অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইলিয়াস ফারুকী -
কিশোর বিদ্রোহী সুকান্ত ভট্টাচার্য

C:\Users\Administrator\Desktop\Probondho_Pic\Elias Faruki.jpg

গ্রামের আলপথে হাঁটতে হাঁটতে প্রকৃতি দেখলেই মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা। জীবনের বাঁক, ছন্দ, অছন্দ ভালোবাসা, রাগ, আবেগ দেখলে রবীন্দ্রনাথই প্রথম আসেন। পল্লির সৌন্দর্যে ভেসে উঠে পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীনের অবয়ব। কিন্তু কিশোর বিদ্রোহী কবি তো একজনই। কিংবা যুবক নজরুলের প্রতিকৃতি তো একজনের মাঝেই ঝলকে উঠেছিল। যিনি পূর্ণিমার চাঁদে দেখেছিলেন ঝলসানো রুটি, যার কলমে ছিল রানারের দুঃখগাঁথা, তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুকান্ত ছিলেন জীবনঘনিষ্ঠ কবি। তার কবিতায় সে সময়ের আশা-নিরাশা কিংবা কঠিন কষ্টের অস্থির যন্ত্রণা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। ‘এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম’ তার ভেতরের খেদ বোঝার জন্য তার কবিতার এই একটি লাইন যথেষ্ট।

সুকান্ত একজন বেদনার কবি, সর্বহারার কবি। তিনি পুশকিন-মায়াকোভস্কি যুগকে তুলে ধরা, জাতিকে সচেতন করা কবি। তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু অরুণাচল বসুকে আটাশে ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন : ‘দৈবক্রমে এখনো বেঁচে আছি, তাই এত দিনকার নৈঃশব্দ্য ঘুচিয়ে একটা চিঠি পাঠাচ্ছি— অপ্রত্যাশিত বোমার মতই তোর অভিমানের ‘সুরক্ষিত’ দূর্গ চূর্ণ করতে’। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাপানি বোমার টার্গেট কোলকাতা। শহর ছেড়ে আপন পর সকলেই নিরাপদ দূরত্বে দৌড়াচ্ছেন। কিন্তু সাহসী সুকান্ত কোলকাতার বাড়িতে একা, চিঠিতে জাপানি বিমান আক্রমণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বন্ধুকে।

অরুণাচল বসুও কবিতা লিখতেন। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালে কবিতা লেখার সুত্রেই ওদের গভীর ও নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাই তো দেখা যায় যে অরুণাচল যখন কলকাতা থেকে দূরে চলে যান তখনও মনের কথা জানিয়ে তাকেই চিঠি লিখতেন কবি। সুকান্ত অরুণাচলের মা-বাবার সান্নিধ্য পছন্দ করতেন। অরুণাচলের মার মাঝে নিজের মায়ের ছায়া খুঁজে পেতেন দুটো কারণে। অরুণাচলের মাও লেখালেখি করতেন এবং বেশ ছোটবেলা সুকান্ত মাকে হারিয়েছিলেন বলে অরুণাচলের মায়ের মাঝে নিজের মাকে দেখতে পেতেন।

বেলেঘাটার কমলা বিদ্যামন্দিরে সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাহিত্যে হাতেখড়ি। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন তার নিজের আগ্রহে ও উৎসাহে নয় বছর বয়সে হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্জয়’ প্রকাশিত হয়। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় অরুণাচলের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে। তখনই বন্ধুর সহযোগিতায় সুকান্তের সম্পাদনায় ‘সপ্তমিকা’ নামে হাতে লেখা সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাহিত্যের এসব কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতেন তার শিক্ষক নবদ্বীপ দেবনাথ। নবদ্বীপ দেবনাথ শুধু পত্রিকা প্রকাশনা সম্পাদনায় নয়, তিনি সুকান্তকে তার কাব্য রচনার ক্ষেত্রেও উৎসাহিত করতেন। এই ক্ষেত্রে তাকে অনুপ্রেরণাদায়ী আরও একজন ছিলেন, তিনি তার বন্ধুর মা সরলা দেবী।

সুকান্তের বৈমাত্রেয় বড় ভাই ছিলেন তার অতি প্রিয় ব্যক্তি। বিশেষ করে সে ভাইয়ের স্ত্রী বা তার বৌদির সাথে ছিল তার ভীষণ সখ্য। তার ওই দাদার বাড়ি ছিল তার মানসিক প্রশান্তি লাভের সবচেয়ে সুন্দর স্থান। এমনকি সুকান্তের যে ছবি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে তার পেছনেও মূল মানুষটি ছিলেন তার বৌদি। ঘটনাটা এরকম— কোনো একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি সুকান্তকে একটি টাকা দিয়ে তার ইচ্ছেমতো কিছু খেতে বললেন। কিন্তু বন্ধু ভূপেন তাকে পরামর্শ দিল তার মাথাভরা চুলের স্মৃতি ধরে রাখতে, এবং সেজন্য ছবি তুলতে। ওই টাকা দিয়ে সুকান্ত চারটে ছবি তুলেছিলেন। যার একটি হলো বিখ্যাত গালে হাত দেওয়া কোট-টাই পরা ছবি।

বিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় তিনি রাজনীতির হাতেখড়ি নেন। তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের ছাত্র নেতা অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যান। এবং সেই ধারাবাহিকতায় একজন দায়িত্বশীল কর্মী হিসেবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হোন, ফলে কমিউনিস্টদের আস্তানায় তার যাতায়াত বেড়ে যায়, একই সাথে বাড়ে ঘনিষ্ঠতাও। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তার এই ভালোবাসার স্বীকৃতি তিনি পেয়ে যান পার্টির সদস্য পদ রূপে। তিনিই তখন ছিলেন পার্টির তরুণ্যতম সদস্য।

১৯৪৩-এর মহামন্বন্তরের বীভৎসতায় সুকান্ত অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। মানুষের দুঃখ দুর্দশা, অসহায়ত্ব তাকে কাতর করে তুলেছিল। নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি’ দুর্ভিক্ষ কবলিত বুভুক্ষু মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আর হয়তো তখনই তার কলম থেকে এসেছিল তার বিখ্যাত কবিতা ‘হে মহাজীবন’ তিনি লিখলেন—

‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/ এবার কঠিন, কঠোর গদ্য আনো,/ পদ-লালিত-ঝংকার মুছে যাক/ গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!/ প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা—/ কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়;/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি!

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে তার সূক্ষ্ম ও সুকোমল অনুভূতি তার ভেতরকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের নির্মমতা তাকে আরও সুতীক্ষ্ন করে তুলেছিল। তিনি অনুভব করলেন আলোহীন আশাহীন পরিবেশ দেশের কোমলমতি শিশুকিশোরদের বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। তাই তিনি এদের রক্ষা করার দায়বদ্ধতা থেকেই ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে গঠন করলেন ‘কিশোর বাহিনী’। এ প্রসঙ্গে বন্ধুকেও এক চিঠিতে লিখেছিলেন। সম্ভবত বন্ধু সুকান্তকে তার ওখানে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন যার উত্তর দিয়ে কবি লিখলেন—

দোস্ত,

কয়েকটা কারণে আমার তোর ওখানে যাওয়া হলো না। তার মধ্যে প্রথম কারণ দেখালেন ‘কিশোর বাহিনীর দুধের নতুন আন্দোলন শুরু হলো’ অর্থাৎ সে সময় তার কিশোর বাহিনীকে পুরো প্রস্তুত করে ফেলেছেন।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছিলেন প্রচণ্ড অনুরক্ত। তার বন্ধু অরুণাচলের লেখা থেকেও জানা যায় ‘সারাটা জীবন রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় সে ডুবে থেকেছে। জীবনের প্রতিটি মোড়ে-মোড়ে সে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছে।’ তাই তাঁর শ্রদ্ধার প্রথম প্রয়াণ দিবসে লিখলেন কবিতা, ‘প্রথমবার্ষিকী’ ‘আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ।/ আজ বর্ষশেষে হে অতীত,/ কোন সম্ভাষণ/ জানাব অলক্ষ্য পানে?/ ব্যথাক্ষুব্ধ গানে/ ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ!’

কবিগুরুর উদ্দেশ্যে জন্মদিনেও লিখলেন ‘পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশ্যে’ কবিতাটি ‘আমার প্রার্থনা শুনো পঁচিশে বৈশাখ/ আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের/ যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক/ আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ’।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতিবাদ ছিল সর্বত্রই। ‘মিঠেকড়া’ তার ছোটদের জন্য ছড়া কবিতা। এখানে ‘পুরোনো ধাঁধা’ ছড়া কবিতায় প্রথমেই সমাজের নিকট প্রশ্ন রাখলেন, ‘বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে?/ গরিব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?’ আবার তার ভেজালবিরোধী কবিতা ‘ভেজাল-এ তিনি লিখলেন—

‘ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,/ ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়! …/ কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,/ ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই।

মেয়েদেরকে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা। কিংবা প্রত্যেক ক্ষেত্রে পূরুষ আর স্ত্রী লিঙ্গের প্রভেদকে স্পষ্ট করে দেখার প্রতিবাদে তিনি মেয়েদের পদবি নিয়ে যে সামাজিক বিড়ম্বনা তা নিয়ে লিখলেন কবিতা, ‘মেয়েদের পদবী’ মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,… ‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,/ দেখেছি অনেক চিঠি, পোস্টকার্ড, খামে’। তিনি মূলত এখানে মেয়েদের কটাক্ষ করে লেখেননি। লিখেছেন সমাজপতিদের কটাক্ষ করে তীর্যক এবং প্রতিবাদী হয়ে।

সুকান্ত ও অরুণাচলের সখ্য ছিল বিচিত্ররকম। তারা পরস্পরে অভিমান করতেন, অভিযোগ করতেন, আবার একই সাথে সাহিত্য নিয়েও মেতে উঠতেন। সাহিত্য রচনায় তাদের এক চমৎকার সৃষ্টি হলো ‘শতাব্দী’ কবিতা। কবিতাটি যৌথভাবে লিখেছিলেন। এক লাইন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন তো পরের লাইন কবি অরুণাচল লিখলেন।

যেমন,

‘অরুণাচল : হৃদয়ের উল্লাস ছন্দের বন্ধন মানে না।

সুকান্ত : চম্পক গন্ধের পুঞ্জিত ক্রন্দন আনে না;

অরুণাচল : যৌবন খঞ্জন উদ্দাম পিঞ্জর ভাঙ্গতে,

সুকান্ত : রক্তের রঙনে উদ্যত বুঝি আজ রাঙতে।’

… ইত্যাদি।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কবিতা ছিল তার দুই বোন রমা ও রানিকে নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, ‘রমা রানী দুই বোন পরীর মতন/ সবে বলে মেয়ে দুটি লক্ষ্মী কেমন।/ দুই বোন রমা রানী—/ সবে করে কানাকানি,/ দুই বোন হবে ভালো,/ করিবে যে ঘর আলো,/ সিতার মতন।’ রমা ছিলেন সুকান্তর মামাতো বোন আর রানি ছিলেন তার আপন দিদি। এদের সাথে সুকান্তের ছিল ভীষণ সখ্য। একদিন কথায় কথায় তিনি মুখে মুখেই কবিতাটি বানিয়ে ফেলেন। পরে শিরোনামহীনভাবেই কবিতাটি লিখে রাখেন তার খাতায়। অনেক পরে তার দাদা মনোজ ভট্টাচার্য সুকান্তের খাতায় কবিতাটি আবিষ্কার করে এর নামকরণ করেন ‘রমা ও রানী’। তিনি কবিতাটি ১৯৩৫ থেকে ৩৬-এর মধ্যে কোনো এক সময় লিখেছিলেন।

সুকান্ত ভট্টাচার্য মনে-প্রাণে এবং বিশ্বাসে ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। সর্বহারা দুঃখীদের নিয়েই ছিল তার রাজনীতি ও চিন্তার জগৎ। তিনিই সে সময় ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। কবিতায় ও ময়দানে তিনি ফ্যাসিবাদ ও সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে গেছেন।সাধারণভাবে ধারণা করা হয় কমিউনিস্টরা নাস্তিক। কিন্তু সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন একজন সফল আস্তিক কমিউনিস্ট। তার অনেক লেখায় এর প্রমাণ বিদ্যমান। যেমন তার সমবেত গানের ‘প্রণতি’ কবিতায় লিখেছেন,

নমো রবি সূর্য দেবতা/ জয় অগ্নি-কিরণময় জয় হে/ সহস্র-রশ্মি বিভাসিত,/ চির অক্ষয় তব পরিচয় হে।

………………………………………………………………..

রবিহীন আজি কেন মহাশূন্য/ যুগে যুগে দাও তব আশিষ অভয় হে।

মুক্তির কথা শুধু কমউনিস্ট আন্দোলনে নয়। ভক্তির সাথে ঈশ্বরের নিকট বন্দনায়ও। ‘আশিষ অভয় হে’ প্রার্থনায় তার ঈশ্বরভক্তির কথা বন্ধুকে লেখা পত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০ অক্টোবর ১৯৪২ সালে লেখা পত্রে তিনি শুরু করলেন যেভাবে—

অরুণ,

‘প্রথমে বিজয়ার সম্ভাষণ জানিয়ে রাখছি’।…

যুবক বয়সের কবি আর প্রেমে পড়বেন না! তা কী করে হয়। তিনিও প্রেমে পড়েছিলেন। গভীর প্রেম। কিন্তু ভীষণ লাজুক প্রকৃতির ছিলেন, তাই প্রিয়াকে কিছু বলতে না পারলেও তার প্রেমের আকুতি বন্ধু অরুণাচলকে ঠিকই জানিয়েছিলেন। বেলেঘাটা থেকে ১৭.০৪.৪২ তারিখে লেখা পত্রের মাধ্যমে। এই পত্রেই তিনি উল্লেখ করলেন, ‘এদিকে আমি উপলব্ধি করলাম ওর সঙ্গে কথা বলার অমৃতময়তা। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার কথা বলার তৃষ্ণা অসীম হয়ে দেখা দিল, এবং সে তৃষ্ণা আজও দূরীভূত হয়নি।’

কবি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তার ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি কবিতা, ছড়া গান, গল্প, নাটক, গীতিনাট্য এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বিশেষ করে তার রচিত ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটিতে তার ছন্দের উপর বিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট।

জীবদ্দশায় তিনি তার গ্রন্থ দেখে যেতে না পারলেও তার মৃত্যুর পর বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশ হয়। বইগুলো— ছাড়পত্র (১৯৪৮), ঘুম নেই (১৯৫০), পূর্বাভাস (১৯৫০), অভিযান (১৯৫৩), মিঠে-কড়া (১৯৫১), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) সালে প্রকাশিত হয়।

নিজের আদর্শ ও পার্টির প্রতি নিবেদিত প্রাণ কবি তার নিজের হাতে গড়া কিশোর বাহিনীর কাজ সেরে মন দিতেন পার্টি-পত্রিকা ‘জনযুদ্ধ’র প্রচার অভিযানে। এরই মাঝে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশিত হওয়ার পর কবির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। তাকে দেওয়া হয় পত্রিকাটির ছোটদের পাতা ‘কিশোর সভা’র সম্পাদনার দায়িত্ব।

১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ। নাৎসিবাদের পরাজয়ে ঘটলেও প্রভাব রয়ে গেছে ফ্যাসিবাদের। সদ্য যুদ্ধমুক্ত পরাধীন দেশে জাপানি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন তখন বেগবান হয়ে ওঠে। ১৯৪৫-এর ২৯ আগস্ট বন্দিমুক্তি ও কোচবিহারে পুলিশি দমননীতির বিরুদ্ধে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। ওয়েলিংটন স্কয়ারে প্রায় পনের হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশ ঘটে। এই সমাবেশ সফল করার পেছনে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছিল বিশাল ভূমিকা। ট্রাম শ্রমিকের লাগাতার ধর্মঘটেও সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছিল ঘনিষ্ঠ ভূমিকা। এই ধর্মঘট সফল করার জন্য তিনি নিজে চাঁদা তুলেছিলেন। ধর্মতলায় ছাত্রদের উপর পুলিশের নির্মম অত্যাচার সংঘটিত হয় এবং সেখানে পুলিশ গুলি চালায় এই ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সুকান্ত সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। চট্টগ্রামে ১৯৪৫ সালে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলনের উদ্বোধন করা হয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। সম্মেলনে তিনি নিজেও উপস্থিত থেকে স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন।

বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নিজেকে এতটাই সম্পৃক্ত করেন যে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তিনি উদাসীন হয়ে পড়েন। মূলত ১৯৪৪ সালে তার জ্যাঠতুত দাদা বৌদির সঙ্গে কাশি বেড়াতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ অবস্থা থেকে সুস্থ হতে না হতেই আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যান। ফলে তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ সময় তিনি বেশ কিছুদিন কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব নার্সিং সেন্টার ‘রেড-এন্ড-কিউর’ হোমেও কাটান।

প্রায় বিনা চিকিৎসায়, অসুস্থ অবস্থায় পার্টির জন্য প্রাণপণ কাজ তার স্বাস্থ্য আরও সংকট পূর্ণ করে তোলে। তার আবাসস্থল বেলেঘাটার অবস্থা তখন দাঙ্গা উপদ্রুত। টানা কারফিউতে জনজীবন সংকটপূর্ণ। এ অবস্থায় ডাক্তার ও ওষুধের অভাবে কবির অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হতে থাকে। ক্লান্ত এবং পুষ্টিহীন শরীরে ধরা পড়ে যক্ষা। তাকে ভর্তি করা হয় যাদবপুর ‘টি বি হাসপাতালে’। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সুকান্তের গল্পের ক্ষমতাকে ‘সময়ের ছবি, কঠিন সমাজ বাস্তবতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে এই সাহিত্যিকই গুরুত্ব সহকারে তার আরোগ্য কামনায় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘আমরা চাঁদা তুলে মারবো সব কিট/ কবি ছাড়া আমাদের জয় বৃথা।’

কিন্তু সকলের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৫ আগস্ট ১৯২৬ সালের জন্ম নেওয়া তেজদীপ্ত একজন কিশোর বিদ্রোহী কবি তখনকার মরণব্যাধি যক্ষার আক্রমণ সইতে না পেরে ১৩ মে ১৯৪৭ সালে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে যান। তিনি স্বাধীনতা দেখে যেতে না পারলেও নিজের অবদানে নিজের অস্তিত্বের অবস্থানকে সুদৃঢ় করে রেখে যান। মাত্র ২১ বছর বয়সে তার সমস্ত কৃতিত্বকে অমর করে রেখে পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেন।

শেষ করতে চাই তার একটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কঠিন অথচ শৈল্পিক রূপক কবিতা দিয়ে। তিনি ‘ইউরোপের উদ্দেশ্যে’কবিতায় লিখলেন—

‘ওখানে এখন মে মাস তুষার-গলানো দিন,/ এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন;/ হয়তো ওখানে শুরু মন্তর দক্ষিণ হাওয়া; / এখানে বোশেখি ঝড়ের ঝাপটা পশ্চাৎ ধাওয়া;/ এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে/ কত রং, কত বিচিত্র নিশি দেখা দেয় এসে/ ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলে মেয়ে/ এই বসন্ত কত উৎসব কত গান গেয়ে।/ এখানে তো ফুল শুকনো, ধূসর রঙের ধুলোয়/ খাঁ খাঁ করে সারা দেশটা, শান্তি গিয়েছে চুলোয়/ কঠিন রোদের ভয়ে ছেলে-মেয়ে বন্ধ ঘরে,/ সব চুপচাপ: জাগবে হয়তো বোশেখি ঝড়ে।/ অনেক খাটুনি, অনেক লড়াই করার শেষে/ চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমাদের দেশে;/ এদেশের যুদ্ধ মহামারী, ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে— / অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে।/ বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখ—/ আমাদের দেশে মে-মাস; এখানে ঝোড়ো বৈশাখ।

সহায়ক গ্রন্থ : সুকান্ত সমগ্র। সম্পাদনা : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্য সূত্র।

সোমবার, ২৪.০৭.২০২৩; দুপুরে। টিকাটুলী, ঢাকা।

+ posts

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *