার জন্য এই অফিস নয়’!

ইসমত ইসাফ, ভোলা থেকে বলছেন, “যদি আমার কোনো দোষ হয়েই থাকে, সবটুকু আমার মাঝেই আছে। কেউ জানতে চায়নি। কেউ শুনতে চায়নি। এমনকি কারো কাছে বলার মতো পরিবেশও পাইনি। আমার স্বামীকে যখন বিয়ের পর আমি বলেছিলাম, তিনি কেবলই বললেন, ‘নিশ্চয়ই একজন ছেলেবন্ধু ছিল। একজন পুরুষ হিসেবে আমারও নৈতিক দায় এসে যায়। যা হয়েছে ভুলে যাও।’ এবং কোনোদিনই আমরা এসব বিষয় কথা বলবো না। বিয়ের পনের বছর। আমরা ভুলে গেছি এমনটাই ভান করি কিন্তু প্রতিটি দিন আামার কষ্টে কাটে। বিশেষকরে প্রতি শনিবার আমার মনে হয় আমি উন্মাদ। হিস্টিরিয়ার মতো আমি ছটফটাই। আমার পরিবারের ধারণা, আমি মানসিক বিকারগ্রস্ত। ভয় আর আতঙ্কে আমার স্বামীর সাথেও আর কথা বলছি না। কতো বিষয় নিয়েই কাজ হয়! কত না উন্নয়ন চিত্র! উন্নয়ন কর্মী! কিন্তু, আমার মতো মহিলাদের নিয়ে কেউ কথা বলে না! সাহায্য আর সহযোগিতা তো অনেক পরের বিষয়। মায়েদেরকে মনে করাই হচ্ছে তারা দুর্বল। তারা আশ্রিত। মায়ের কথা তো কোনো কথাই নয়। তার কাজই যেন কষ্ট আর কষ্টের ঘানি টেনে নিয়ে যাওয়া। সেখানে গর্ভপাতের মতো গ্লানিময় বিষয়ের গল্প শোনা আর সে সব মায়েদের জন্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার দুঃসাধ্য কাজটি কে করবেন”? 

একজন মা যখন গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে কষ্ট পাচ্ছেন, তখন সবার ধারণা এমন যে, এমন কষ্টের জন্যে তিনি একাই দায়ি। যদিও আদৌ কষ্টের জন্যে তিনি একা দায়ি নন। এবং একজন মাকেই তাঁর এইসব কষ্ট আর যন্ত্রণার পথ থেকে মুক্তির পথ বাহির করতে হবে। ব্যস্ত, বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়ন কর্মীরা বড়োই ব্যস্ত। উন্নয়নের জোয়ারে এইসব ফালতু কষ্ট! এমনিতেই ভেসে যাবে।

পছন্দের সীমাবদ্ধতা-

এই বইয়ের উঠে আসা গল্পগুলো কষ্ট আর যন্ত্রণার কথা বলছে। একই সাথে আরও একটা বিষয় অব্যক্ত থেকে যাচ্ছে যে, তাদের পছন্দের প্রচণ্ড সীমাবদ্ধতা। সমাজ থেকে, পরিবার থেকে, স্বামী বা সঙ্গী থেকে। যেকোনো ক্ষেত্রেই যতো বেশি পছন্দ করার স্কোপ থাকবে, মানুষ ততো স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে।১৫ প্রায় প্রতিটি গল্পেই উঠে আসছে যে, গর্ভপাতই ছিল তাঁদের মার্জিনাল পছন্দ। কিন্তু, এইসব মায়েদের হাতে যে স্কোপ ছিল তার সবগুলোই মোটামুটি এরকম-

‘এখনো বিয়ের সময় হয়নি। আগে বিয়ে পরে বাচ্চা। (অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে)’

‘এখনো হাতে পর্যাপ্ত সেভিংস নেই। আগে সেটেল হয়ে নিই তারপর…’

‘বাচ্চা রাখতে পারো, কিন্তু আমার ঘর করতে পারবে না।’

‘সমাজে মুখ দেখাবে কি করে; বিয়ের আগেই বাচ্চা! (অবিবাহিতদেও বেলায়)’

‘আগে আমরা এনজয় করে নিই। বাচ্চা হবার পরতো আর পরবো না। আর যদি রাখতে চাও, তোমার সিদ্ধান্ত’

‘বাচ্চা রাখলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও’। (বিবাহিত-অবিবাহিত সবার জন্যে)

সুতরাং, পছন্দের বা এর যে কাব্যপনা আছে সেখানে সবগুলোকে সমান করে রাখতে হয়, সমান গুরুত্ব বহন করতে হয়। ‘পছন্দ’ বিষয়টি তখনই আসে যখন একজন মা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবেন যে, আমার বাচ্চা রাখলেও বাকি পথ আমি একলাই হাঁটতে পারবো। স্বামী/মা/সমাজ/ বন্ধু কারো হাত আমার লাগবে না।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সেইরকম চিন্তার বা কাজ করার আদৌ কি কোনো জায়গা আছে? গর্ভপাত বিষয়ে একজন মা তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এমন সাহসী বক্তব্য কি সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে আশা করা যায় আদৌ? যখন আমাকে ভোট আর সমর্থন চাইতে মানুষের দরজার কড়া নাড়তে হবে। গল্পগুলোর মাঝে সুপ্তভাবে লেখা আছে মা অথবা স্বামী, যারা একক এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী। তারা আমাদের পুরুষ শাসিত, পুরুষ প্রভাবিত সমাজের প্রতিনিধি। তারা সমাজ আর সংস্কৃতির প্রতিনিধি। এমন প্রভাবশালী প্রতিনিধির সামনে দাঁড়িয়ে একজন মা খুব বেশি সাহসী হতে পারছেন না। এবং বলাই বাহুল্য, তারা রাষ্ট্রেরও প্রতিনিধি। একজন মা এইসব প্রভাবশালী ব্যক্তির/সমাজের/সমাজ ব্যবস্থার/রাষ্ট্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে দেখবেন, তখন তিনি বড়োই অসহায় বোধ করবেন। বড়োই একাকী। অন্যেরা কিংবা এই সমাজের উপস্থিতিতে নিজের আপন সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানোর মতো সাহস তাঁরা পাননি। Presentation of mothers in presence of state/ Patriarchy/ Culture- বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েই তবে এইসব মায়েরা বেছে নিয়েছেন আপন সন্তানের মৃত্যু-স্বাক্ষর দেবার আমৃত্যু যন্ত্রণাদায়ী সিদ্ধান্ত।

আজকাল খুব কাব্য করে বলা হচ্ছে- Abortion on Demond’।১৬ উত্তর ছিল- ‘ভাই প্যাঁচাল দিয়েন না তো।’ আমি আর প্যাঁচাল দিলাম না। ধন্যবাদ সহযোগে ফোন অফ! এইসব মায়েরা পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আপন ইচ্ছাকে অন্যের ইচ্ছার কাছে নির্মমভাবে আত্মসমর্পণ করিয়েছেন। গর্ভ আর স্ত্রীর বা স্বামীর সম্পর্ক বা পরিবারের সাথে গর্ভবতী মা, সম্পর্কগুলো এক সাথে চলতে পারছে না। জীবনের এই উপলদ্ধি তাঁদেরকে আত্মসমর্পণ করালো। হুবহু ইংরেজিটাই তুলে দিই- “It’s me or the body” বিবেকের বোতাম তাঁরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ক্ষণিকের জন্যে।

জায়রা জিলান, ঝিনাইদেহ থেকে বলেছেন– ‘আমার ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক স্বামী বললেন- ‘Go and get rid of it, or I would leave’ আমি সারারাত ঘুমোতে পারছিলাম না। সকালে মাথা ঘোরা, বমি ইত্যাদিতে আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। ইতোঃমধ্যে আমার স্বামী কলম্বো গেছেন সেমিনারে। আমি মনে প্রাণে প্রার্থনা করছি উনি যেন মরে যান! দয়াময় আমার প্রার্থনা শুনলেন না। প্রতিদিন আমি হাতজোড় করে বলতাম, থাকুক না বাচ্চাটা। হয়তো ছেলে হবে। বড়ো এক বোন, একসাথে খেলবে It is a burden, go and get an abortion done, or leave the house; আমি তাকে বললাম যে, আমি আমার বাচ্চার হত্যাকারী হতে চাচ্ছি না তুমি বরং আমায় মেরে ফেলো। উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমালেন। এবং আমিই আমার বাচ্চার হন্তারক’।

নারী স্বাধীনতার মানে আমি কোনোদিনই বোধ হয় বুঝলাম না। Freedom of choice বিষয়টা কি Fears of abandonment দিয়ে চলে যাচ্ছে না? একজন জায়রা জিলানের গল্প কি আমার সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, আমি বাচ্চা রাখলে আমি একজন পরিত্যক্ত মানুষ পরিণত হবো! আর পরিত্যক্ত মানুষ মানেই তো সহায়হীন একজন মানুষ।

গর্ভপাতের পর জায়রা দুবছর পর আরেকটা সন্তান নেন। এবারও স্বামী বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু, স্বামীর মানসিক আত্যচারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনিই দ্বিতীয় সন্তান জন্মের দুইমাস আগে অধ্যাপক সাহেবকে ছেড়ে চলে আসেন। পাঁচ বছর পর জায়রা আবার বিয়ে করেন। ব্যবসার সুবাদে পরিচয়। সম্পর্ক। এবং আয়োজন করেই বিয়ে। এবং আবারও তাঁকে হাসপাতালে যেতে হলো। সেই পরিচিত ও.টি.। ফিনাইলের গুলানো গন্ধ। সাদা চাদরের মৃত্যুর মিলমিশ বিছানা। এবং ছোটো সন্তান গর্ভপাত। জায়রা চেষ্টা করেছেন। প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন। একজন মায়ের সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত করতে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে এক পর্যায়ে ক্লান্ত! জায়রা হাত-পা ছেড়ে স্রোতেই গা ভাসিয়েছেন। একা। ক্লান্ত। এবং অপরাধবোধ নিয়ে রীতিমতো নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় আসামি সারাজীবন। দুইবার সন্তান হারানো জায়রা এখন মানসিক হাসপাতালের নিয়মিত যাত্রি। তবু ভালো আমার চোখে যে, বেচারা অন্তত বুঝতে পারছে যে, জায়রার চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু, ততক্ষণে জায়রার দুই সন্তানের সমাধি হয়ে আছে জায়রার অন্তরে।

চিত্রালী মিশা, সিলেট থেকে জানাচ্ছেন যে– তাঁর স্বামীর জন্যেই গর্ভপাতের মরণমুখী সিদ্ধান্তে যেতে হয়েছিল। চিত্রার মুখেই না হয় শুনি, “আমার স্বামী আর কোনো সন্তান চাননি। প্রথম সন্তান নিয়ে নাকি তিনি মোটেই সুখী নন। যদিও আমি মনে করছি প্রত্যেক বাচ্চাই স্বভাবসুলভ দুষ্টুমী করে। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে বললেন যে, এটা আমার সিদ্ধান্ত আমি রাখবো বা নষ্ট করবো। এই পর্যন্তই। মাসখানেক অব্দি তিনি কোনোই কথা বলেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যদি আমার প্রথম গর্ভের সময় উনার যে সাহস, সমর্থন এবং উৎসাহ পেয়েছিলাম, এবার যদি সেরকম পেতাম, মনে হয় আমার বাবুটা আমার কাছেই থাকতো। আমি জানি এবং জানতাম- I was really doing it just to appease my husband.’’

লুবনা ইয়াসমিন, ঢাকা থেকে লিখছেন যে, চাকরির সুবাদে সহকর্মীর প্রেমে পড়ে যান। অসাবধানতাবশত কনসিভও করেন। কিন্তু, সঙ্গীর কোনোই সমর্থন ছিল না। এমনকি সঙ্গী বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে যান। ফোন নম্বর বদলে ফেলেন। সম্পর্কের ইতি হলো সঙ্গীর সাথে। সন্তানের সাথেও। লুবনার মুখেই শুনি, ‘আমার বয়ফ্রেন্ড প্রচন্ডভাবে উৎসাহিত করতে চাইলো আরও দুবছর অপেক্ষা করবে। যাতে দুজনে আরও ভালো করে পরস্পরকে জানতে পারি; এবং অবশ্যই আমাদের নিজেদের জন্যে। অপেক্ষা করা, যাতে আরও একটা প্রমোশন পেয়ে যান, আরও কিছু ব্যালেন্স জমা হয়। অপেক্ষার যাতে রাইট টাইমটা আসে। না, সময় আসেনি। অথবা এসেছিল। কিন্তু আবার, বাবুটা পৃথিবীর আলো আর দেখলো না’।

লুবনার সঙ্গী যা বলেছিলেন তা কখনোই হলো না, একই রকম বক্তব্য আমরা পড়েছি অনেকের লেখায়। সাহস, সমর্থন আর উৎসাহ একটা বড়ো বিষয় হিসেবে কাজ করছিল সবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায়। লুবনার মতো অনেকেই লিখেছেন আমার যা হারিয়েছে তা আর কখনোই ফিরে আসবে না। স্বামী বা সঙ্গীর ভূমিকা গল্পের মাঝে প্রচণ্ড মূর্ত হয়ে উঠছে। হতে পারে সামাজিক কারণ। কিংবা অর্থনৈতিক কিংবা অন্যকিছু। কিন্তু নৈতিক সমর্থনটার অভাব, এইসব গল্পে, বড়ো প্রকট হয়ে উঠে।

ব্রতী ইসলামের কথাতেই ধরা যাক‘আমার বিবাহিত জীবনের বয়স দশ। আমি আবিষ্কার করলাম আমার স্বামী তার সহকর্মীর সাথে প্রেমে মত্ত। সে সময়টাতেই আমি কনসিভ করি। আমার স্বামী আমাকে বুঝালেন চল্লিশ বছর বয়সে এসে বাচ্চাকাচ্চা নেবার কোনো মানে হয় না। বিয়ের প্রথম দশ বছর আমি কনসিভ করিনি। কিন্তু আমার স্বামী এরকম ছিলেন না আদৌ। একটা বাচ্চার জন্যে তিনি কত স্বপ্ন দেখতেন! মেয়ে হবে, মাথায় করে নিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াবেন। প্রতিদিন বাচ্চাকে কাঁধে রেখে ঘুম পাড়াবেন। অথচ সেই  মানুষটার প্রতিক্রিয়া ছিল একদম অপ্রত্যাশিত। আমার স্বামী পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে, তিনি আর কোনো সন্তান চান না। প্রয়োজনে বাচ্চা জন্মের যে খরচ হতো তা দিয়ে আমাকে গহনা কিনে দিবেন। এবং তারপরও যদি আমি বাচ্চা রাখতে চাই, তিনি আমাকে বাড়িতে নয়; তার আরেকটা বাড়ি আছে, আমাকে সেখানে রাখবেন। খরচপাতি তিনিই দিবেন। তবু তার সাথে আমরা থাকতে পারবো না। আমি মর্মাহত। সন্দিহান এবং দ্বিধাগ্রস্ত। আমি ইচ্ছা করেই স্বামীর দেওয়া অপশনগুলোকে ‘চয়েজ’ বলছি না; কারণ এগুলো চয়েজ নয়তো, বরং চিন্তার এবং টেনশনের। আমার সামাজিক নিরাপত্তা। বাচ্চার। পারিবারিক বন্ধনের বিষয়। আলাদা একটা বাসায় থাকা আর খরচের যোগান দেওয়ার মানেই তো সংসার নয়। গর্ভপাতের আগের রাতে আমার স্বামীর দিকে তাকালাম। মনে বিচারকের ভূমিকায়। আমি আসামি! হ্যাঁ, আমি আলাদা বাসায় থাকছি। আমি একা। এই ‘ভদ্রলোক’ আর আমার সাথি নয়!

একজন স্বামীর ভূমিকা আরও বেশি আগ্রাসি হয়ে ওঠে যখন হয় মদ্যপ, নেশাগ্রস্ত। শান্তা ইসলামের গল্পটা দেখে নিই। শান্তা লিখেছেন গোপালগঞ্জ থেকে

“আমাকে দশ বছর সেক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ করে থাকতে হলো। মানসিক, মৌখিক, শারীরিক  অত্যাচারের সীমা সইতে না পেরে আদালতের মাধ্যমেই সম্পর্ক শেষ করি। সে কনডম ব্যবহার করবে না। আমাকেও পিল নিতে দিবে না। এটা তার মানসিক বিকলাঙ্গতা কি না জানি না। কিন্তু তার সাথে বিছানায় কখনোই আনন্দ ছিল না বরং তা ছিল এক ধরনের আতঙ্ক। আদালত আমাকে তার বিরুদ্ধে ‘রেপ’-এর অভিযোগ আনতেও অনুমতি দিয়েছিলেন। রাস্তায়, পার্কে যখন দুবছরের বাচ্চাগুলোকে হাঁটতে দেখি, মায়ের কোলে, বাবার কোলে, দৌড়ে, আমার মনে হয় এই বাচ্চা আমার হতে পারতো। হয়তো আমি সমর্থনের অভাব বলে নিজেকে একটু হলেও আড়াল করার চেষ্টা করছি এবং সেটা নিতান্তই অজুহাত। আমিই পারিনি। গর্ভপাতের সোল ডিসিশনটা তো আমাকেই দিতে হয়েছিল”।

শান্তা, জায়রা, লুবনা, ব্রতীরা সমর্থন পেলে নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে রাখতে পারতেন। ফিরে আসতে পারতেন সরল স্বাভাবিক জীবনে। বিবেকের নীরব দংশন থেকে রক্ষা করতে পারতেন নিজেকে। সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যদেরকেও। ব্যক্তি, পরিবার, শান্তা, জায়রা, লুবনা, ব্রতীরা- এসব মিলেই তো আমাদের সমাজ।

মোনা জাহান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শেষ দিকে কনসিভ করেন। বয়ফ্রেন্ডকে জানাতেই বললো ঢাকা হাসপাতালে গিয়ে ঝামেলা শেষ করে দেই। মোনা বলছেন বাগেরহাট থেকে, “আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে জানালে সে বললো যে- ‘ঝামেলা’! আমার সন্তান আর তার ঝামেলা! মাকে বললাম। মা জানালেন ফোন রেখেই যেন হাসপাতালে যোগাযোগ করি। এক ঘনিষ্ট বান্ধবীকে বললাম। সে বললো, তোর এখনো জীবন শুরুই হয়নি আর এখন এসব লায়বিলিটিস নিয়ে কি করবি! আমি বহুদিন বহুরাত চিন্তা করলাম। ক্রমশ শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে। এদিকে শীতকালীন ছুটিও আসন্ন। বাড়ি যাবো। আমার ধার্মিক মা-বাবা গলা টিপে মেরে ফেলবে। সুতরাং, আমি একাই পরিচয় গোপন রেখে হাসপাতালে গেলাম। বাসায় এসে দেখি আমার সঙ্গী মানুষটি লাউঞ্জে বসে আছেন। কথা দূরে থাক। আমি তাকাতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল সে মানুষ নয় আর। বুয়াকে বলে দিলাম যে, বলো আমার শরীর ভালো নয়। এবং যে নিজেকে এতোটাই অপরাধী ভাবছিল যে, ফোনে পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা বলতে চায়নি। শীতের ছুটি শেষে আর ভার্সিটিতে ফিরতে ইচ্ছে করেনি। মাস্টার্স করা হলো না। বিয়েও করছি না আর। আমার বয়স ২৬। আমি জানি না আমার জীবন নিয়ে যাচ্ছি কোথায়? মাঝরাতে কেঁদে উঠে বালিশ জড়িয়ে ধরি। শূন্যতার কষ্ট। হারানোর কষ্ট। আমার মা এসে নিয়ে মাথায় হাত বুলান। না। এটা কি তার পাপ হবে? নাকি আমি পাপ করলাম। হয়তোবা, কনসিভ করে। গর্ভপাত করে। কিন্তু, দিন শেষের হিসাবে সন্তানটা তো আমারই ছিল”!

এসব গল্প পড়তে পড়তে সময় শেষ হয়। চোখের কোণায় চকচক কর ওঠে নোনা জলকণা। আমি ভাবতেই পারি না সন্তান হারানোর কষ্ট।

জেনিফার আহমদ, ময়মনসিংহ থেকে লিখছেন- “আমার গর্ভপাতের চার বছর। সমবয়সী শিশুদের দেখলেই আমার বুকের ভিতর হু হু করে ওঠে। আমি বিয়ের প্রথম বছরই কনসিভ করি। কিন্তু আমার স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ি কেউ-ই চাননি বাচ্চাটা থাকুক। ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কেটে লিখেছিলাম আমার বাবুর জন্মদিন। গত বছর আমি তার জন্মদিনও পালন করি, মৃত্যুর তারিখেও মিলাদ দেই। আমার স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের কেউ আমাকে আজও সান্ত্বনা দিতে আসেনি। এখন তারা চান আমি কনসিভ করি; কিন্তু, আমি বলি আমি এখনো প্রস্তুত নই। আমি হয়তো সারা জীবনেও প্রস্তুত হতে পারবো না। এবং স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, মা, বাবা কাউকেই আমার আর আপন মনে হয় না। আমার সন্তানকে যারা আপন মনে করলো না, তারা আমার আপন হবে কেমনে”?

লাকী বেগম বলছেন মাদারীপুর থেকে- বিয়ের আগে একবার; বিয়ের পরে তিনবার আমাকে গর্ভপাত করতে হলো। সহকর্মীকে ভালোবেসে বিয়ে করছিলাম। প্রচণ্ড দোদুল্যমান ছিলাম। তাকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু চারটা সন্তানের একটাকেও আমি রাখতে পারলাম না। গত ছয় মাস হলো আমি একা। আমার মায়ের সাথেই আছি। আমি তার সাথে আর ঘর করতে পারলাম না।

 গল্পগুলো লিখতে, সংকলন করতে কষ্ট লাগছে। তথাকথিত অবজেকটিভিটি দেখাতে পারছি না। সম্ভবও নয়। গল্পগুলোর এথিক্স গবেষণার এথিক্স অধ্যায়ে আলোচনা করেছি তার কারণ।

লেহিনা নোহান বলছেন দিনাজপুর থেকে- ‘আমার স্বামী জানালেন তার পক্ষে কোনোক্রমেই এ বাচ্চা রাখা সম্ভব না। আমি তাকে বুঝালাম। রীতিমতো মাটিতে হাঁটু রেখে তার হাঁটুতে মাথা রেখে প্রার্থনা। তার পায়ে ধরলাম। বললাম, সারাজীবনে যদি আমাকে এক সুতা কাপড় না দেও, আমি কোনো আবদার করবো না। প্রায় চার মাস পর্যন্ত আমি সংগ্রাম করে গেলাম আমার সাথে। পুরুষতন্ত্রবাহী এই সমাজের সাথে। তীব্র ধাবমান মানসিকতার সাথে। হারলাম। হার মানলাম। তিনদিন হাসপাতালে ছিলাম। আমি নিঃস্ব নই কেবল, আমি জীবন্ত লাশ। হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় আসলাম। আমার স্বামী বললেন, পরবর্তী বাচ্চাটা অবশ্যই রাখবেন। তিনি খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত।

সত্যিকথা হলো, হাসপাতাল ছেড়ে আসার পর তার সাথে ঘুমাইনি। কোনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না। এবং গত সপ্তাহে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছি। যে আমার বাচ্চাকে আমাকে দিয়ে হত্যা করিয়েছে তার সাথে আমি স্বাভাবিক থাকতে পারতাম না।

এ্যানি রহমান, ঢাকার বহুজাতিক সংসয় কাজ করেন। যার বাবার জন্যেই গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। স্বনামধন্য এক রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠা এ্যানিকে গর্ভপাত ছাড়া মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হতো। বহু বছর অসুস্থ থাকার পর এক মেয়েকে দত্তক আনেন। সড়ক দুর্ঘটনায় সেই মেয়েটিও মারা যায়। আদালতে এ্যানির স্বীকারোক্তি ছিল, আমি দোষ স্বীকার করছি আমার বাচ্চাকে মারার জন্য। কিন্তু সেটা গর্ভপাতের মাধ্যমে সে-ই আমার প্রায়শ্চিত্ত।

এবং ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা একটু সাহায্যের হাত পেলে হয়তো-বা এসব মায়েরা নিজেদেরকে আরও একটু অন্যভাবে দেখতে পারতেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের মসৃণ পথে।

নির্যাতন (!)

পঠিত গল্পগুলোতে সরাসরি কোনো মা-ই বলছেন না আমি নির্যাতনের স্বীকার। কিন্তু, গল্পগুলোর মাঝেই আমরা নির্যাতনের লাভা ঝরতে দেখ্ছি। সন্তান রাখলে স্বামীর সাথে থাকতে পারবেন না, কিংবা স্বামী ও সন্তান, একজনকে বেছে নেওয়ার হুমকি। এগুলো মানসিক নির্যাতনের প্রকটতম রুপ। কিংবা মা ঘর থেকে বের করে দেওয়ার হুমকির নামেও আমরা দেখি একজন অসহায় মা কতটা ঝুঁকি এবং নির্যাতনের মাঝে আছেন। আবার আতঙ্ক আর ভয়ের মাঝেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখেন। আবার সেক্সচুয়াল সম্পর্কের মাঝেও পুরুষ সঙ্গীর প্রভাব। বাচ্চা হলে ‘আমাদের সময়’ থাকবে না। অথবা আগে আমরা এনজয় করে নেই। এসব উক্তি/বাক্য কেবলই একজন পুরুষ মানুষের নয়। বরং সকলের। এই সমাজের। এই সংস্কৃতির। আচার-আচরণের মাঝেই আছে এই বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার সুনিদিষ্ট প্রতিফলন। আবার কখনো দেখা গেছে পুরুষ সঙ্গী বা স্বামী ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ধরনের কনডম নিচ্ছে না এবং ফলশ্রুতিতে তিনি কনসিভ করছেন। যা প্রকৃতপক্ষে বলাৎকারের নামান্তর।

সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিষয়াদি-

এই অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, পছন্দের সীমাবদ্ধতা কেবল অন্য কোনো ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা প্রেসারাইজড নয়; বরং সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় একজন মায়ের সীমিত স্বাধীনতা আছে। বিবাহিত এবং অবিবাহিত- দুক্ষেত্রেই। পাবলিক তথা পুরুষের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে ওঠে প্রাইভেট তথা সন্তানের মায়ের উপর। প্রাইভেট হার মানে পাবলিকের স্বভাবে। পাবলিক জানে, সমাজটা তার। দেশটা তার। সংস্কৃতিতে সে বড়ো হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে, এবং ধাপে ধাপে শিখেছে তাকে প্রাইভেটের উপর খবরদারি করতেই হবে। এটাই হয়তো বা আমার দেশের ‘হাজার বছরের [মাকে নির্যাতনের] সংস্কৃতি’। সংস্কৃতির শিক্ষা। সমাজ থেকে আহরিত, সমাজ আরোপিত। সব মিলিয়ে বিষয়টা হয়ে উঠে Social Subordination, স্বামী বা সঙ্গী নয়, বা পরিবারের অন্য সদস্য নয়। সবাই এক একজন বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার মূর্ত প্রতীক। এবং রাষ্ট্রের তো বটেই।

স্বাধীনতার জায়গাটা একজন মায়ের এতোটাই কম যে, তাঁকে তার আপন সন্তানকে নষ্ট করার মতো শক্ত, নিষ্ঠুর, নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে হয় নির্মোহ হয়ে। নির্জলা বাস্তব পৃথিবীর সামনে বলিদান হলো আপন সন্তান! আবার অন্য চোখে যদি বিষয়টাকে দেখি, গর্ভপাত মোটামুটি অনাঙ্খিত গর্ভের ফলাফল। এই অনাঙ্খিতটা কার কাছে কিংবা কার বিচারে? কে বলছেন অথবা কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কে চাপিয়ে দিচ্ছেন এই গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত? আর এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার সাথে সাথেই চলে আসে ডমিনেশন, এক্সপ্লোয়েটেশন। পাবলিক প্রাইভেটের ধারণা একজন মা চল্লিশ বছর আগেও যে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না; সেই অবস্থানে আরেক মা ২০১৫ সালে এসেও ভিকটিম। নৈতিক সমর্থহীনতার। সঙ্গী বা পরিবারের সকল সহযোগিতার।

জার্মেইন গ্রিয়ার১৭ ১৯৯২ সালেই বলেন যে, গর্ভপাত বিষয়ে এক মাকে যতোসব অপশন দেওয়া হয়, আদতে এগুলো কোনো অপশন বা চয়েজ না। দীর্ঘমেয়াদে গর্ভপাত একজন নারীর আল্টিমেট নন চয়েজ। জার্মেইন আরেকটি বইতে১৮ আরও বিস্তৃত আলোচনা করেন। একজন মা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছুই পেলেন না তার নিজের জন্যে। অযাচিত গর্ভের জন্যে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত তো মা নিজে নেননি বরং মা এই সিদ্ধান্তের জন্যে সারাটা জীবন দুঃখে পুড়তে থাকেন। মাতা, পিতা, সঙ্গী, স্বামী এবং সর্বোপরি সরকার যারা এই মাকে সমর্থন: সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাসস্থান ইত্যাদি দিতে পারতেন। জার্মেইন একদম চোখে আঙুল দিয়ে লেখেন যে, যারা বাসাবাড়ির মালিক তারা বাবা ছাড়া কেবল মায়েদেরকে ভাড়া দিবে না, চাকরিদাতারা চাকরি দিবে না; বাচ্চাটা স্কুলে ভর্তি হবার সময় বাবার নাম বাধ্যতামূলক।১৯

যে কথা বলছিলাম, সন্তানের জীবন-মৃত্যুর এই সিদ্ধান্তের জন্যে মা কেন নিজেকে একাই দায়ী করবেন; তাঁর একক সিদ্ধান্ত তো আসলে তাঁর উপর সম্পূর্ণ চাপিয়ে দেওয়া। এটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নয়। তার সিদ্ধান্ত হয়তো তাঁকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেয়। কিন্তু তাঁর মানসিক ওলট পালট হওয়াটা কি আদৌ বন্ধ করতে পারে? নাকি পারবে? সন্তান হারানোর কষ্ট এই পৃথিবীতে কিভাবে উপশম হবে। বরং জার্মেইন এর ভাষায় এটা (Growing insult)”. আর তাই তিনি বলছেন, ‘একজন মায়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার জায়গা একেবারেই সামান্য গুরত্ববহনকারী, জার্মেইন এর ভাষায়- The Least important Consideration. আর বাচ্চা রাখা বা গর্ভপাত করানো; দুটো ক্ষেত্রেই তাঁর আপনজনের সাথে মনোমলিন্যের সৃষ্টি হয়।

জেনিথা, লিখছেন মৌলভিবাজর থেকে। যিনি নিজেও একজন সমাজবিজ্ঞানী। নৃবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানে তাঁর পড়াশুনা অনেক গভীর। জেনিথা ইয়াসমিন গর্ভপাতের কাঠামোগত দিকটি হাইলাইট করছেন-

‘আমার বেলায় আর্থিক চাপটা এতোই বেশি ছিল যে, মনে হতো আমি কোনোদিনই একটা বাচ্চা নিতে পারবো না; অথচ আমি কনসিভ করে ফেললাম! কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা একদম স্থবির, ফিক্সড, (Rail Roaded) যেখানে বিকল্পগুলো মনে হলো যে বাচ্চাটা রাখার চাইতে আরও খারাপ হবে। আমি হয়তো বাড়িছাড়া হবো, অথবা স্বামীর যাবতীয় নির্যাতন সহ্য করবো, চাকরি পাবো না, বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারবো না। এমনকি সরকার থেকেও কোনো ধরনের সুবিধা পাবো না। কোনো মা-ই তার পেটের সন্তানকে হত্যা করতে যাবে না, যদি সে সকল সুবিধাদির বন্দোবস্ত পায়। পুরুষ মানসিকতার এই সমাজে মনে হয়, আদিম যুগটাই ভালো ছিল। এমনকি যদি স্বেচ্ছা মৃত্যুর কোনো বিধান বাংলাদেশে থাকতো, মনে হয় অনেক মা সেদিকেই অগ্রসর হতেন। কারণ, এতে করে তাঁর কষ্টের চির সমাপ্তি হতো! আমি এতোটাই অনিশ্চয়তার সাথে ছিলাম যে, আমাকে দুবারই একই পথে হাঁটতে হলো।

নাইমা নাসরিন, কুড়িগ্রাম থেকে লিখেন- গত বৎসর আমি কনসিভ করলাম; বয়স ৪০, স্বামী মহোদয় এমনভাব করলেন যেন আমি এখনই হাসপাতালে যেয়ে গর্ভপাত করে আসি। ডাক্তার জানালেন, আমি প্রায় মাঝবয়সে এসে গেছি, [যেন আমি জানি না আমার বয়স] আমার গর্ভপাত করানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। প্রতিদিন বাসায় মানসিক যন্ত্রণা। স্বামীর উৎসাহ দূরে যাক, মনে হচ্ছিল, এক বস্ত্রেই আমাকে নির্বাসনে পাঠায়! আমার বড়ো দুমেয়ের বয়স ১৯ এবং ১৬! একদিন তারাও আমাকে জানালো যে, তারা নাকি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছে না! আমি হতবাক। সারাদিন আমি এখন রাস্তায় হাঁটি; আর আমার বাচ্চাটাকে খুঁজি…।

পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা

গবেষণার স্বার্থে, এমনকি স্বেচ্চায়ও অনেক পেশাজীবী ডাক্তার, নার্স আমাদেরকে গল্প শুনিয়েছেন। শেয়ার করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা। পেশার বাইরেও কারো গল্প হয়ে ওঠে নিখাদ মানবিকতার। অনুকম্পা আর অনুভূতির। মায়েদের জন্যে। কেবলি মায়েদের।

শাদিয়া মজুমদার, একটি ক্লিনিকে নার্স হিসেবে কাজ করেন প্রায় সাত বছর। বর্তমানে ব্যবসা করেন। নিজের পেশায় আর ফিরে যেতে মোটেই আগ্রহী নন। শাদিয়ার চাকরি ছাড়ার একমাত্র কারণ তিনি দেখেছেন, একজন মায়ের মাতৃত্বের প্রতি কতটা নির্মম নিগ্রহ দেখানো হয়! তিনি দেখেছেন একজন মায়ের উপর অবিচারের জ্বলন্ত রূপ। তার মুখেই শুনি-

যেসব মায়েরা দরিদ্র, চাকরিহীন, বয়সে একেবারেই কম, কিংবা চল্লিশের মতো মাঝবয়সী কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সঙ্গীসাথি নেই, যেমন- যৌনকর্মী, তাদেরকে ক্লিনিক থেকেই বলে দেওয়া হতো গর্ভপাত ছাড়া আর ভালো পন্থা নেই। কান্নারত মায়েদের এই কণ্ঠ বুঝাবার ভাষা আমার নেই। কোনো মাকে রীতিমতো জোর করে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হতো। তারা মিনতি করতেন, এনেসথেসিয়া দেওয়ার পূর্ব মূহূর্তে বাচ্চাটা যদি রাখা যায়! ঘুম থেকে উঠার পর কেউ কেউ দিনভর কথা বলতে পারতেন না। ফ্যালফ্যাল অসহায় শিশুর মতো তাকিয়ে থাকেন! এ কষ্ট সইবার নয়!

ফারিয়া তালুকদার, ময়মনসিংহ থেকে জানালেন যে– গত বছর থেকে প্রাইভেট চেম্বারেই ডাক্তার দেখেন। ক্লিনিকে যান না। তাঁর মনে ভেসে উঠে গর্ভপাত করাতে আসা মায়েদের কান্না আর অসহায়ত্ব। ডা. ফারিয়ার মুখেই শুনি-

It is clear that Bangladeshi society and culture fear a certain type of mothers having a child and I myself found in my experience of ten years that many of doctors,
nurses and owners. I worked and met in abortion clinics were not any different despite their supposed commitment to feminine principles
.

তায়্যিবা আনোয়ারা, ঢাকা থেকে লিখেছেন যে- কোন কোন ক্লিনিকে বরং উৎসাহ দেয়া হয় গর্ভপাত করানোর জন্যে। এবং তাদের উদ্দেশ্যে কেবলই লম্বা একটা বিল আসবে! এবং একই রেফারেন্সে আরও রোগী আসবে। তায়্যিবা জানালেন যে, দুবছর একটা ক্লিনিকে ম্যানেজার পদে থাকার পর চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করছেন।

 আরও বেশ কজন (১২) এবং ডাক্তার (১৩) প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। এইসব লেখা, বলা, উক্তিতে উঠে আসে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধের নমুনা। উঠে আসা এইসব কাঠামোতে গর্ভপাত করে আসা একজন নারীর আপন সিদ্ধান্তের জায়গাটা যে কত সীমিত, কত স্বল্প তা স্পষ্ট। এমনকি কষ্টকর।

অপার্যপ্ত পরামর্শ বা কাউন্সিলিং-

বইটাতে ব্যক্ত গল্পগুলোর আরেকা দিক হলো, গর্ভপাত পূর্ববর্তী সময়ের জন্যে কাউন্সিলিং বা পরামর্শের অভাব। একদিকে স্বামী বা সঙ্গীটির চাপ, কিংবা মায়ের, বাবার, অন্যদিকে মায়ের সিদ্ধান্তহীনতা। আমরা দেখেছি এই সময়টাকে তার জন্যে কোনো পরামর্শ কেন্দ্র, সাইকোলোজিস্ট বা কাউন্সিলিং বরাদ্দ নেই। এমনকি, যে হাসপাতালে যাচ্ছেন, সেখানটাতে তিনি পাচ্ছেন না কোনো মানসিক বা নৈতিক সমর্থন। অথবা পরামর্শ যা আছে তা যেন একজন মায়ের কাছ থেকে ‘ইয়েস’ উত্তরটা পাবার বা কনসেপ্ট কাগজে সই করানোর জন্যই। দুই শতাধিক গল্প আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম। প্রতিটি বাক্য আমি খুব খুঁটিয়ে পড়লাম। একটিতেও গর্ভপাত পূর্ব সময়ে দেখিনি কোনো মা প্রপার এবং পর্যাপ্ত কাউন্সিলিং পেয়েছেন।

সুম্মি রহমান, ঢাকার মতিঝিল থেকে জানান যে তাঁর প্রথম গর্ভপাত হয় যখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। গার্মেন্টস এর চাকরির সুবাদে সঙ্গীর সাথে পরিচয়, প্রেম এবং কনসিভ্ড। আমরা তাঁর মুখেই শুনি-

আমার মা আমাকে একটি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে পাঠালেন। ঢাকাতেই। তারা আমাকে প্রায় দুঘন্টা সময় দিলেন। নানা দিক তুলে আলোচনা করলেন। এবং আমার প্রতি তাদের এই সময় দেবার ফলে আমকে পরদিনই গর্ভপাতের জন্যে বুকিং দিতে হলো। আমি একা এই বাচ্চাকে দেখাশুনা করতে পারবো না; আমার স্থায়ী কোনো চাকরি নেই; আমার পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এবং সবার শেষে আমার স্বামী নেই। শুধু তাই নয়, একজন ডাক্তার বললেন- ‘’You are a stupid teenager pregnant’’. আমি মনে প্রাণে চাইছিলাম যে কারো সাথে কথা বলতে, আলোচনা করতে। কাউকেই পাইনি। অন্তত কেউ একজন বলবে যে, এটা করো না। অন্তত একজন মানুষ বলবে, আমি তোমার পাশে আছি, তোমার গর্ভপাত করাতে হবে না। গর্ভপাতের দিন আমাকে সকালে আরও সাত-আট জন মায়েদের সাথে রাখা হলো একটা রুমে। যেন আমরা কয়েকজন গবাদি পশু! কিংবা ডাস্টবিনে রাখা ময়লার এক একটা স্তুপ!

শাফিয়া মজুমদার, যাকে আগেও আমরা উল্লেখ করেছি, তিনি আরও বলেন যে, ডাক্তাররা এইসব দরিদ্র বা ভালনারেবল মায়েদের সাথে এমন ব্যবহার করতেন যেটা এই পরিস্থিতিতে কোনো মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তাদের সামনে কোনোই বিকল্প দেওয়া হয় না। গর্ভপাত এবং বাচ্চাটা নষ্ট করানো। শাফিয়ার মুখে আরও শুনি-

একদিন মহিলা ডাক্তার এক মাকে যিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী, বললেন, তুমি কি মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করতে চাও? “অবশ্যই”, যুবতী মায়ের সুদৃঢ় উত্তর। ‘Well you can’t have this child at this moment`. একজন মহিলার মুখে এমন কথা মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাঁকে সাহায্য করতে পারছি না- এই অসহায়ত্ব যেন আমায় ঘিরে ধরল। বাথরুমে যেয়ে অঝরে কাঁদলাম। যদি একটু হালকা হই! মানব শিশুর কি নিষ্ঠুর পরিণতি!

জোবায়েদা জাহান, চট্টগ্রাম থেকে জানিয়েছেন, তাঁকে গর্ভপাত পূর্ববর্তী এবং অভিজ্ঞতার এক দুঃখ বিদারী কথা। জোবায়দার মুখেই আমরা শুনি তার গল্প-

আমি এমন এক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, যেখানে আমকে আগে কোনো তথ্য দেওয়া হলো না, কিভাবেই বা গর্ভপাত করানো হবে, নেই সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য। বুকলেট বা পুস্তিকা। গর্ভপাতের পর আমার কি কি হতে পারে সে ব্যাপারেও কোনো ইনফরমেশন নেই। একজন ডাক্তার আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করলেন এবং সেটা অবশ্যই যাতে আমি গর্ভপাতে রাজি হই। দুঃখই লাগে কেউ একজন বললো না, কেন আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হলো? কেন বাচ্চাটাকে রাখা যাবে না? কিংবা আমার জন্যে তারা আর কি করতে পারেন? সবার চোখে মুখের ভাষাটা এমন যেন, আমার শরীরকে তারা গঙ্গাস্নান করিয়ে পবিত্র করছেন। আমারই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

ফাহমিদা ডাক্তার, সিলেট থেকে লিখেছেন। তিনি নৃবিজ্ঞানের স্নাতক। তাঁর মনে হয়েছে তিনি রীতিমতো বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের বাসিন্দা। যার আপন কেউ নেই। তিনি একেবারেই একাকী অনুভব করছিলেন সেই দিনগুলোতে। ফাহমিদার কথাগুলো-

আমাদের পারিবারিক ডাক্তার সাহেব আমার ভেতরে থাকা জীবনটার চাইতে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমার পিতার আর পিতামহের সামাজিক মানমর্যাদা কিভাবে রক্ষা হবে তা নিয়ে। তিনি আমাকে বললেন হয়তো আমাকে মেরে ফেলবেন। খুব খুশি হয়ে আমাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকের কথা বললেন এবং আমার গর্ভপাতের তারিখ ঠিক করলেন। এটাই ছিল আমার সাথে ডাক্তার সাহেবের পরামর্শ। কাউন্সলিং। কোনো চেষ্টাই ছিল না আদৌ কি চাই আমি; কিংবা বিকল্প কী কী হতে পারে, এমনকি সে বিয়ে করবে, যাতে সামাজিকভাবে আমি হেয় না হই; কিংবা সে-ও। কোনো সম্ভাবনারই কিছু হলো না। চুড়ান্ত হয়ে আসলো একটা ফোনালাপ। আমার ডাক্তার এবং ক্লিনিক ম্যানেজারের। এবং এটাই একটি জীবনের নিয়তি।

মিসুক রাণী, সুনামগঞ্জ থেকে জানান যে, তিনি নেট ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু ইনফরমেশন নিয়ে স্থানীয় এক ক্লিনিকে যান। ডাক্তার সাহেবকে এগুলো দেখাতেই বললেন, ‘তোমাদের মতো স্মার্ট মেয়েদের নিয়েই যত্তসব ঝামেলা’।

কোনাল আবরার, হবিগঞ্জ থেকে এবং ময়নামতি শেখ, ফরিদপুর থেকে প্রায় একই সুরে জানালেন তাঁদের প্রথম জীবনের গর্ভপাতের কথা। ডাক্তার এবং নার্সদের রূঢ় আচরণ এবং ব্যবহারের শিকার হন। কনক হালদার, রূপ মজুমদার জানাচ্ছেন একই অভিজ্ঞতার কথা। ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য পেশাজীবী যারা গর্ভপাতের সাথে সংশিষ্ট তাদের কারো কাছ থেকে মায়েরা কোনো সদ্বব্যবহার পাননি। কিছু কিছু নারী জানিয়েছেন যে, তারা সিম্পলি ‘Tortured’ ডাক্তার, নার্স প্রত্যেকের দ্বারা। জায়রা জিলান, ঝিনসাইদহ থেকে, যাঁকে আমরা আরও কোট করেছি। তাঁর মুখে আরও কিছুটা কথা শুনি-

ডাক্তার যখন আমাকে উনার সময় দিলেন, চেম্বারে যাবার পর প্রথম প্রশ্নটিই ছিল- ‘কবে আপনার সুবিধা হবে?’ যেন তিনি ডাক্তার নন। কল সেন্টারের এপোয়েন্টমেন্ট সেটার। আজ আমি যখন পিছন ফিরে তাকাই; মনে হয় কেউ যদি আমাকে বলতো, তোমার বাচ্চা নষ্ট করতে হবে না, চলো, দেখি বিকল্প কি আর পথ খোলা আছে। এবং তুমি যদি না চাও, তাহলে গর্ভপাত করানোর প্রয়োজন নেই। …নিষ্ঠুর এই সমাজে আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হলো। যে সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আজো আমি কাঁদছি, কাঁদবো নিরন্তর।

কাঠামোগত বিশ্লেষণে, এখানে সমাজ ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থায় থাকা বিশ্বাস মূল্যবোধ, বিশ্বাস, মহিলাদের উপর প্রাধান্য, পুঁজিবাদী সমাজের ধরন এবং পুঁজিবাদের মানসিকতা সাকুল্যে দায়ী। এবং দায়ী আধা-সামন্ততান্ত্রিক- আধা পুঁজিবাদী কিংবা পুরোটাই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো।২০ মায়েদের মনস্তাত্ত্বিক/মানসিক চাপ কি হবে, সে বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্য বা সতর্কতা ডাক্তারদের বা সাইকোলোজিস্টদের কাছ থেকে দেওয়া হয়নি। বাংলদেশের প্রেক্ষাপটে যদিও সাইকোলোজিস্টদের আনাগোনা মূলত একাডেমিক কার্যক্রমেই সীমিত। আমরা এখনো সাইকলোজিস্টদের কাউন্সিলিং-এ এতোটা অভ্যস্থ নই। আমরা মানে সাধারণ মানুষ সকল। আর গর্ভপাত করাতে আসা মায়েরা তো অনেক দূরের ছায়ামাত্র। তিরিশ বছর আগে কেবি পিটারসন২১ লিখেন, অস্ট্রেলিয়াতে গর্ভপাত সংক্রান্ত কাউন্সিলিং এর দুটো অসুবিধা আছে। প্রথমত, গর্ভপাত কাউন্সিলিং সহজলভ্য নয়। দুই, কাউন্সিলিং সরকারি-বেসরকারিভাবে সকল মায়েদের বেলায় বিনামূল্যে করে দেওয়া উচিত যাতে একজন মা গর্ভপাত-এর আগের এবং পরের সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পেতে পারেন; এবং এমন একটি সিদ্ধান্ত নেন যাতে পরবর্তীতে তাঁর নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে না যান। বাংলাদেশে আজ আমরা পিছিয়ে আছি। ‘নৈতিক’ অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করছি। এবং যেহেতু প্রায় আমি পঁচাশি শতাংশ মসলিম জনগণ এবং যেহেতু আমরা ধর্মীয় এই ফ্যাক্টরকে এড়িয়েও যাচ্ছি না।

বিশেষ প্রক্রিয়াটি-

সিলেটের চিত্রালী মিশা, যাকে আগেও আমরা দেখেছি, স্বামীর সন্তুষ্টির জন্যে গর্ভপাতে রাজি হয়েছিলেন। আবারও আমরা তাঁর মুখে শুনি-

আমরা খুব মনে পড়ে সেই ভয়ালতম দিনটির কথা। সেদিন খুব মেঘলা আকাশ। ঝড়ো বুনো বাতাস। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছিল যদি একটি বজ্রপাতে আমি… মুক্তি পেতাম। ডাক্তারদের কাছে আমি কোনো রোগী ছিলাম না, বরং যেন এক পাপ করে আসছি এবং তারা আমার পাপ মুক্তি করাবেন। নিজেকে খুব ছোটো মনে হচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠেই তার দিকে তাকালাম, মনে হলো কেবল যে, এই লোকটাই আমার ছোটো শিশুটাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো…

নীলা আহমেদ রাণী, চট্টগ্রামের মানুষ। লিখছেন সেই দিনটির কথা। যিনি চট্টগ্রামের কোনো ক্লিনিকই তাঁর জন্য নিরাপদ মনে করেননি। কিন্তু, ঢাকাতেও দেখলেন সে একই চেনা রূপ। ডাক্তারদের, নার্সদের। এমনকি আয়া, বুয়া যারা আছে তারাও যেন সবাই তাঁকে তাচ্ছিল্যের সাথে দেখছে। তাঁর আপন কথা-

যেসব ডাক্তাররা আমার সাথে কথা বললেন মনে হলো তারা সবাই আমার প্রতি রুঢ়। কোনো সংবেদনশীলতা নেই, আচরণে, কথায় এমনকি মুখের ভাবভঙ্গীতেও। ভেতরে ভেতরে আমি জ্বলে মরছিলাম। গলা শুকিয়ে আসছে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছি। একজন আয়াকে পানির কথা বলতে উনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে, মনে হলো আমি বিশাল এক অন্যায় করেছি। বালিশে মাথা রেখে জানালার বাইরে দেখছিলাম। ডাক্তার, নার্স সবাই হাসি-খুশি। শব্দ করে হাসছেন। কথা বলছেন। আমরা তিনজন এক রুমে। কারণ মুখে কোনো কথা নেই । এমনকি আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানোর কথা মুহূর্ত পর্যন্ত তারা সবাই হাসছিলেন এবং সার্জারির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তারা হাসতে হাসতে আমাকে ঘুম পাড়ালো এবং আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেললো….

সাভারের মাধবী চৌধুরী, যাকে আগেও আমরা দেখেছি। মাধবীর মুখে আরও কিছু শুনি-

একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে যখন আমি গেলাম। অপারেশন থিয়েটারে যেতে যেতে শুনলাম পুরো ভল্যুমে টেলিভিশন বাজানো হচ্ছে। নার্স, ডাক্তাররা হাসি-খুশি। কোনো অনুষ্ঠান হলের যেন প্রামাণ্য চিত্র।

নাহার বানু, একজন বুয়া হিসেবে কাজ করতেন এক বাসায়। গৃহকর্মীর অনুপস্থিতিতে কর্তা কর্তৃক কনসিভ করেন। এবং পরবর্তীতে একটি সংস্থার বদৌলতে গর্ভপাত করান। সেখান থেকেই তিনি পড়াশুনা করেন। এখন একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। লিখছেন ঢাকা থেকে-

অপারেশন থিয়েটার থেকে পোস্ট অপারেটিভে আসলাম। সন্ধ্যার দিকে তাকে বাড়ি আসার জন্যে নার্সরা চাপ দিতে থাকেন। তাদের নাকি আরও রোগী আছে। জায়গার অভাব। এবং গর্ভপাত করাতে আসা মায়েরা আদৌ কোনো রোগী নন ডাক্তারদের চোখে। নার্সদের, পুরো ক্লিনিকের।

উত্তর দেওয়া এসব গল্পগুলো আমরা সম্পূর্ণ উল্লেখ করছি না, এমনকি প্রত্যেকটিও নয়। বরং অনলাইন এবং সাক্ষাত গ্রহণের ভিত্তিতে আমরা মোটা দাগে কিছু কিছু বিষয় আলোকপাত করেছি মায়েদের পাঠানো গল্প থেকে।

গর্ভপাত পরবর্তী সময়-

কোনো ব্যতিক্রম নেই। পুরো একশত ভাগ গল্পে যে বিষয়টা একদম প্রতীয়মান। এবং গর্ভপাত পরবর্তী সময়ে মায়েদের শারীরিক এবং মানসিক কী প্রভাব পড়তে পারে।
ডাক্তার, নার্সদের কাজটাই ছিল বাচ্চাটাকে কেবল শরীর থেকে বের করে দেওয়া। একজন মায়ের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে একজনকেও কোনো
ধরনের তথ্য উপাত্ত ধারণা দেওয়া হয়নি। গর্ভপাতের প্রক্রিয়া এবং এর প্রভাব বিষয়ে মায়েরা রীতিমতো অন্ধকারেই আছেন। থেকেছেন। অনেকেই বলেছেন যে, তাঁদের
সাথে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। পরিবার থেকে। হাসপাতাল থেকে। এবং সমাজ অবশ্যই।

মালিনী ব্যানার্জী, গোপালগঞ্জ থেকে বলছেন

ডাক্তার, নার্স কেউ আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেননি। আমি ভেবেছিলাম কেবলই ভ্রূনটাকে নিয়ে আসবে। অথচ আমার নিজের কানটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না; তারা বলছেন, ‘নয় সপ্তাহের স্বাস্থ্যবান ভ্রূন, কী সুন্দর…

কাহহারা রাহেনা, নরসিংদী থেকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন

সাত বছর প্রায়, অথচ মনে হয়, এই মাত্র সেই দিন! আমার স্পষ্টত মনে আছে, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার জীবনের সবকিছু পালটে গেল। স্নেহময়ী মা থেকে আমি হয়ে গেলাম ঘাতকীনি! লোকাল এনেসথিসিয়া ছিল বলে আমি ঘুমাইনি। আমি শুনছিলাম। কাঁচির আর চাকুর শব্দ। আমার শরীর কাঁপছিল। উত্তেজনায়। ভয়ে। একজন নার্স প্রায় ধমকের সুরেই বলে ‘চুপ করে থাকেন’। প্রচণ্ড শীতল একটা অনুভূতি হচ্ছিল। ধারালো কোনো কিছু দিয়ে একটা জীবনকে কেটে ফেলা হচ্ছে এই চিন্তা আমায় যেন গ্রাস করে ফেলছে!

আমার এখনো কানে বাজে, দুই পায়ের মধ্য দিয়ে প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু একটা পড়ছে এবং সাথে সাথে মনে হলো আমার সন্তানটা পড়ে গেলো। এবং সাথে সাথে কার গলা যেন ‘ওয়েলডান’ সেই পাত্রে পড়ে যাবার শব্দের আতঙ্কে আজো আমি অস্থির! আমি কোনো বাচ্চা নেইনি আর। আমি সংসার করতে যাইনি! এ কষ্ট আমার প্রাপ্য।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, মায়েদের মনস্তাত্তিক ট্রমা বা আঘাতটা সাথে সাথেই ঘটে। সাথে সাথে যখনই এনথেসিয়া থেকে তারা উঠেন। কিংবা অপারেশন থিয়েটারেই, যাদেরকে লোকাল অচেতন করা হয়। আতঙ্কের শুরুটা সেখানেই। নাম বা ঠিকানা কিছুই দেননি; একজন মা লিখেছেন,

এনেসথেসিয়া থেকে জেগে উঠার পর পরই মনে হলো আমি জঘন্যতম একটা অপরাধ করে ফেলেছি। মনে হলো আমার বাচ্চার আত্মাটাকে তারা কোথায় নিয়ে গেলো? মনে হলো কেউ যেন আমার বুকের ভিতর থেকে কিছু একটা ছিনিয়ে গেছে। শুধুই মনে হতে লাগলো, আমার বাচ্চা কোথায়?

প্রায় সত্তর শতাংশ মায়ের শারীরিক সমস্যা আমরা পেয়েছি। মানসিক কষ্ট সবারই। কিন্তু, সত্তর ভাগ মায়েদের গর্ভপাত পরবর্তী শারীরিক সমস্যা দ্রষ্টব্য। অবিরাম রক্তপাত, ইনফেকশন হওয়া, এবং বাচ্চা না হওয়া ইত্যাদি সমস্যা তালিকায় আসছে। নাঈমা জাহান, রুবা বেগম, শাহিনা আক্তার, মিনতি রানী, ফাতেমা জাহান, শওকত বানু, এদের প্রত্যেকেই লিখেছেন, চারদিন পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হয় কেবল রক্তপাতের কারণে। এবং ডাক্তার কেবল ইনজেকশন আর এন্টিবায়োটিক দিচ্ছিলেন।

আরেফিন সোমার অভিজ্ঞতা খুবই নাজুক। তাঁকে দ্বিতীয়বার হাসপাতালের থিয়েটারে যেতে হয়। একই বাচ্চার গর্ভপাতের জন্যে। অনেকেই ব্যথায় কাতর হয়ে আবারও হাসপাতালে বা ক্লিনিকে গিয়েছেন। ডাক্তার তাঁদেরকে আরেক ডোজ এন্টিবায়োটিক আর কড়া মাত্রার পেইন কিলার দিয়ে বিদায় করেন। দুইশত মায়েদের মধ্যে একশত বত্রিশজনকে আমরা দেখি গর্ভাশয়ে ইনফেকশন নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন। এবং অধিকাংশই গিয়েছেন অন্য কোনো মহিলা গাইনোকোলোজিস্টদের কাছে। নিরাপদ এবং আরও একটু ভালো চিকিৎসার জন্যে।

মিথিলা রহমান, যিনি গর্ভপাতের পর হাসপাতালে ছিলেন দুই সপ্তাহ। পরবর্তীতে আবারও হাসপাতালে যান। এবং সর্বশেষ মানসিক ডাক্তারের কাছে। যিনি রাতে তাঁর বাচ্চার কান্না শুনতে পান। সামরিক অফিসার বাবার সুবাদে তাঁকে ইলেক্ট্রিক শক থেরাপির মধ্যে দিয়েও যেতে হয়।

বেশ কিছু মায়েরা লিখেছেন তাঁদের আর কোনো সন্তান হয়নি, [৩২/২০০] এবং তিপান্নজন মা সন্তান হবে না সেই ভয়ে আর বিয়ে করেননি। বিশজন মা সন্তান মেরে ফেলার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আর সংসারী হননি।

ফিরে দেখা সমাজ আবার-

পরিসংখ্যানের গোলমেলে হিসাবকে বাইরে রাখলেও আমরা দেখি, যেসব মা গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, গড়ে প্রায় ষাট ভাগ মা-ই আর সাধারণ জীবনে আসতে পারেননি। কেউ কেউ বলছেন, গর্ভপাত আর কার্ভিকাল (Cervical) ক্যান্সারের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা। [ডাক্তার মহাশয়রা ভালো জানবেন] আমি ডাক্তার নই এবং এটা মেডিকেল বিষয়ক কোনো গবেষণা পত্রও নয়, যার ফলে আমি শারীরিক সমস্যাজনিত কারণগুলো বিস্তৃত বলতে পারছি না। কিন্তু, আমার ধারণা, মেডিকেল সংক্রান্ত একটা ভালো কাজ কেউ করতেই পারেন।

এই বইয়ে যেসব কেইস এসেছে, সেগুলো মূলত গর্ভপাত পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা। একটু নির্দিষ্ট করে বললে, মায়েদের অবিরাম কান্নার কথা, আপন সন্তানকে নিয়ে মায়েদের স্বপ্নের কথা। বাচ্চার জন্ম হবার তারিখকে মাথায় রেখে মায়ের প্রতিক্রিয়ার কথা। সন্তানকে নিয়ে মায়েদের ফ্যান্টাসির। দুঃখের। অসাঢ় আবেগের। নির্ঘুম রাতের। এলোমেলো রাতের। প্রতীক্ষারী সকালের। ক্রোধ এবং অসহায়ত্বের। আর এই বইটি সেইসব মায়েদের যারা মনপ্রাণ ব্যাকুল করা, তৃপ্ত করা ‘মা’ ‘মা’ ডাক শুনবেন বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এবং যে ডাক বাংলাদেশের আলো বাতাসে আর কোনোদিন প্রতিধ্বনিত হবে না। সেই স্বপ্নে ভেসে বেড়নো ‘মা’ ডাকার গল্প। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা গল্পের অর্থাৎ গর্ভপাত সংক্রান্ত এথিকস নিয়ে লিখছি; একই অধ্যায়ে লিখবো আমাদের কাজের ক্ষেত্রে নৈতিকতা বা এথিকস বা মরালিটির বিষয়ে।

(চলবে…)

রেফারেন্স :-

১. George Devereux (1976)
২. Aahman and Shah (2008)
৩. WHO (2003)
৪. Segdh et.al (2007)
৫. WHO (2009, p.13)
৬. WHO (2007)
৭. Centre for Reproductive Rights (2008)
৮. ৫ম অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে
৯. আব্দুল করিম এবং খাজা ফরিদের মাঝে প্রচুর মিল আছে। অতীন্দ্রীয়বাদ আর আধ্যাত্ববাদ দুজনের দর্শন। বৃষ্টি আর পানি দুজনের উপজীব্য। দেহতত্ত্ব দুজনের আরক। গৃহত্যাগী মানসিকতা দুজনের মননে। আগ্রহীরা পড়তে পারেন।

  1. Writing as Resistance The phrase ‘Writing as Resistance’ ‡bqv n‡q‡Q Writing as Resistance: Four women Confronting the Holocoust (Rachel Feldhay Brenner, university Park, Pennsylvania State university press, 1997), which features the writing of prominent Jewish women from World War ii, Etty Hilesum, Anne Frank Simone Weil and Edith stein. The pioneering work For example, Robyn
    Rowland, Living Laboratories: Women and Reproductive Technologies (Bioomington: Indina university press1992) Janice Raymond, Women as Wombs: Reproductive Technologies and the Battle over Women’s freedom (New Yourk: Harper 1993); Patricia Spallone, Beyond Conception: The new politics Reproduction (London: Macmillan education, 1989) and Renate Klein (ed.), Inferlity. Women speak out their experience of reproduction medicine (London Panodra press, 1989).

১১.The Abrotion Myth নামে একটি বই আছে আগ্রহীরা পড়ে দেখাতে পারেন | The Politics of Reproduction নামে আরেকটা বইয়েও মোটামুটি আলোচনা হয়েছে।
১২.Margaret Nicol, Loss of a Body: Understanding Maternal Grift, Barton Books, Syney, 1984, p. 87
১৩. Undated, Newspaper of Australia
১৪. E. J. Anselo (1996, p.: 46)
১৫. অমর্ত্য সেন অন্তত এই দর্শনের কথাই বলেন।

১৬. টেলিফোনিক ইন্টারভিউ‌

১৭. The Femimine Mistake, the Sydney Morning Herald, May 9, 1992
১৮.  German Greer (1999) The Whole Women, Double day.
১৯. কোনো সভ্য দেশে আমি এটা দেখিনি। [একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: তখন সবেমাত্র মাস্টারিতে জয়েন করেছি। অর্থনীতি বিভাগের ড. রেজাই করিম স্যার এক সভাতে বলেন যে, এডমিশন

কর্মে মায়ের নাম থাকলেই তো হলো। দাঁড়িয়ালি এক অধ্যাপক নাকি বলেছিলেন যাদের বাবার

ঠিক নেই, আপনার মতো, তাদের জন্যে রাখা যেতে পারে। ভদ্রলোক রেজাই স্যার আর তর্ক

বাড়াননি। কাউন্টার দেওয়া ঐ অধ্যাপক ছিলেন তখন সাদা দলে মানে বিএনপি ঘরানাতে।

কাউন্টার দেবার কারণও ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, বলাই বাহুল্য। আবার এখন সেই কাউন্টার

দেওয়া অধ্যাপকই নাকি রেজাই স্যারদের নীল বেশধারী দলে!]

২০. বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর বিশ্লেষণে অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী আধা-সামান্ত

তান্ত্রিক আধা-পুঁজিবাদী বলছেন। আন্যদিকে, বাম ঘরানার চিন্তাবিদরা পুঁজিবাদী বলতেই

অভ্যস্ত। যেমন- ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। বিস্তারিত উনাদের লিখাতে আছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী ব্যবস্থা [স্থান, চর ইত্যাদি] এখনো টিকে

আছে।

২১. Kery Petersonk, Abortion Counselling in Australia, in Australia
Jounal of sex, Marlase & Family, 6:0, (1985)93-103

+ posts

Read Previous

বামিহাল সাহিত্য পুরস্কার, ২০২২ ঘোষণা

Read Next

সমুদার অভিযান

One Comment

  • This is indeed an excellent piece of work. It is drawn from the ground. The subjects talk for themselves and the message is clear. This type of work needs to reach more people.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *