অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইলিয়াস ফারুকী -
অসাম্প্রদায়িক বিশ্বজনীন কাজী নজরুল ইসলাম

পৃথিবী যখন অস্থির হয়ে ওঠে। অনিয়মে ভরে যায়, তখন সে নিজেই ঠিক করে নেয়, কে তার পক্ষে রক্ত দেবে আর কে তার পক্ষে শব্দের প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আর এ ক্ষেত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একের ভেতরে দুই। তাঁর অসি এবং মসি এক সঙ্গে গর্জে উঠেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হয়েছিলেন ফ্রান্স জার্মানির স্বৈরাচারিতার বিরুদ্ধে। আবার স্বদেশের জন্য কলম ধরেছিলেন ব্রিটিশ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সর্বকালের মানুষের মাঝে একটি দীপ্ত শিখা হয়ে আছেন।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা। গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী কিংবা নাটক সকল বিভাগেই ছিল তার স্বাচ্ছন্দ্য। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং পরে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি। তিনি নয় বছর বয়সে পিতার মৃত্যূর পর পিতার কর্মস্থলে তাঁর রেখে যাওয়া শূন্য স্থানে কাজ শুরু করেন। তাঁর প্রাথমিক জীবনে ইসলামের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন এবং তা চর্চা করেন যা তাঁর পরবর্তী জীবনে তাঁর সাহিত্যে প্রচুর প্রভার সৃষ্টি করেছিল। কাজী নজরুল তার জীবনের শুরুতে তাঁর চাচা কাজী বজলে করিমের সান্নিধ্যে আসেন যিনি নিজে একজন লেটো গানের দলের লোক ছিলেন। কবি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর সেই ঘনিষ্ঠতাই তাকে লেটো গানের দলে ভিড়িয়ে দেয়। এই লেটো গানের দলে থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। তাঁর এই কর্ম অভিজ্ঞতার আলোকে স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একই সাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। এ সকল চর্চায় তার জীবনে প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং সেই বয়সেই তিনি বেশ কিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন যেমন, চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, কবি কালিদাস, রাজপুত্রের গান, বিদ্যাভুতুম ইত্যাদি। সেই ছোট বয়সেই তাঁর উপর মনুষত্বের যে ছাপ পড়েছিল তা থেকেই তিনি হয়েছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক। তাঁর জীবনে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় যিনি ধর্মীয় বিশ্বাসে ছিলেন সনাতন এবং অপরজন ছিলেন শৈলেন্দ্র কুমার ঘোষ যিনি খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী।

নজরুল তাঁর জীবনে এক সময় প্রচুর শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছিলেন। তিনি অনেক দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলে কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনোটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

লেটো দলে থাকা অবস্থায় সেখানে তিনি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সেখান থেকে চলে আসার পর তাকে নিয়ে অন্যরা গান রচনা করে ফেলে যেমন, ‘আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন/ ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদমনে/ নামেতে নজরুল ইসলাম, কী দিব গুণের প্রমাণ।’ লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে আবারো স্কুলে ভর্তি হলেও সেখানে তিনি বেশিদিন তাঁর শিক্ষা জীবন চালিয়ে যেতে পারেন নাই। তাঁর প্রতিভায় প্রভাবিত হয়ে মাথরুণ স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক এবং সে সময়ের বিখ্যাত কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক বলেছিলেন, ‘ছোট সুন্দর চনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল।’

অর্থনৈতিক কারণে ১৯১৭ সালে মাধ্যমিক পরিক্ষা না দিয়ে তিনি সৈন্য বাহিনীতে যোগদেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। এই সময় তিনি সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়াটার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেন। ওই সময় রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলভির নিকট তিনি ফার্সি শিক্ষা গ্রহন করেন। করাচি সেনানিবাসে বসেই তিনি তার প্রথম গদ্য ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ রচনা করেন। একই সাথে ১৯১৯ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়, তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়ে। এ সময় তিনি বেশ কিছু গল্প রচনা করেন যেমন, হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। করাচি সেনানিবাসে বসে তিনি কলকাতার বেশ কিছু পত্রিকার সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাতবঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যপত্রিকা। এ সকল সূত্রে বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনের শুরু করাচি সেনানিবাস থেকেই। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে এবং তাঁর রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

১৯২০ সালে সৈনিক জীবন শেষ করে কলকাতায় ফিরে এলে তার জীবনের এক বিশাল মোড় ঘুরে যায়। ১৯১৮ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘মুক্তি’ নামে যে কবিতা পাঠিয়ে পরিচিত হয়েছিলেন এবার সশরীরে তার সম্পাদক কমরেড মোজাফফর আহ্‌মদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। কমরেড মোজাফফর আহ্‌মদ ছিলেন সন্দীপের মানুষ। তিনি ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতিতে তিনি কাকা বাবু নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত এই বরেণ্য রাজনীতিবিদের সান্নিধ্যে এসেই কবি সাম্যবাদের প্রতি দারুণভাবে প্রভাবিত হন। তিনি কমরেড মোজ্জাফর আহ্‌মদের এতটাই ভক্ত হয়ে ছিলেন ব্রিটিশরা যখন কমরেড মোজাফ্ফর আহ্‌মদকে বন্দি করে সেই সময় তাঁর বিপর্যস্ত পরিবারের নিকট সন্দীপেও ছুটে যান কবি।

তখন ভারতবর্ষে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন। সে সময় কবি কুমিল্লায়, সেখানে তিনি ১৭ দিন অবস্থানকালে ২১ নভেম্বরে ভারতব্যাপী হরতাল কালে রাস্তায় নেমে আসেন। তিনি মিছিলের সাথে গানে গানে শহর প্রদক্ষিণ করেন, ‘ভিক্ষা দাও। ভিক্ষা দাও। ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ তাঁর সে সময়কার প্রতিটি গান ও কবিতায় ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ জেগে উঠেছিল।

বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পর ধূমকেতু পত্রিকা এক বিশেষ সম্মানের স্থানে দাঁড়িয়ে যায়। এবং ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবের ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সে সময় ধূমকেতু পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধুমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’

ধূমকেতু পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর ব্রিটিশরা নড়েচড়ে ওঠে। ৮ নভেম্বর পত্রিকাটির উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এবং একই দিনে কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে একটি জবানবন্দি দেন। যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করে।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করা এবং তৎকালীন এর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। নজরুল যখন বন্দি জীবনে কাটাচ্ছেন ঠিক তখনই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। যা কবি নজরুলকে বিশেষভাবে উল্লসিত করে, এবং সেই আনন্দে তিনি জেলে বসেই ‘আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন।

সৃষ্টিশীল নতুন যে কোন কিছুকেই নজরুল ইসলাম স্বাগত জানিয়েছেন। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে আসার পর কমরেড মোজাফফর আহ্‌মদ যখন কমিউনিস্ট পাটি গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন ঠিক তখনই নজরুল লিখলেন ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!

ঐ নতুনের কেতন উড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।’

এ প্রসঙ্গে মোজাফফর আহ্‌মদ নিজেই লিখেছেন— ‘১৯২১ সালের শেষাশেষিতে আমরা এদেশে কমিউনিষ্ট পার্টি গড়ে তুলব স্থির করেছিলাম। কাজী নজরুল ইসলামও আমাদের এই পরিকল্পনায় ছিল। রুশ বিপ্লবের ওপরে যে সে আগে হতে শ্রদ্ধান্বিত ছিল সে কথা আমি আগেই বলেছি। আমাদের এই পরিকল্পনা হতেই সৃষ্টি হয়েছিল তার সুবিখ্যাত “প্রলয়োল্লাস” কবিতা। তার সিন্ধু-পারের আগল ভাঙ্গা মানে রুশ বিপ্লব। তার প্রলয় মানে বিপ্লব। আর জগৎ-জোড়া বিপ্লবের ভিতর দিয়েই আসছে নজরুলের নূতন, অর্থাৎ আমাদের দেশের বিপ্লব। এই বিপ্লব আবার সামাজিক বিপ্লব।’ (সূত্র : মুজাফফর আহমদের লেখা কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা গ্রন্থ পৃষ্ঠা ১০৩, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশিত সংস্করণ, কলকাতা।)

কমরেড মোজাফফর আহমদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, করাচি সেনা নিবাসে থাকা অবস্থায় কবির উপর রুশ বিপ্লবের প্রভাব পড়ে ছিল যা তাঁর ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ ও ‘মুক্তি’ কবিতায় স্পষ্ট। অর্থাৎ কবি নজরুল শুধু স্বদেশ আন্দোলনে আবদ্ধ থাকেননি। তিনি রুশ বিপ্লব থেকেও অনুপ্রানিত হয়েছিলেন যা তার দেশপ্রেমকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল।

নজরুল ইসলামের উপর রবীন্দ্র চেতনা কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা বোঝা যায়, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধে যাওয়ার সময় নজরুল সঙ্গেঁ নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের স্বরলিপির বই। এতেই স্পষ্ট হয় যে স্কুলে পড়ার বয়সেই নজরুলের সঙ্গে রবীন্দ্র রচনার সম্বন্ধ সৃষ্টি হয়েছিল। নজরুল যে সব গল্প লিখেছেন সেখানে কুড়ি–পঁচিশ জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করা হয়েছে। (সূত্র : আন্তর্জাতিক নজরুল, লেখক জিয়াদ আলী, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৬)।

নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা রবীন্দ্রনাথের উক্তি দিয়ে কবি জিয়াদ আলী একই বইয়ের একই পৃষ্ঠায় আরও বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন কীভাবে তাঁর ‘আমি’ ও ‘আমরা’ হিন্দু আমি ও হিন্দু আমরা হয়ে গেছে। নজরুলের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এক বিদ্রোহী কবিতা ছাড়া নজরুলের অন্যান্য বহু লেখায় ‘আমরা’ শব্দটা শুধু সর্বনাম রূপেই ছড়িয়ে আছে। নজরুলের প্রলয় ভাবনায় জগৎবাসী, বিশ্ব নিখিল ব্যোম, দুনিয়া, পৃথিবী, কৃলমুলুক, ধরা , বিশ্ববাসী, জগৎমাতা ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার তার সমষ্টিগত বৈশ্বিক ভাবনা থেকেই উঠে এসেছে।”

নজরুল শুধু অসাম্প্রদায়িক কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্বমাত্রিক সর্বজনীন মানবিক কবি। তিনি ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, মজুরের কবি। এই কৃষক শ্রমিক, মজুরকে তিনি কোন ধর্মের বর্মে আলাদা না করে তাদের বঞ্চনা ও অবহেলাকেই প্রধান্য দিয়ে মানবতাকে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তাঁর কৃষকের গান কবিতায় স্পষ্টই আহবান জানিয়েছেন ‘ওঠরে চাষী জগৎবাসী ধর কষে লাঙ্গল’ কিংবা ‘এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।’ একইভাবে শ্রমিক নিয়ে তাঁর শ্রমিকের গান কবিতাতে আছে, ‘এবার জ্বলবে জগৎ কয়লা কাটা/ ময়লা-কুলির সেই অনল।’

অনেকে তাঁকে নাস্তিক হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর রচনাই এসবের সার্থক জবাব দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতা ও নাস্তিকতা যে এক বিষয় নয় তা তাঁর ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তার এই কবিতায় তিনি সৃষ্টিকর্তার নিকট ‘ফরিয়াদ’ জানিয়েছেন।

তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথিবী সকলে করিব ভোগ

এই পৃথিবীর নাড়ি সাথে আছে সৃজন দিনের যোগ।

এই ধরণীর যাহা সম্বল,

বাসে ভরা ফুল, রসে ভরা ফল

সুস্নিগ্ধ মাটি, সুধাময় জল, পাখির কণ্ঠে গান

সকলের এতে সম অধিকার, এই তার ফরমান

ভগবান! ভগবান!

তোমার…

কবিতাটা পড়লেই বোঝা যাবে অসাম্প্রদায়িকতার কী সুন্দর উদাহরণ কবিতার শিরোনাম ফরিয়াদ, আবার লিখছেন— ফরমান, কার নিকট। তিনি তার সেই ভগবান! ভগবান!

নজরুল জন্মেছিলেন পৃথিবীর এ ভূখণ্ডে । যখন এ ভূখণ্ড পরাধনীতার শেকলে আবদ্ধ। কিন্তু তিনি ছিলেন পুরো স্বাধীন। একজন যুগস্রষ্টা কবি। নজরুল আঞ্চলিক ভাষার কবি হয়েও বিশ্বজনীন। তিনি লিখেছেন বিশ্বের সকল পরাধীন, গরিব-দুখি সর্বহারাকে নিয়ে। তাঁর প্রতিবাদের ভাষাও ছিল একক ও অনন্য। নজরুল কখনো ধর্মাচ্ছন্নমুখী জাতীয়তা নির্মাণের কবি ছিলেন না। তাই তো তিনি যেমন শ্যামা সংগীত রচনা করেছিলেন, তেমনি বহু প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সংগীতের স্রষ্টা। তিনি কৃত্রিমতার বসতঘরমুখী বাঙালিয়ানা ছাড়িয়ে, সংকীর্ণ মানসিকতার সকল তত্ত্বকে অতিক্রম করে, পৌঁছে গেছেন বিশ্ববাণী সৃষ্টির বৌদ্ধিকতায়।

 

+ posts

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *